আসন্ন নির্বাচনে ইসির বরাদ্দ ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা : সরঞ্জাম কেনাকাটায় ৮০ শতাংশ অগ্রগতি

আগের সংবাদ

রক্তাক্ত গাজায় ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ : হামাসের রকেট হামলায় নিহত ৪০ ইসরায়েলি, পাল্টা হামলায় নিহত ১৯৮ ফিলিস্তিনি

পরের সংবাদ

ভিভিআইপির প্রাইভেট সেক্রেটারি

প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার চাকরিজীবনের শুরুর দিকটাতেই আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। আমাদের কানে এলো প্রেসিডেন্ট এরশাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। চাকরিতে একই গোত্রভুক্ত হওয়ায় আমারও কিছুটা প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। শিগগিরই শুনলাম মাহমুদুর রাজা চৌধুরী প্রেসিডেন্ট এরশাদের একান্ত সচিব হয়েছেন। আমরা সন্তুষ্টই হলাম। যাক, শিক্ষা তো হলো।
বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামের স্মৃতিকথন থেকে উঠে এসেছে : প্রধানমন্ত্রী সিএসপি কর্মকর্তা ডক্টর সাত্তারকে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব করলে তার হাবভাব অধ্যাপক ইসলামের পছন্দ হয়নি, তিনি সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার প্রত্যাহার চান। তিনি প্রত্যাহৃত হলেন কিন্তু অধ্যাপক ইসলাম ও তার সঙ্গীদের হতবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োগ করলেন।
মাহমুদুর রাজা চৌধুরী তখন ঢাকা বিভাগের কমিশনার। ধান্ধাসর্বস্ব না হলে সুস্থ মস্তিষ্কের কারো কমিশনার থেকে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হওয়ার কথা নয়, যদি না পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। ঢাকার কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর সচিব হবেন এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ‘কালের নিরন্তর যাত্রা’ এবং ‘স্মৃতির দিগন্তে’ দুটি স্মৃতিগ্রন্থে এটাই স্পষ্ট, তাকে একান্ত সচিব পদে যোগ দিতে বাধ্যই হতে হয়েছিল। তবে যোগ দিয়ে তিনি তার সাধ্যমতো এবং বিধানমতো দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু তিনি যোগদানের আগেই আদেশটা বাতিল করাতেও উদ্যোগীর ঘাটতি হয়নি। যখন তিনি এলেনই কমিশনারের শূন্য পদে ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ’-এর প্রিয় একজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করতে, তারা কামিয়াব হন। স্মৃতির দিগন্তে থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘এদিকে আমার উত্তরসূরি হিসেবে কমিশনার পদে যিনি যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তিনি এই পদে যোগদানে ছিলেন উদগ্রীব। তাকে এখানে আনার পেছনে কিছু কর্মকর্তার পরিকল্পনা ছিল, যারা ভেবেছিল যে বদলি ও ভূমিসংক্রান্ত বিষয়াদি এবং ঢাকা বিভাগের ১৭টি জেলার প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে একজন ‘নিজস্ব’ কমিশনার থাকলে অনেক সুবিধা হয়।’ এই উত্তরসূরি এক সময় ঢাকার জেলা প্রশাসক ছিলেন এবং খোলা মাঠে জনসমক্ষে নিজের পকেটের রুমাল বের করে প্রেসিডেন্ট এরশাদের জুতোয় লেগে যাওয়া ময়লা পরিষ্কার করে তার আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। স্বীকার করতে হবে, জুতো চুম্বনের এই ধারাটিই কালক্রমে মাঠ প্রশাসনের মূল ধারায় পরিণত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের একান্ত সচিবের চোখ-কান খোলা থাকলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও প্রশাসনের অন্দরমহলটা ভালো করেই দেখা হয়ে যায়। সেই দেখা ও জানার ডকুমেন্টেশন কেবল ‘ধান্ধাহীন’ ব্যক্তির পক্ষেই করা সম্ভব।
ডিভিআইপি দেশে মাত্র দুজন, তাদের সঙ্গে কারা সাক্ষাৎ করতে পারেন, কিংবা সাক্ষাৎকার চাইলে তা মঞ্জুর হয়- এ নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক অভিসন্দর্ভ রচিত হতে পারে। মাহমুদুর রাজার লেখায় এর একটা সারাংশ পাওয়া যায় : ‘বিদেশি মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তি এলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের রেওয়াজ সব দেশেই প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এখানে দেখলাম যে বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং নিম্ন পর্যায়ের বিদেশি কর্মকর্তাদেরও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ দেয়া হচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব বিদেশির সাক্ষাৎ প্রদানের অনুকূলে নির্বিচারে অনুরোধপত্র প্রেরণে দ্বিধাবোধ ছিল না।’ অবশ্য লেখক বলেছেন বিদেশি নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সরকারপ্রধানের নির্বিচারে দেখা সাক্ষাতের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমল থেকে।
আমার একটি কৌতূহলের জবাব পেয়ে গেছি। মিগেল স্যান্তোস নামক একজন জ্যেষ্ঠ বিক্রয় প্রতিনিধিকে অপর একটি প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে আমার চাকরিকালে মিনতি করে একটি সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করতে হয়েছে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাতের ছবি বেশ ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের কতটা মঙ্গল হয়েছে এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে; কিন্তু এ ছবি যে তার জীবনপঞ্জিতে উত্তম আঠা দিয়ে লাগানো থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। যারা এই সাক্ষাৎকারের সুযোগ করে দিয়েছেন তারা কতটা লাভবান হয়েছেন, তা গবেষণার বিষয়।
একজন অবসরপ্রাপ্ত চৌকস কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ নির্ধারণ করার ফরমায়েশ দিলেন একান্ত সচিবকে। কিন্তু যিনি সাক্ষাৎ দেবেন তিনি অনাগ্রহী- এই না টুকু আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর কোনো সুযোগই নেই। এমনকি অনানুষ্ঠানিকভাবে বলাও বিব্রতকর। আভাসে ইঙ্গিতে তা জানিয়ে দিতে হয়, কিন্তু এই চৌকস কর্মকর্তা একান্ত সচিবকে একহাত নিলেন। অবসরপ্রাপ্তরা যে ‘রৌদ্রকরোজ্জ্বল মধ্যগগনে’ আর অবস্থান করেন না সে বোধ তাদের অনেকেরই নেই। জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে মূলত দালালি ধরনের কাজে লিপ্ত এ ধরনের ক’জনকে আমিও পেয়েছি, সোহাগ করেই তাদের বলতাম ‘পারিবারিক মাফিয়া’ এবং সতর্ক থেকেছি যেন তাদের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারি। পারিবারিকীকরণ আমলাতন্ত্রে আমরা একই গোত্রভুক্ত।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ব্লকে চাকরির সুযোগ আমার হয়েছে। সে সময়কার দুজন সাক্ষাৎপ্রার্থীর কাহিনি জানাতে প্ররোচিত বোধ করছি। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী এবং সজ্জন আমাকে ফোন করে বললেন, তিনি প্রথমে আমার সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে চান। তার একটি সংকট যদি আমি মিটিয়ে দিতে পারি তাহলে আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। তিনি ফোনে বললেন তার নাম মোহাম্মদউল্লাহ। আমার পরিচিত এ নামের কেউ না থাকায় জানতে চাইলাম তিনি কে? বললেন, আমি বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট।
আমি পারি তো তখনই দাঁড়িয়ে যাই। তাকে যাতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সিংহদরজা থেকে সসম্মানে আনা হয় সে হুকুমও পাঠাই।
তিনি যথাসময়ে এলেন, আমি তাকে সহায়তা করার জন্য তখন উন্মুখ। তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পেনশন পাচ্ছেন না। আবেদন করেছেন, আবেদনপত্র গৃহীত হলেও আবেদনের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো আদেশ জারি হয়নি। যতদূর মনে পড়ে পেনশন না পাওয়ার কারণটা তিনিই ব্যাখ্যা করেছেন এবং সঠিকভাবেই। ১৯৭৯ সালের ১৮ নম্বর আইন- ‘দ্য প্রেসিডেন্টস পেনশন’ অর্ডিন্যান্স জারির সময় থেকে তা কার্যকর করা হয়েছে। রেট্রোস্পেকটিভ অ্যাফেক্ট এতে দেয়া হয়নি। (২০১৬ সালের ৪২ নম্বর আইনে ১৯৭৯’র অর্ডিন্যান্স বাতিল করে রাষ্ট্রপতির অবসর ভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইন ২০১৬ জারি করা হয়েছে।) নিজে থেকেই বললেন আইন সংশোধন না করে তার পেনশন পাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকারও ছিলেন। আমি বললাম, তাহলে কি স্যার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের উদ্যোগ নেব?
তিনি বললেন, তাতে সাক্ষাৎ হবে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। থাক দরকার নেই।
২০০২ সালের প্রথম দিকের একজন হেভিওয়েট সাক্ষাৎপ্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমি তখনকার প্রেসিডেন্ট ডক্টর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একান্ত সচিব। ১৯৮০’র দশকের শেষভাগে ভূমি সংস্কার ও গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচির উদ্যোগী সচিব এম মোকাম্মেল হকের একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমাকে চেহারায় ও নামে ভালো করেই চিনতেন। তিনি ফোন করে নাম ধরে আমাকে বললেন, আমাকে প্রেসিডেন্ট সাহেবের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দাও। জাস্ট সৌজন্য সাক্ষাৎ। রাজনৈতিক কারণে বিষয়টি সংবেদনশীল বলে আমি বললাম, স্যার মিলিটারি সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মনসুরকে বলুন।
তিনি বললেন, আমার জন্য তুমিই যথেষ্ট।
আমি বললাম, আচ্ছা স্যার, জানাব।
প্রেসিডেন্ট সাক্ষাৎকার প্রদানে সম্মত হলেও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বিবেচনা করার জন্য বিষয়টি সরকারপ্রধানকে অবহিত করতে হলো। সেখান থেকে যে পরামর্শ পেলাম তার সারমর্ম : গো সেøা।
আমার ফোন আর যাচ্ছে না, দুদিন পর তিনি আবার ফোন করলেন। জবাব দেয়া আমার জন্য বিব্রতকর। বললাম, আমি শিগগিরই আপনার সঙ্গে দেখা করব।
দেখা হয়েই গেল। তিনি বললেন, ‘না’ হয়ে গেছে না কি?
আমি হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, ইটস ওকে।
দুজন সাক্ষাৎপ্রার্থী, দুজনই আমার জন্য স্মরণীয়। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাক্ষাৎকার মঞ্জুর না হওয়ায় সামান্য উষ্মাও প্রকাশ করেননি। বললেন, আমিও তাই ভেবেছিলাম।
১৯৯৮’র ১১ জানুয়ারি মাহমুদুর রাজা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। নৈর্ব্যক্তিকভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য এটি একটি যথার্থ পাটাতন- তিনি তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে দেখছেন (এখনকার লোকপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) সচিব মাহে আলম স্বচ্ছ পদ্ধতি কিংবা পদ্ধতির ঈষৎবহির্ভূত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তামিল করতে গিয়ে ‘পুনঃপুনঃ নানা বিপত্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ক্ষমতাকেন্দ্রের আশকারাপ্রাপ্ত নিম্নপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ক্ষণে ক্ষণে যার প্রেরিত পদায়ন ও পদোন্নতি সংক্রান্ত নথি টর্পেডো করা হচ্ছিল। তখনো বা গুরুত্বপূর্ণ নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।’ (স্মৃতির দিগন্তে)
‘ক্ষমতাকেন্দ্রের আশকারাপ্রাপ্তরা’- বিভিন্ন সময় প্রশাসনিক শৃঙ্খলার বারোটা বাজিয়েছেন আর তার শুরুটা স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সার্কেল অফিসার থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সৈয়দ হোসেনকে দিয়ে। ধারণাটি মূলত প্রশাসনের মূলধারা। ম্যাক্সওয়েবারিয় আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনের সবক যেসব মন্ত্রী ও সচিব দিয়ে থাকেন তারাও জানেন ‘নন-ওয়েবারিয়ান’ আমলা প্রশাসনের সুফলভোগীদের মধ্যে তারাও রয়েছেন। মিডিওয়াকার মানের সচিব মাহে আলম চাকরিতে এক্সটেনশন বাগানোর মতো যথেষ্ট ধূর্ত ছিলেন না, সুতরাং তাকে যথাসময়ে অবসর নিতেই হয়। কিন্তু তারপর তিনি যা করলেন তা হচ্ছে একটি ‘মহাকাব্যিক ভুল’- যুবক নামের একটি এমএলএম (কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং) প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হলেন। সংবাদপত্রে তার বড় ছবি ছাপিয়ে অভাবনীয় লাভের দিকে আকৃষ্ট করে বহু সদস্য জোগাড় করা হলো। তারা ঘটিবাটি বেচে ও বন্ধক দিয়ে ‘যুবক’-এর সদস্য হয়ে কিছুকাল পর টের পেল তারা হায় হায় কোম্পানির পাল্লায় পড়েছে, যার প্রধান উপদেষ্টা সিএসপি মাহে আলম। যুবকের তদবির নিয়ে তিনি আমার কাছেও এসেছেন, আমি তখন সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক। আমি সবিনয়ে বলেছি, ‘স্যার এ কাজ আপনাকে মানায় না’। তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে কিন্তু তার কারণে আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগ করে যারা পুঁজি হারিয়েছেন তিনি তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে কোনো বিবৃতি দেননি- একমাত্র নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়া আর কারো কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার সংস্কৃতি বাংলাদেশ আমলাতন্ত্রে গড়ে ওঠেনি। একজন সাবেক সেনাপ্রধানও এমন একটি এমএলএম কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন।
এই স্মৃতিকথায় পরবর্তী সংস্থাপন সচিবের একটি পোর্ট্রেট উপস্থাপন করেছেন : নিজ দায়িত্বে তিনি নিষ্ক্রিয়ই থাকতেন, শতভাগ নির্ভর করতেন অধীনদের ওপর। আর ক্ষমতাকেন্দ্রের আশকারাপ্রাপ্ত অশুভ গ্রুপের সামনে তিনি খুলে দিয়েছিলেন তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নের সিংহদ্বার। তবে তার তিনটি সাফল্যের দিকে লেখক (প্রধানমন্ত্রীর তখনকার একান্ত সচিব) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন : ১. নিজের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা; ২. একটি প্রশিক্ষণার্থী দলের কথিত মেন্টর হয়ে বিলেত গিয়ে নিজের চিকিৎসা করা; ৩. স্ত্রীকে জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনে ইকোনমিক মিনিস্টার করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা (সরকার বদলে তৃতীয়টির বাস্তবায়ন ঘটেনি।)
কাছে থেকে তার দেখা একজন সংস্থাপন সচিব অবশ্যই উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘যে সময় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে একজন যুগ্ম সচিবের আগমন ঘটে। তাকে দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব করা হলো এবং অল্পদিনের ব্যবধানে তাকে একই মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দেয়া হলো। প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল যে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পূর্ণাঙ্গ সচিব পদায়নের পূর্বে এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ সচিব হিসেবে তার নিয়োগ নিশ্চিত করা হলো। এ দায়িত্বের পরিধি ও ব্যাপকতা ছিল সেই ব্যক্তির যোগ্যতা, জ্ঞান ও চিন্তাচেতনা অযুত যোজন ঊর্ধ্বে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম কার্যদিবসে তাকে আর সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদে দেখা যায়নি।’
‘ক্ষমতাকেন্দ্রের আশকারাপ্রাপ্ত’ প্রিয়জনেরা লেখকের মতে একজন সংস্থাপন সচিবের আমলে সুবিধা করতে পারেননি। তিনিও ক্ষমতাকেন্দ্রের অনেক কাছের লোক- সফিউর রহমান। ‘জনতার মঞ্চে’ তার অবদানের প্রেক্ষিতে তাকে বিরোধিতা করা বা তার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার সাহস দুর্জনের ছিল না। সেই সব ব্যর্থ ও হতাশ কর্মকর্তারা সফিউর রহমানকে ‘খোমেনী’ নামে অভিহিত করত।
সফিউর রহমানের সততা ও দৃঢ়তার সুনাম ছিল। তার কারণেই আমি জীবনে একবার আমার পছন্দের পোস্টিং-পিএটিসিতে মাস্টারি করতে যেতে পেরেছি। একটি ডিগ্রি হাসিল করে সংস্থাপনে যোগ দিই এবং যুগ্ম সচিবের (এপিডি) সঙ্গে সাক্ষাৎ হতেই বললেন, দেশে ফেরা মাত্রই আপনার সচিবের সঙ্গে দেখা করার হুকুম হয়েছে।
আমি ক্লিন-শ্যাভেন যে কর্মকর্তাকে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি তার কক্ষে ঢুকে দেখি তিনি শশ্রæমণ্ডিত। সহকারী সচিব পর্যায়ের কারো মুখে বেমানান তবুও বলে ফেলি, স্যার ইউ লুক ডিফারেন্ট ইন বিয়ার্ড।
তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, তোমার পোস্টিং ঠিক করে রেখেছি, পিএটিসিতে যাবে।
আমি বললাম, আই অ্যাম গ্রেটফুল স্যার, বহুবার তদবির করেও কোনো একাডেমিতে পোস্টিং পাইনি।
এর আগে আমি লিয়েনে একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানে বছর দেড়েক কাজ করেছি। সফিউর রহমান তখন স্বাস্থ্য সচিব। স্বাস্থ্য সচিবকে সন্তুষ্ট করতে প্রতিষ্ঠান তার পুত্রকে উচ্চ বেতনে একটি চাকরি দিয়ে রেখেছিল। এই সন্তুষ্টি সফিউর রহমানের ইমেজের সঙ্গে বেমানান। জনতার মঞ্চে দণ্ডায়মান হওয়াটাও তার ইমেজের সঙ্গে বেমানান ছিল। মাত্র দুই-আড়াই মাস চাকরি থাকা অবস্থায় তিনি একটি বড় গ্যাম্বলিং করেছেন, হেরে গেলে এমন কোনো ক্ষতি নেই, জিতে গেলে একেবারে জ্যাকপট। স্মৃতির দিগন্ত নিয়ে বলার আরো আছে, আমার কাছে এটা প্রশাসনিক ইতিহাসের একটি দলিল।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়