ইউরোপীয় কাউন্সিল : জাতিসংঘ ‘অথর্ব ও খোঁড়া’ হয়ে গেছে

আগের সংবাদ

পাল্টাপাল্টি আল্টিমেটাম! : বিএনপিকে ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম আ.লীগের, ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে খালেদার মুক্তি চায় বিএনপি

পরের সংবাদ

উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতে আগ্রহ কেন?

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইদানীং দেশে কোনো কিছুর সংকট দেখা দিলে তা দূর করতে আমদানিতে ঝুঁকছে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এই প্রবণতা দিন দিন বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। কেন সংকট, সংকট কাটিয়ে ওঠার কৌশল বা উপায় কী হতে পারে কিংবা দেশে সংকটকৃত দ্রব্যের উৎপাদনের অতিদ্রুত ব্যবস্থা কীভাবে করা সম্ভব, সেই দিকে হাঁটতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না বা কেউই হাঁটতে চাইছে না, বরং আমদানির দিকে সংকট কাটাতে মনোযোগ বেশি। উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতে জোর বেশি, আপাতদৃষ্টিতে সেটাই মনে হচ্ছে। এক কথায়, আমদানিতে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ বেড়েছে। বর্তমান আর্থিক সংকটকালে এই আমদানিনির্ভর মানসিকতা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে জনমনে অনেক সংশয় ও প্রশ্ন থাকলেও তোয়াক্কা করছে না তারা। সবসময় আমদানিতে আগ্রহ থাকলেও এখন যেন বেশিই ঠেকছে। আমদানিতে এই অতি আগ্রহের পেছনকার কারণ হিসেবে অনেকে মনে করে, আমদানিতে কমিশন-বাণিজ্যের অনেক সুযোগ থাকে। মধ্যস্বত্বভোগীরা হৃষ্টপুষ্ট হয়। এই শ্রেণির মানুষের বেশ ভালো লাভ হয়, স্বার্থ উদ্ধার হয়। কে হাতছাড়া করতে চায় এই সুযোগ কিংবা স্বার্থ? কেউই নয়।
কী না আমদানি করা হলো এই দেশটায়। শস্য-শ্যামল আর কৃষিনির্ভর দেশের অস্তিত্ব কোথায় থাকছে এই আমদানিতে, কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না। ঘরের আঙিনায় লাগানো গাছ থেকে কাঁচামরিচ নিয়ে খাওয়া মানুষগুলোর জীবনের অভ্যাস বদলে যাচ্ছে। কেউ কি ভেবেছে কখনো যে, কাঁচামরিচ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। কাঁচামরিচের নিজস্ব ঝালের চেয়েও দামে তার অতিরিক্ত ঝাল বাজারে থাকবে। ভাবেনি। কাঁচামরিচ আমদানির কথা শুনলে মনে হয়, দেশটা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। যা হোক, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, আলুর পর ডিম আমদানি করা হলো। ভারত থেকে প্রথমে ৪ কোটি ডিম আমদানি করার অনুমতি পেল চারটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ডিম আমদানি করার অনুমতি দেয়া হলো। পরবর্তীতে আরও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি করে ডিম আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ডিমের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই আমদানির সিদ্ধান্ত বলে জানা যায়। এই আমদানির বিষয়টি আমাদের ভুলতে বাধ্য করে যে, এ দেশে কখনো পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি বলে কোনো সফল শিল্প ছিল। অনেক যুবকের আয় কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। ভাবসাব দেখে মনে হয়, এই দেশের মানুষ বছরের পর বছর ডিম আমদানি করেই খেয়েপরে বেঁচে আছে। ডিমের বাজার স্থিতিশীল করে রাখার অজুহাত দেখিয়ে ডিম আমদানি করাটা যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, তা কিন্তু না বোঝার কোনো কারণ নেই। শুধু আমদানি নয়, ডিমের বাজার স্থিতিশীল করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে। ডিমের দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। বাজারে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করায় দোকান ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করা হচ্ছে। হাজার হাজার টাকা আদায় হচ্ছে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর রাঘববোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ডিমের বাজার স্থিতিশীল হয় না, হচ্ছে না।
একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘কৃষকের কাছে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণের লোকজন যায় না ক্যান? যাইয়া শুনুক, তারা কত টাকায় এইসব শস্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে, আর ব্যবসায়ীরা কত দামে বাজারে বিক্রি করে, আর ক্রেতারা কত টাকা দিয়ে কিইন্যা খায়।’ একবার একজন কৃষক বলছিলেন, তার কাছ থেকে ফুলকপি ২ টাকা পিস কিনে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। সেই ফুলকপি ঢাকার বাজারে বিক্রি হয় পিস প্রতি ৫০-৬০ টাকা। কী করে তা সম্ভব, একটু খোঁজ ও তদারকি করলে আসল খবর বেরিয়ে আসে। অথচ কেউ তা করার কথা না ভেবে বাজারে অভিযান চালায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে। এটা তো কারোর অজানা নয় যে, কৃষক তার উৎপাদিত দ্রব্য স্থানীয় বাজারে নিয়ে বিক্রি করলেও জেলা শহরে বা রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে না। এই কাজটি করে সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা, মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত দ্রব্য বিভিন্ন জেলার স্থানীয় বাজারে পৌঁছাতে বেশ কটি ধাপ পেরুতে হয় তাদের। রাতের মহাসড়কে চোখ খোলা রাখলে দেখা যাবে, এসব পণ্যবাহী পরিবহন থেকে টহল পুলিশের চাঁদাবাজির কী সাংঘাতিক তৎপরতা। তারপর যে বাজারে এসব দ্রব্য সরবরাহ করা হবে সেই বাজারে রয়েছে ব্যবসায়ী সমিতি ও স্থানীয় মাস্তান। সেখানেও চাঁদা দিতে হয়। প্রায়ই মিডিয়াতে সেই সংবাদ প্রচার হয়। কৃষকের কাছ থেকে ২-৩ টাকা করে কেনা কপি বাজারে গিয়ে কী করে সেটা ৫০-৬০ টাকা হয়, সেই রহস্য উদ্ঘাটন হলেই তো সমাধান পাওয়া যায়। অথচ সেই রহস্য উদ্ঘাটন করা হয় না। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কেবল দোকানে গিয়ে অভিযান চালায়। এই অব্যবস্থাপনায় একদিকে কৃষক যেমন তার ন্যায্যমূল্য থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঠিক তেমনি ক্রেতারা চড়া দামে সেই দ্রব্য কিনে খায়, খেতে বাধ্য হয়। খেতে হয় এই কারণে যে, এটুকু না খেলে বাঁচা সম্ভব নয়। প্রয়োজনমাফিক আয় বা স্বল্প আয়ের মানুষগুলো কখনোই বিলাসী খাবারের কথা চিন্তা করে না, করার সাহস পায় না। বাঙালির চাল, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচের কোনো বিকল্প খাবার নেই। থাকে না।
ডিম আমদানির পর একটি জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলো, কারখানা বন্ধ রেখে ৩ গুণ দামে স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অজুহাত হলো, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ। কেউ কেউ বলছে, এটা বাণিজ্য কমিশনের সুযোগ করে দেয়া। এটা বলা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, এডিস মশা নির্মূলে ব্যর্থ দুই সিটি করপোরেশন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বছরের পর বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কতই না আয়োজন, অর্থ বরাদ্দ ও প্রস্তুতি দুই সিটি করপোরেশনের। কিসসু কাজে আসেনি। উপরন্তু দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এখন রোগ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ। ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এবং স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়ায় সরকার ভারত থেকে স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে স্যালাইন উৎপাদিত হতো। আমদানি করা প্রতি ব্যাগ স্যালাইনের দাম ধরা হয়েছে ১৪৬ টাকা। অথচ দেশের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে উৎপাদিত এক ব্যাগ স্যালাইন (৫০০ মিলি) বিক্রি করা হতো ২৫ টাকায় এবং প্রতি ব্যাগ ১০০০ মিলি স্যালাইন ৪২ টাকায়। কোভিডের সময় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্যালাইন উৎপাদন শাখাটি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকান্তরে জানা যায়, বিনা খরচে স্যালাইন ইউনিট চালু করে দেয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স লিমিটেড। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানের দক্ষ প্রকৌশলীরা মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আইভি ফ্লুইড শাখা উৎপাদন সক্ষম করতে পারবে। অথচ এই বিষয়ে কোনো ভ্রæক্ষেপ বা পদক্ষেপ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। প্রকাশিত সংবাদে আরো জানা যায় যে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স লিমিটেড পাঁচ বছর ধরে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আইভি ফ্লুইড, ব্লাড ব্যাগ ও রি-এজেন্ট শাখার সব যন্ত্রপাতি স্থাপন ও কাঁচামাল সরবরাহ করে আসছিল। কোভিডের সময় এই ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। যা হোক, ভাবতে অবাক লাগে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনে না গিয়ে আমদানিতে কেন যাওয়া হলো। তবে কি কমিশন-বাণিজ্যের ছোবলেই সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা!
একটা রাষ্ট্রের উৎপাদন সক্ষমতা যদি না থাকে, উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যদি সক্রিয় ও গতিশীল রাখা না যায়, উন্নয়ন হয় কী করে? ইট-সুরকির স্থাপনা তো আর উন্নয়ন নয়। আর আমদানিনির্ভরতার পরিণতিতে যে দেশে বেকারত্ব বাড়াবে, সেই কথাই বা ভাবছি ক’জনে। যুবদের পোলট্রি প্রশিক্ষণ দিয়ে, ঋণ দিয়ে পোলট্রি শিল্প চালু করে অপরদিকে ডিম আমদানি করার মানে কী? হযবরল অবস্থা থেকে বেরিয়ে না এলে দেশটা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়