বৈষম্য নিরসনের দাবি : কর্মবিরতিতে যাচ্ছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি

আগের সংবাদ

পুলিশের সামনে যত চ্যালেঞ্জ : দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

পরের সংবাদ

জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য স্মার্ট নগরায়ণ ও আবাসন

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সৃষ্টির আদিযুগ থেকে প্রাণিকুলের অংশ হিসেবে মানবজাতি ঝোপ-জঙ্গলে সহস্র কোটি বছরে বসবাসের ধারাবাহিকতায় খাদ্য সংকট মোকাবিলার তাগাদা থেকে কৃষি উৎপাদননির্ভর বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের সূচনা ঘটে। এই সূচনার প্রায় ১০ হাজার কোটি বছর আগে মানুষ একত্রে বসবাসের জন্য গৃহ তৈরির যাত্রা শুরু করেছিল। সেই থেকে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকতায় গৃহের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে বর্তমানে সমাজরাষ্ট্রে গৃহ বা বাসস্থান মানুষের ৫টি মৌলিক অধিকারের অন্যতম সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে ‘সবার জন্য গৃহ’ প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বসভ্যতায় গৃহ বা বাসস্থান শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবেই নয়, বরং সামাজিকভাবে ব্যক্তির জীবনবোধ ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নয়ন-উৎপাদনের প্রোডাকটিভিটি বৃদ্ধির অনুপ্রেরণা তথা ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়ন সমৃদ্ধির উৎসস্থল হিসেবেই বিবেচ্য।
একটি গৃহ বা বাসস্থান যেমন ব্যক্তি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুপ্রেরণা জোগায়, তেমনিভাবে সমষ্টির উন্নত আবাসন ব্যবস্থা ও সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সমৃদ্ধির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। একই ধারাবাহিকতায় দেশের সমগ্র জনগণের জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে স্মার্ট নগরায়ণ এবং উন্নত-সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে দেশ ও এর নাগরিকরা।
এবার বিশ্ব বসতি দিবস উপলক্ষে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে- ‘জবংরষরবহঃ টৎনধহ ঊপড়হড়সরবং. ঈরঃরবং ধং ফৎরাবৎং ড়ভ মৎড়ঃিয ধহফ জবপড়াবৎু’, যা বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ‘স্থিতিশীল নগর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধারে টেকসই নগরসমূহই চালিকাশক্তি’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশে আজ বিশ্ব বসতি দিবস পালন করছে।
এসডিজির অভীষ্ট লক্ষ্য-১১-এ টেকসই নগর ও জনপদের কথা বলা হয়েছে। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশের সব মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বাসস্থান বা নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত আবাসস্থল নির্মাণ করা এখন সময়ের দাবি। স্বল্প ভূমির জনবহুল এ দেশে ‘সকলের জন্য গৃহ’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ব্যতীত কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নগর ও শহরে বসবাস করবে। বাংলাদেশও আগামীতে একই রূপ ধারণ করবে। কেননা এ দেশেও জিডিপির ৬০-৬৫ শতাংশ আসে শহরাঞ্চাল থেকে। অচিরেই তা ৮০ শতাংশ উন্নীত হওয়ার আশা করা হচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান বাস্তবতায় দ্রুত নগরায়ণের ফলে আধুনিক নগর জীবনব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীল নগর অর্থনৈতিক কর্মব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের ন্যায় দ্রুত বর্ধনশীল নগরায়ণ ও নগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশ বিবেচনায় নগর অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টতই বলা আছে- রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মানের উৎকর্ষ সাধন। পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যক্তি ও সমাজকে পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অবতীর্ণ হতে হবে এবং পরিবেশের যতœ নিতে হবে। কেননা জনগণের কার্যক্রমে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এটি স্পষ্ট যে, শিল্পবিপ্লব ও শিল্পায়ন, নগরায়ণ, প্রযুক্তিবিপ্লব, সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং ভোগসর্বস্ব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্যপীড়িত অর্থনীতির কারণে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ ও জীবনমানে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তারই একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে অপরিকল্পিত নগর অর্থনীতি বহুলাংশে দায়ী। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশের সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে পৃথিবীকে কীভাবে বাসযোগ্য নগর অর্থনীতির বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা যায়, সে বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বস্তুত নগর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এখন আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে পৃথিবীর সম্পদরাশি ও সম্পদের উৎস যেমন সীমাবদ্ধ, তেমন তার দূষণ সহ্য করার ক্ষমতাও অসীম না।
জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্য-১১-এ বলা আছে- ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও মূল্যসাশ্রয়ী আবাসন এবং মৌলিক সুবিধায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাসহ বস্তির উন্নয়ন সাধন; অরক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, নারী, শিশু, অসমর্থ (প্রতিবন্ধী) ও বয়োবৃদ্ধ মানুষের চাহিদার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে প্রধানত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের সম্প্রসারণ দ্বারা সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সুলভ ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থায় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই নগরায়ণ ব্যবস্থার প্রসার ও অংশগ্রহণমূলক, সমন্বিত ও টেকসই জনবসতি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা প্রচেষ্টা জোরদার, বায়ুর গুণাগুণ এবং পৌর ও অন্যান্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদানসহ অন্যান্য উদ্যোগের মাধ্যমে নগরগুলোর মাথাপিছু পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনা, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থানে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার প্রদান করতে হবে।
এ কথা বলা যায়- মানুষের লোভ ও তথাকথিত উন্নয়নের যে কোনো প্রক্রিয়ার অনিবার্য পরিণতি হলো কম-বেশি পরিবেশ দূষণ। আধুনিক উন্নয়নের নামে কলকারখানা বাড়লে তাতে বায়ুদূষণ যেমন বাড়বে, তেমনি হ্রাস পাবে প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই বলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাবে, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বর্তমানে উন্নয়ন দর্শন অনেকটা শহরভিত্তিক, আয়ভিত্তিক ও ভোগভিত্তিক হওয়ায় এ ধরনের উন্নয়নের কুফল পরোক্ষভাবে মানুষকে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে নিচ্ছে। প্রকৃতির নির্মমতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে এখন মানুষ উন্নয়ন বলতে বুঝে বড় বড় অট্টালিকার শহর নির্মাণ, শপিং মল, চকচকে বাড়ি, ফ্ল্যাট, নতুন গাড়ি বা চাতুর্যপূর্ণ নগরকে। উন্নয়নের এ ধারণাটি অর্থনৈতিক সম্পর্কিত বিধায় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল জাতিরাষ্ট্রগুলো এ ধরনের উন্নয়নে জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে থাকে। এ ধরনের উন্নয়ন ধারণা বাস্তবিক অর্থে অনগ্রসরতা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে অসাম্য ও তার থেকে উদ্ভূত বৈষম্য কল্যাণমূলক অর্থনীতির দর্শন হতে পারে না। যা স্থিতিশীল উন্নয়নের অন্তরায়। এ ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো মূল পুঁজিপতিদের লাভের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গৃহীত হয়। কিন্তু স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়। বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়টি মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ তার মধ্যে অন্যতম। এ ধরনের প্রকল্পের বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে দেশীয় প্রকৃতি পরিবেশের ওপর মারাত্মকভাবে ফেলছে। বাড়ছে তাপমাত্রা। জৈববৈচিত্র্যের বিরূপ প্রভাবে আম, পেয়ারা, নারিকেল, সুপারির ন্যায় দেশীয় ফলজ উৎপাদন ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল টাওয়ার নগরায়ণে ক্যান্সারের মতো ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। পানির প্রাকৃতিক উৎস ধ্বংস করে ক্রমবর্ধমান নগর বিকাশ ও শহুরে মানুষের চাহিদা বিবেচনায় ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন দেশকে ক্রমান্বয়ে মরু প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে নগর বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারায় সৃষ্টি হচ্ছে বায়ুদূষণ, যা জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি স্থিতিশীল নগরায়ণের ক্ষেত্রে অন্তরায়।
নগর অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিতে ‘স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা’ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা স্থানীয় সরকার নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা, ব্যবসায়িক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি বিষয়ে উপযুক্ত নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু আমাদের মতো নানা সমস্যায় জর্জরিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়ায়, নগর উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। ফলে সিটি করপোরেশন বা পৌর নগরায়ণের ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ভূমিকা দৃশ্যমান হয়ে উঠে না। কার্যত সে কারণে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ নানামুখী সমস্যা সৃষ্টির পাশাপাশি মূল্যবান কৃষিজমি নষ্ট করছে। অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত কারণে সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সুষ্ঠু পয়ঃ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। অপরিকল্পিত আবাসন ও সড়ক নির্মাণের কারণে প্রত্যেক নগরজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। যেখানে মূল্যবান কর্মঘণ্টার ক্ষয় হচ্ছে। নগরগুলোতে পরিবহন ব্যবস্থায় পৃথক লেন ব্যবস্থা না থাকায় রোগী বা অত্যাবশ্যকীয় সেবা বিঘœ হচ্ছে। রিকশা ও থ্রি হুইলারের ন্যায় স্বল্পগতির যানের আধিক্য ও তাতে জনগোষ্ঠীর বিনিয়োগ এক ধরনের জাতীয় অপচয়। যা জাতীয় প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
টেকসই উন্নয়ন ধারণাটি এখন শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান প্রজন্মের ভোগ সীমিতকরণকেই বোঝায় না, বরং এটি নির্দেশ করে, সংখ্যালঘিষ্ঠের অ-টেকসই ভোগের কারণে বর্তমান প্রজন্মের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের তাগিদই প্রদান করে না, বরং এটি এক নতুন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ইঙ্গিত করে। এই প্রবৃদ্ধি বিশ্বের সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতিসাধন না করে এবং বিশ্বের ধারণযোগ্য ক্ষমতার সঙ্গে আপস না করে বিশ্বের গুটিকয়েক সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর পরিবর্তে সব মানুষের জন্য সুবিধা সৃষ্টির অঙ্গীকার করে। আমরা ব্যাপকভিত্তিক ও যথোপযুক্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অবারিত তথ্য প্রবাহের ব্যবহার করে সবার জন্য উন্মুক্ত সহযোগিতা ও পরামর্শের মাধ্যমে সরকারের সব স্তরে সরাসরি অংশীদারত্বের নতুন কাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে ধারণাগত পর্যায় থেকে নগর নকশা ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পর্যালোচনাকরণে নগর ও অঞ্চল নীতিমালা ও পরিকল্পনা পদ্ধতিতে বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। যা নগর অর্থনীতির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে সহায়ক হতে পারে। টেকসই নগর উন্নয়নের প্রধান উপাদান হলো- পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। এর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য নগরের জন্য অনন্য চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের সম্পৃক্ত। যেহেতু দ্রুত নগরায়ণের ধারণা থেকে শহরগুলোতে অনেক সম্পদ ব্যবহার হয় এবং পরিবেশে এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে, তাই নগরায়ণের পরিকল্পনায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিবেচনা রাখে। বিশেষ করে মূল্যবান ভূমিব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক উৎস রক্ষা, সাশ্রয়ী আবাসন, শহুরে দূষণ, বৈষম্য হ্রাস এবং আবাসন, সেবা, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পৃথক জোন রেখে টেকসই নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে; যা স্থিতিশীল নগর অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে।
আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই আবাস ভূমি রেখে যাওয়ার স্বার্থে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে গ্রামপর্যায়ে বিস্তৃত করে দেশের প্রতিটি গ্রামে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিম্নোক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সামগ্রিক কার্যক্রম গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলায় বিস্তৃত করা। সেই প্রেক্ষিতে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের উপ-সহকারী প্রকৌশলী দপ্তর বা উপ-সহকারী স্থপতির দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যদি এই মুহূর্তে সব উপজেলায় হাউজিং অধিদপ্তরের শাখা অফিস খোলা না যায়, তাহলে উপজেলা পর্যায়ের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করে কার্যক্রম শুরু করা যায়।
২। গ্রামীণ জনপদের ঘরবাড়ি, রাস্তা, পুকুর, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সবকিছু পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিটি থানা/ইউনিয়নে সার্ভে করে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা।
৩। ‘কৃষিজমি রক্ষা কর- পরিকল্পিত গ্রাম গড়’ এই রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তিতে এলোপাতাড়ি ঘরবাড়ি নির্মাণে নিরুৎসাহিত করে ক্লাস্টার ভিলেজ নির্মাণে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করা।
৪। প্রস্তাবিত ক্লাস্টার ভিলেজে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত নকশা অনুযায়ী ব্যক্তি বা যৌথ মালিকানাধীন বহুতল বাড়ি নির্মাণের সুযোগ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।
৬। শিক্ষা, চিকিৎসা, সেবা ও আবাসন ক্ষেত্রগুলোর পৃথক জোন রেখে নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
৭। বঙ্গবন্ধুর ‘আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান’ শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক, কৃষি শিক্ষার আওতায় দক্ষ জনবল গঠনসহ সমগ্র জাতির মধ্যে দক্ষতা সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এতে দেশের প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষকে বিভিন্ন পেশায় কর্মদক্ষতায় শিক্ষিত করা সম্ভব হবে এবং জাতীয় প্রোডাক্টটিভিটিই বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষিত সমাজই একসময় স্বউদ্যোগেই প্রতিটি গ্রামে গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত বহুমুখী কো-অপারেটিভ ব্যবস্থাপনায়। যার মধ্য দিয়ে জাতির পিতার কাক্সিক্ষত উন্নত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
৮। গ্রামীণ পর্যায়ে সব ইনফর্মাল অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ফর্মাল অর্থনৈতিক কার্যক্রমভুক্ত করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীলকরণে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য উদ্যোক্তা উন্নয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি এসএমই ফান্ডেশন ও বিসিকের কর্মপরিধি বিস্তৃতি করা।
৯। নতুন প্রজন্মের আগামী সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় কৃষিজমি রক্ষা ও পরিকল্পিত স্মার্ট গ্রাম গড়তে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ‘পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ’ এবং পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ‘গৃহায়ন’ অংশকে একত্রিকরণের মাধ্যমে স্মার্ট গ্রাম উন্নয়ন ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা।
১০। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পকে দীর্ঘমেয়াদি সেবায় রূপান্তর ও অধিকতর সেবামূলক করার লক্ষ্যে বহুতল বিল্ডিং নির্মাণ এবং অবশিষ্ট খাসজমিতে কৃষি সমবায় ফার্ম গঠন করে দেয়া।
১১। শহরের করপোরেট ধনী শ্রেণি কর্তৃক কৃষিজমিতে নির্মিত সব রিসোর্ট ভেঙে ফেলা এবং আগামীতে কৃষিজমির অপব্যবহার রোধ করে রিসোর্ট নির্মাণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা।
স্মার্ট বাংলাদেশের রূপ পরিকল্পনা ধরে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার নগর অর্থনীতি উন্নয়নে বহুমাত্রিক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে শহুরে জীবনমানে বৈচিত্র্য এলেও নগরবাসীর জীবনযাত্রায় ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে চলেছে। প্রাচুর্য ও জীবনব্যয়ের সামঞ্জস্যতা রেখে নগর অর্থনীতি ঢেলে সাজানো এখন সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। আয় বৈষম্য নগর জীবনব্যবস্থায় যে ধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে, সেটি অব্যাহত থাকলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অপরিহার্যভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। তাই স্থিতিশীল নগর অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে নগর প্রাচুর্যের পাশাপাশি সর্বসাধারণের স্বাচ্ছন্দ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নীতি দর্শনের আলোকে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

এ কে এম এ হামিদ : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়