ভোটের দিন বাইক চালাতে পারবেন সাংবাদিকরা : ইসির অতিরিক্ত সচিব

আগের সংবাদ

ভিডিওবার্তায় তামিম ইকবাল : নোংরামিতে থাকতে চাইনি > কখনো বলিনি ৫ ম্যাচের বেশি খেলব না > তীর ৩ শীর্ষ কর্মকর্তার দিকে

পরের সংবাদ

এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার ৫০ বছরে স্বনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বিগত এক যুগ ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু বিশ্বের বিস্ময় নয়, বরং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের এই স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে। মাথাপিছু আয়, খাদ্য ও পুষ্টি প্রাপ্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। নানাবিধ সমস্যা এবং দুঃসময়েও বিশ্বের বুকে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি সম্পন্নও হয়েছে। যেমন- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রথম আবাসিক প্রতিনিধি ছিলেন নরওয়ের ইয়ুস্ট ফালান্দ। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ফালান্দ ও মার্কিন অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পার্কিনসন যৌথভাবে একটি বই লেখেন। যার নাম ছিল ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’। যেখানে তারা লিখেছেন, অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না। তাদের অনুমানের অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে বাংলাদেশ। ইয়ুস্ট ফালান্দের সম্পাদনায় আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। নাম ছিল ‘এইড অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স : দ্য কেস অব বাংলাদেশ’। সেখানেও তিনি পরিষ্কারভাবে লিখেছিলেন, টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে বহু বছর বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে।
১৯৫৯-৬২ সময়ে অস্টিন রবিনসন ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৩ সালে তিনি ‘ইকোনমিক প্রসপ্রেক্টস অব বাংলাদেশ’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে তিনি লেখেন, বাংলাদেশে উৎপাদন যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে জনসংখ্যা। এর ফলাফল হচ্ছে দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, মৃত্যু ইত্যাদি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলার। অস্টিন রবিনসন এক হিসাবে বলেছিলেন, যদি বাংলাদেশ ২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়ায়, তাহলে লাগবে ১২৫ বছর; আর ৩ শতাংশ হারে আয় বাড়লে লেগে যাবে ৯০ বছর। এটা সম্ভব যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ তা পারবে কিনা, তা নিয়ে তার গভীর সংশয় ছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। বিশ্বব্যাংক তখন বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল।’ সেই বিশ্বব্যাংকই ১৯৯৫ সালে ‘বাংলাদেশ ২০২০ : একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত সমীক্ষা’ শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে একটি গবেষণা করে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোথায় যাবে, এটাই ছিল গবেষণার বিষয়বস্তু। বিশ্বব্যাংকের সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা ছিল, দারিদ্র্যের হার দ্রুত নামিয়ে আনা, প্রবৃদ্ধির হার ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করা, ৫ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ, পরিবেশের কার্যকর সংরক্ষণ, ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৮০০ কোটি ডলার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনা ইত্যাদি। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব কটি লক্ষ্যই অর্জন করেছে বাংলাদেশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়েও রয়েছে।
গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সিইবিআরের পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ২০২১ সাল হতে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটবে গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। তবে এর পরের ১০ বছরে এই হার কিছুটা কমে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। সিইবিআরের সূচক অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায় যুক্ত হবে তিনটি নতুন দেশ- ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশের উত্থানকেই সবচেয়ে নাটকীয় বলতে হবে। বর্তমান র‌্যাঙ্কিং ৪১ থেকে বহু দেশকে টপকে বাংলাদেশ পৌঁছাবে ২৫ নম্বরে।
বিখ্যাত মার্কিন অনলাইন সংবাদপত্র পলিসি ওয়াচার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রশংসা করে বলেছে, অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেস স্টাডিতে পরিণত হয়েছে। অনলাইন পত্রিকাটির ২২ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি কি সত্যিই দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে?’ এই শিরোনামের এক নিবন্ধে বলা হয়, সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫০ বছরে ২৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পলিসি ওয়াচারের সম্পাদকীয় বাছাই বিভাগে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধের লেখক সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ড. এমিলিয়া ফার্নান্দেজ দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।নিবন্ধে এমিলিয়া ফার্নান্দেজ বলেন, অনেক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেস স্টাডিতে পরিণত হয়েছে, যা খুব কম অর্থনীতিবিদই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়, তখন অনেকেই এটিকে আকস্মিক সৌভাগ্য বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে, বাংলাদেশ প্রতি বছর পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সফল যাত্রা একটি ভালো উদাহরণ এবং মাত্র দুই দশকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং গত ২০ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাকিস্তানের আড়াই গুণ।
নিবন্ধে বলা হয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক রক্ষণশীল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে ৫৬ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ১২০তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সমান স্কোর নিয়ে ভারত ১২১তম অবস্থানে এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৫২তম। এমিলিয়া ফার্নান্দেজ বলেন, বৈশ্বিক শান্তি সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’র (আইইপি) প্রকাশিত সর্বশেষ গেøাবাল পিস ইনডেক্সে (জিপিআই) দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে এবং সে সময় প্রতিটি অর্থনৈতিক সূচকে ভারত ও পাকিস্তান এগিয়ে ছিল। আজ ৫০ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকে ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এটাই স্বাধীনতার মহান অর্জন।
মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর জেমস ফস্টার লিখেছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাষ্ট্র। এটি দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এমনকি ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষেরও সম্মুখীন হয়েছিল। এরপর স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরেই ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছুই হতে পারে না। দেশটি গত এক দশক ধরে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কোভিড মহামারি সত্ত্বেও এর অর্থনীতি বার্ষিক ছয় শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা সেই সময়ে সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ এখন ২০৩১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। অর্থনীতিতে এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সরকারি খাতে ব্যাপক ব্যয় এসেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ক্রমেই এগিয়ে চলেছে।
২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে এমন জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়াও স্থান পাবে এই তালিকায়। দেশের বাজারের আকার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ইলেকট্রনিক ভোগ্যপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, টেলিযোগাযোগ, নবায়নযোগ্য জ¦ালানির কথা বলা হয়েছে। বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে কোন দেশগুলো চীনের বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হতে পারে, তাদের নিয়ে একটি ক্রমতালিকা করেছে ইআইইউ। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৩ সালের একই ক্রমতালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫২তম।
আমেরিকার নিউইয়র্কভিত্তিক অন্যতম সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল (৩ মার্চ, ২০২১) বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির ‘বুল কেস’ হিসেবে অভিহিত করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে পত্রিকাটি বলেছে, বাংলাদেশের রপ্তানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামে যে উন্নয়ন মডেল দেখা গেছে, তার সবচেয়ে কাছাকাছি মনে করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। নিউইয়র্কভিত্তিক আরো কটি আন্তর্জাতিক খ্যাত সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ (৫ জুন, ২০২১) শিরোনাম দিয়েছে, ‘বাংলাদেশ ইজ অন দ্য রাইজ।’
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। অবশেষে তা আলোর মুখ দেখতে শুরু হয়েছে। ‘সবার আরো ভালো ও একটি উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সম্প্রতি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হলো। এ ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো দেশের ১৮ বছরের বেশি বয়সি নাগরিকদের এর আওতায় নিয়ে আসা।’ ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি। এতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কমেছে প্রকৃত আয়। উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা বিদ্যুৎ ও জ¦ালানিসংকট। উৎপাদন কম হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো হিমশিম খাচ্ছে ডলার নিয়ে। সরকারের আয়ও কম। ফলে ভর্তুকির বরাদ্দও বাড়াতে পারছে না। দেশের মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে এর হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস হলো ২০২৩ সালে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ হবে।
গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেলে অল্প অল্প করে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর খানিকটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আর তাতেই ডলারের দর গিয়ে ঠেকেছে ১১০ টাকায়। বর্তমানে দেশের অনেক ব্যাংকই তীব্র ডলার সংকটে ভুগছে। ডলার সংকটের কারণে দেশের আমদানি হ্রাস পেয়েছে, এমনকি ব্যাংকগুলো তাদের স্বীকৃত বিল পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
আগস্টে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। গত বছরের তুলনায় এবারের আগস্টে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডলারের রেটসহ প্রচলিত কারণের বাইরে এই সময়ে নির্বাচনের আগে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স কমছে। যারা অর্থ পাচার করছেন, তারা সংঘবদ্ধ হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে প্রবাসী আয় বেশি রেট দিয়ে প্রবাসেই নিয়ে নিচ্ছেন। সামনে তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমার আশঙ্কা করছেন তারা। আর এর ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমেছে ১১ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের গতি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম বলে লেনদেনের ঘাটতি এখন রেকর্ড পরিমাণ।
দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ হু-হু করে বাড়ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাস্তবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। কেননা, ব্যাংকগুলো ৫৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করেছে। এগুলোও খেলাপি। তাছাড়া ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম, অর্থ লোপাট ও সুশাসনের অভাবের কথাও শোনা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। কিন্তু তরুণদের একটি বিশাল অংশ বেকার জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসাবে গত এপ্রিল-জুন ২০২৩ সময়ে সব মিলিয়ে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ। প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত চাকরি পাচ্ছে না। ফলে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা বিরাজ করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি মিলছে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকের উন্নতি ঘটলেও বেকারদের লাইন ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা শক্তিশালী ও স্থিতিশীল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ হতে হবে, প্রয়োজনীয় জনবল থাকতে হবে এবং আর্থিক খাত, ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামো শূন্যতা পূরণের মতো খাতগুলোতে উদ্ভাবনী সংস্কার করতে হবে। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ও একটি টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্ব^জনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি-বিদেশি গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের সুশাসনের বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। দেশের উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন এর সুবিধা দেশের প্রান্তিক থেকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে।

এম এ মাসুম : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়