রাজধানীর ওয়ারীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শ্রমিকের মৃত্যু

আগের সংবাদ

মুখে স্বস্তির ভাব, মনে উদ্বেগ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড়

পরের সংবাদ

ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ধোঁয়াশা : নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বা পরিচয় জানায়নি > আ.লীগ-বিএনপি চাপাচ্ছে একে অন্যের ঘাড়ে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জুজুর ভয় দেখিয়ে আসছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে অবশেষে ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে দেশটি। তবে কাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কতজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কতদিনের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা- এমন অনেক প্রশ্নেরই জবাব মেলেনি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এই নীতি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক নির্বাচন ক্ষুণ্ন করছেন, এমন যে কোনো ব্যক্তির ওপর এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সংগঠনের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা থেকে বিরত রাখতে সহিংসতা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া বা মতামত প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীলসমাজ বা গণমাধ্যমের ওপর পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেয়ার কারণে এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এমন বক্তব্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারপক্ষ বলছে- অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। ফলে এই নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্য নয়। অন্যদিকে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি বলছে, সরকারের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীনদের জন্যই এটি চিন্তার বিষয়। অবশ্য সবকিছু নির্ভর করবে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে; নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে- এর ওপর। এমন মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে ভিসানীতি ঘোষণা করেছিলেন। তখন বাংলাদেশ সরকার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, ভিসানীতি যেন বস্তুনিষ্ঠতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। যুুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, সরকার ও বিরোধী- সব পক্ষের জন্যই ভিসানীতি প্রযোজ্য হবে। এর ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারী বাংলাদেশিদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক বিবৃতিতে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি ও বিরোধী দলের যেসব সদস্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে খাটো করার চেষ্টা করছে, তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। তবে ওই ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
যখন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মানবাধিকার রক্ষায় নামে চাপ সৃষ্টি না হয়- বিশ্ববাসীর প্রতি এমন আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিকস সম্মেলন, জি-২০ এর বৈশ্বিক সম্মেলনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য যখন আলোচিত; তখন নির্বাচনের তিন মাস আগে কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা সব মহলে আলোচনার ঝড় তুলেছে। এই নিষেধাজ্ঞাকে তাদের পক্ষে নিয়ে যুক্তি তুলে ধরছেন রাজনৈতিক দুই প্রতিপক্ষই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার রাতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণায় বিরোধীদের কথাও বলা হয়েছে। ভিসানীতির একটি সুবিধা হলো- এবার তারা (বিএনপি) জ্বালাও-পোড়াও করতে পারবে না। এতে জনগণের জীবন বাঁচবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপির বিরুদ্ধে ভোটকেন্দ্র পোড়ানো, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ভিসানীতির কারণে এবার তারা হয়তো এতদূর যেতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিসানীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে টার্গেট করলে কিছু বলার নেই। তবে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন বানচালের চেষ্টার বিষয়েও সতর্ক করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা দেশের বাইরে থেকে যেন না হয়। এটি হলে বাংলাদেশের জনগণই তাদের ‘স্যাংশন’ (যারা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে) দিয়ে দেবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা সৃষ্টি করবেন তারাই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাইলেও বিরোধী দল নির্বাচন হতে দেবে না বলে হুমকি দিচ্ছে। যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি- এটা ভালো। কারণ, সরকার বলছে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে, আর বিরোধী দল বলছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আওয়ামী লীগের কিছু যায় আসে না উল্লেখ করে দলটির নেতারা বলেছেন, বাঙালিকে জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে বিএনপিই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। রক্তচক্ষু আওয়ামী লীগকে দেখিয়ে লাভ হবে না। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, প্রভুত্ব চাই না। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম

বলেন, জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আমেরিকা যাব না। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথে থাকবে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে বিএনপিই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কোনো দল বা ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে আসন্ন নির্বাচনের যারা অন্তরায় হবে, নির্বাচন যারা বাধাগ্রস্ত করবে এবং নির্বাচন পণ্ড করার চেষ্টা করবে- তাদের জন্য এই ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের সদস্যদের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র ভিসা বিধিনিষেধের যে কথা বলেছে, এ নিয়ে বিএনপি চিন্তিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন দলটির নেতারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, সরকারের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীনদের জন্যই এটি চিন্তার বিষয়। এজন্য সরকারকে এককভাবে দায়ী করেছেন তারা। এই ঘটনাকে বাংলাদেশের জন্য ‘অপমানজনক ও লজ্জাজনক’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গ্রপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানারকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।
তালিকায় কারা? : মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কাদের বিরুদ্ধে আরোপ হয়েছে- এ নিয়ে নানা গুঞ্জন আছে। সংখ্যা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছি- এ নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেয়া হবে, তাদের নাম আমরা প্রকাশ করব না। সাক্ষ্যপ্রমাণ ভালোভাবে পর্যালোচনা করার পর আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, সরকারের কতজন মার্কিন ভিসানীতির আওতায় পড়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সংখ্যাটি খুব বড় নয়। সরকারের কেউ যদি ভিসানীতির শিকার হন এবং তাতে যদি সরকারের কার্যক্রমে বিঘœ ঘটে তবে তারা অবশ্যই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলবেন।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, যদি তারা এই নীতিতে অটল থাকে তাহলে নির্বাচনে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তারা বলেছে, শান্তিপূর্ণভাবে, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দেবে তাদের ক্ষেত্রে এই ভিসানীতি আরোপ করা হবে। আমরা নাগরিক হিসেবে দেখতে চাই, শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচনে কারা কারা বাধার সৃষ্টি করে এবং যারাই করবে, সেটি সরকারি কিংবা বিরোধী দল হোক সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি কার্যকর হয় কিনা? যদি কার্যকর হয়, তাহলে প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, দলমত নির্বিশেষে নৈর্বিত্তিকভাবে তারা যদি এটি প্রয়োগ করে তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এই অর্থে যারা বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করবে তারাই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও কর্মসূচির কোনো সুযোগ থাকবে না। বিরোধী দল যদি এসবের আশ্রয় নেয়, তাহলে তারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে কিনা? অন্যদিকে সরকারি দল যদি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করে, প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করে তাহলে তারাও এর আওতায় পড়বে। কাজেই সবাই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। সবকিছু নির্ভর করবে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে নাকি মুখ দেখে দেখে করবে, এর ওপর।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশ সরকার সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন করার পক্ষে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এছাড়া দেশের মানুষ ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজে আসবে না।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার খুব একটা প্রভাব পড়বে না। আগে থেকেই জানা ছিল। এখন শুধু ঘোষণা দিল। কোনো কোনো সূত্রে কিছু নাম জানা যাচ্ছে, কিছু ব্যক্তির নাম তারা চিহ্নিত করেছে। তবে নাম জানাবে না কাউকে। যখন কেউ ভিসার জন্য আবেদন করবে, না পাবে, পাবলিকলি কথা বলবে- তখন আমরা জানতে পারব। যে কোনো সময় যে কাউকে ভিসা না-ই দিতে পারে, এই অধিকার তাদের আছে। তিনি বলেন, এতে খুব একটা ক্ষতি হয়েছে তা নয়। সমস্যা হবে এমনটিও নয়; তবে এটি বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়। নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেউ কেউ সতর্ক হবে। এটি ইতিবাচক দিক। তারা চায়, বাংলাদেশ সরকার যে ঘোষণা করেছে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন করবে, সে ব্যাপারে তারা সহযোগিতা করতে চায়। তবে এভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সহযোগিতা করাটা বন্ধুসুলভ আচরণ হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়