গভর্নরের সঙ্গে আইএমএফের বৈঠক : ভবিষ্যদ্বাণী মডেলে নিরসন হবে অর্থনৈতিক সংকট

আগের সংবাদ

ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ধোঁয়াশা : নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বা পরিচয় জানায়নি > আ.লীগ-বিএনপি চাপাচ্ছে একে অন্যের ঘাড়ে

পরের সংবাদ

পরিকল্পনা কমিশন : প্রতিষ্ঠান নির্মাণ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭২ সালের শুরুতেই প্রতিষ্ঠিত হলো পরিকল্পনা কমিশন। এর ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যথার্থই পাকিস্তানি স্টাইলে নিজ পদের জন্য পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা নিশ্চিত করলেন এবং উদারভাবে আরো তিনটি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা তিনজন সদস্যের জন্যও আদায় করে নিলেন। এ সময় নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ নিয়ে অধ্যাপক ইসলাম বিস্তারিত লিখেছেন : সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো ছাড়াও সরকারের বাইরের বিভিন্ন পেশার এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার পেশাদার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হলো, অবসরপ্রাপ্ত কজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আওতায় নির্ধারিত সময়ের জন্য সম্পৃক্ত করা হলো। আমি বলার স্পর্ধা রাখি যে, আমরা অত্যন্ত দক্ষ ও দেশের উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীকে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলাম। অধিকন্তু পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের আমার দুজন সহকর্মী এ আর খান এবং হাসান ইমাম পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগে যোগদান করলেন। সরকারের বাইরে থেকে পেশাজীবীদের মধ্য থেকে বিশেষজ্ঞ আনায় আমি সমালোচনার মুখোমুখি হলাম।
স্বদেশ রঞ্জন- এস আর বোসের বিষয়টি দেখা যাক। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (বিআইডিএস) কৃষি অর্থনীতিতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সিনিয়র রিসার্চ ডিরেক্টর ছিলেন। তাকে কৃষি বিভাগ কিংবা পল্লী প্রতিষ্ঠান কোনোটারই প্রধান করা হয়নি। প্রথমটির প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় এস ডি চৌধুরীকে, তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর। তিনি বিভিন্ন ধরনের সরকারি কমিশনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, স্বাধীনতা পূর্বকালে কৃষিনীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অর্থনীতির অধ্যাপক শামসুল ইসলামের বহু বছরের অভিজ্ঞতা। আমি নিজে যখন বিআইডিএস থেকে ছুটিতে বাইরে ছিলাম তখন এস আর বোসকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক করা হয়। যদিও তিনি প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কোষে অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। কোথাও কোথাও এ অভিযোগ শোনা গেছে, তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে বাদ পড়েছেন। আমি ভেবেছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে একজন জ্যেষ্ঠ যোগ্য ব্যক্তি প্রয়োজন। তাছাড়া বিআইডিএস যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। কেবল তাই নয়, বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটিতে অবদান রাখার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। ধর্মীয় বিবেচনা কখনোই আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করে তার স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এস আর বোস আমার ছাত্র ছিলেন এবং করাচির পিআইডিইতে আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। আমাদের ঘনিষ্ঠ সামাজিক জীবন ছিল। এই অভিযোগে আমিই বরং ব্যথিত হলাম। ১৯৭৩ সালে বোস বিআইডিএসের একটি ফেলোশিপ নিয়ে তিনি এক বছর যুক্তরাজ্য অবস্থান করে বিশ্বব্যাংকে যোগদান করেন। তিনি যখন দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমি অবাক হলাম এবং আরো অবাক হলাম যখন চলে যাওয়ার কারণ জানালেন। তার বেলায় কারণ হচ্ছে তার মোহভঙ্গ ঘটেছে, কারণ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
দেশ এর মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে গেছে এবং তার মতো অনেকেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তিনি পরিবেশ নিজের জন্য স্বস্তিকর মনে করেননি এবং দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
বিদেশে অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্য থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করতে গিয়ে আমি সমস্যার মুখোমুখি হই। তারা বিভিন্ন পেশার, বিভিন্নভাবে বিদেশে আগত দল। কেউ স্বল্পমেয়াদি অ্যাসাইনমেন্টে বিদেশে এসেছেন, কেউ সরকার থেকে ছুটি নিয়ে ১৯৭১ এবং তার আগে এসেছেন। ১৯৭১ ও ১৯৭২-এ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ শেষ করেছেন এমন ছাত্রও আছেন। দেশে ফেরার ব্যাপারে অনেকেরই সামান্য আগ্রহ নেই। এমনকি যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিদেশে থেকে সক্রিয়ভাবে লবি করেছেন দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে দেশসেবার জন্য দেশে ছুটে আসার আগ্রহ তাদেরও নেই। ‘অপেক্ষা করি এবং দেখি’ এমন একটা অবস্থান ছিল তাদের। এর দুটি কারণ থাকতে পারে।
একটি হচ্ছে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অনিশ্চয়তা এবং সরকারের ওপর গভীর আস্থার অভাব যে স্বাধীনতা উত্তরকালের সরকার শিগগিরই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাবে। তাদের আরেকটি উদ্যোগ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিপর্যয় ও পরিবর্তন। স্বাধীনতার আগে তারা যে জীবনমান বজায় রাখতে পারতেন পরে এই সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তারা অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করতে সম্মত ছিলেন না, বিশেষ করে বিদেশে এসে তাদের অনেকেই বিকল্প চাকরির সুযোগ দীর্ঘ সময়ের জন্য না হলেও অন্তত সে সময়ের জন্য করায়ত্ত করে রেখেছিলেন- এ সুযোগ ছেড়ে আসতে চাননি।
এমন একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যর্থতা হচ্ছে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য বিদেশে অবস্থানরত এ এম এ মুহিতকে সরকারি চাকরির জন্য আকৃষ্ট করা। তার চাকরি জীবনের শুরু থেকেই আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে তিনি যখন পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি তখন ঘনিষ্ঠতা আরো নিবিড় হয়। ১৯৭১-এর নির্বাসিত জীবনে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় আমি বহুবার তার সঙ্গে দেখা করেছি। ১৯৭১-এর আগস্টের কোনো এক সময় তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে যখন যোগ্য জ্যেষ্ঠ সিভিল সার্ভেন্টের তীব্র অভাব এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া অফিসারদের তখনো ফিরতে অনেক বাকি আমি তাকে ফিরে এসে চাকরিতে যোগ দেয়ার জন্য রাজি করাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করি। কেবল আমি নই, কমিশনে যারা তার বন্ধু ও গুণমুগ্ধ তারাও চেষ্টা করেছেন যেন তিনি ফিরে আসেন এবং প্রশাসনে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ করে। যদিও এই পদে যোগদানের জন্য মতিউল ইসলামকে নিয়োগ করা হয়, এ এম এ মুহিতকে করা হয় বাংলাদেশের পক্ষে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক। তখনকার অর্থমন্ত্রী এবং এ ধরনের পদায়নের জন্য সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত তাজউদ্দীন আহমদকে আমি অনুরোধ করি যেন তিনি এ এম এ মুহিতকে বিদেশে না থেকে দেশে এসে চাকরিতে যোগ দিতে অনুরোধ জানান। কেউ বলতে পারেন আমি মুহিতের দেশে না ফেরার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করছিলাম। আমরা কমিশনের সবাই মিলে মুহিতকে অনুরোধ করেছিলাম তিনি কমিশনের যে পদে আসতে আগ্রহী তাকে সে পদেই গ্রহণ করা হবে। অবশ্যই আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল তিনি যেন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব এবং বৈদেশিক সহায়তার দর-কষাকষির জন্য বহিঃসম্পদ বিভাগের দায়িত্বে থাকেন। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর এই পদটি সায়েদুজ্জামান গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে মুহিত অর্থ সচিব কিংবা অন্য কোনো জ্যেষ্ঠ পদও চাইতে পারতেন।
কমিশনের গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কেবল অর্থনীতিবিদদের কেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করা হয়েছে। বিজ্ঞানী কিংবা প্রকৌশলী নেই কেন? অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তাদের সদস্য না করার জোরালো কারণ দেখিয়েও তার অবস্থান থেকে সরে এসে বলেছেন অর্থনীতিবিদ নন এমন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলে কমিশনের গণমুখী ইমেজ ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যেত। ‘শেখ মুজিবকে আমার এই বিবেচনায় পরাদর্শ দেয়া উচিত ছিল, এটা আমার দিক থেকে ভ্রান্তি।’
কিন্তু প্রশাসকরা কেন বাদ পড়লেন? এটাও বস্তুত একটি গুরুত্বপূর্ণ বাদ পড়া। শুরুতেই এটা স্বীকার করা হয়েছে। যেহেতু সিভিল অফিসাররাই সরকারের বাকি সব কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকেন তাদের সহযোগিতা আবশ্যক। তার অনুসন্ধানও চলেছে বলে অধ্যাপক ইসলাম লিখেছেন। তার ভাষ্য : একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল অফিসারের প্রয়োজন ছিল, কারণ বিধান অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হবেন ‘রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত’, তার মর্যাদা প্রতিমন্ত্রীর, কাজেই কর্মরত সিভিল সার্ভেন্টের সেখানে সুযোগ নেই। তাছাড়া এই পদপ্রার্থীকে অবশ্যই যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ সিভিল সার্ভেন্ট হতে হবে, যেন কর্মরত সিভিল সার্ভেন্টদের কাছে তিনি শ্রদ্ধাভাজন হন; তার আদেশ তারা মানেন এবং প্রশাসনের সর্বত্র প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেন।
পছন্দ ছিল চাকরি থেকে নির্ধারিত সময়ের আগে অবসর নেয়া শামসুর রহমান (সিএসপি, বন্ধুমহলে ডক্টর জনসন নামে পরিচিত), শেখ মুজিবের বিশেষ পরিচিত। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তার সঙ্গে অভিযুক্ত ছিলেন। আমি রহমানকে রাজি করাতে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং প্রয়োজনীয় চাপও প্রয়োগ করি। যখন শেখ মুজিবের অনুমোদন গ্রহণের জন্য তার কাছে গেলাম তিনি জানালেন তাকে এর মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছেন। তার এই ঘোষণায় আমি অবাক হই। সেসব দিনগুলোতে শেখ মুজিবের কথা কদাচিৎ অমান্য হতো, কারণ তার কথা মান্য করাই ছিল দেশপ্রেমিকের কাজ। চাহিদামতো আর কোনো সিভিল সার্ভেন্ট সহজে পাওয়া গেল না অর্থাৎ যুগপৎ সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ও অবসরপ্রাপ্ত না হলে বিকল্প হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের মতো রাজনৈতিক পদে যোগদান করার জন্য সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করতে সম্মত এমন কেউ- এতে সিভিল সার্ভেন্টের কর্মজীবনের সম্ভাবনা বলি দিতে হতো। জ্যেষ্ঠ সিভিল সার্ভেন্টের মধ্যে যারা সদস্য পদের জন্য যোগ্য হতেন তারা পাকিস্তানে আটকা পড়ে আছেন। শেষ পর্যন্ত একজন ডেপুটি চেয়ারম্যান ও তিনজন সদস্য নিয়ে কমিশন যাত্রা শুরু করল। তাদের সবাই অর্থনীতিবিদ।
তবে ১৯৭৪ সালে সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট এ কে এম আহসান পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসিত হলে তিনি কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হলেন। পূর্বতন তিনজন সদস্য অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান এবং অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনজনের কনিষ্ঠতম আনিসুর রহমান সম্পর্কে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মূল্যায়ন কৌতূহলোদ্দীপক। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন, মোশাররফ হোসেন এবং রেহমান সোবহানের সম্বন্ধে আমার যেমন দীর্ঘদিনে সামাজিক ও পেশাগত সম্পর্ক আনিসুর রহমানের সঙ্গে ঠিক তেমনটা নয়। আমি যদি সঠিকভাবে তাকে বুঝে থাকি তাহলে তিনি নিজেকে একজন আইডিয়ালিস্ট বিবেচনা করতেন এবং বিশ্বাস করতেন দরিদ্রদের স্বার্থে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিবেদিত হতে হবে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। তবে মনে হচ্ছিল তিনি এটা বিশ্বাস করতেন যে, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার ব্যাপারে সে সময়কার সরকার খুব কার্যকর কোনো হাতিয়ার নয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর আত্মনিবেদিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে ছোট মাপের উন্নয়ন পরিকল্পনা ধারণ ও বাস্তবায়ন করে অনেক কাজ করা সম্ভব হবে। এ ধরনের উদ্যোগের সমষ্টি শেষ পর্যন্ত সরকারকে সঠিক উদ্যমে সঠিক দিকে সাড়া দিতে সক্রিয় করে তুলবে। আনিসুর রহমানের যে সমাজ দর্শন আমি তারই ব্যাখ্যা দিলাম। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
এরই প্রেক্ষাপটে আনিসুর রহমানের একটি প্রস্তাবের কথা আমার মনে পড়ছে। দেশে সর্বব্যাপী দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে তিনি চেয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ কৃচ্ছ্রতার জীবন অবলম্বন করুন। মন্ত্রী ও সরকারের কর্মকর্তা এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা কৃচ্ছ্রতা অবলম্বনের মাধ্যমে আদর্শ সৃষ্টি করবেন। যেমন তিনি চেয়েছেন গাড়িতে না চড়ে তারা বাইসাইকেলে অফিসে আসা-যাওয়া করবেন, দাপ্তরিক অন্য কাজেও বাইসাইকেল হবে তাদের বাহন। ততটা সিরিয়াসভাবে না হলেও আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি যারা বাইসাইকেল চালাতে জানে না তারা অফিসে যাবে কেমন করে? যেমন আমি নিজে সাইকেল চালাতে জানি না। আমার বয়স যখন তিরিশের ঘরে আমি শেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তিনি পরামর্শ দিলেন যারা জানেন না তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। একমাত্র ব্যতিক্রম হবেন প্রধানমন্ত্রী, তিনি একটি ছোট টয়োটা কার ব্যবহার করতে পারবেন। নিরাপত্তার জন্য তাকে এই গাড়িটা দেয়া হবে। আনিসুর রহমান চেয়েছেন এই প্রস্তাবটি পলিসি প্রপোজাল হিসেবে পরিকল্পনা কমিশন মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হোক। এ নিয়ে আমি কমিশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতিতে এটাকে বড্ড অবাস্তব নীতি বলে মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার কেবিনেটের সহকর্মীরা স্পষ্টতই ভেবে বসবেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা তাদের সময় কাটাতে যে প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে তা তাদের চপলতা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সিরিয়াসভাবে না নেয়ার প্রবণতা প্রকাশ করে। সুতরাং পরিকল্পনা কমিশন থেকে এই পরামর্শ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়নি। ঠিক হয় একে কমিশনের প্রস্তাব না বলে আনিসুর রহমানের প্রস্তাব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে।
প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব পেয়ে আনিসুর রহমানকে তার কাছে পাঠানোর জন্য আমাকে বললেন। প্রধানমন্ত্রী ও আনিসুর রহমানের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। কী আলোচনা তাদের মধ্যে হয়েছে তা জানার উদ্যোগ আমি যেমন নিইনি তিনিও কখনো তাদের আলোচনার প্রকৃতি আমাকে জানাননি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন আনিসুর রহমানের বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে এবং এর সমাধান হয়েছে। তিনিও আমাকে তাদের আলোচনার বিষয় অবহিত করেননি। তবে এই প্রস্তাবের কথা পরে আর শুনিনি।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মেকিং অব অ্যা নেশন : বাংলাদেশ, অ্যান ইকোনমিস্ট’স টেল কুড়ি বছর আগে ২০০৩ সালে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত প্রকাশিত হলে পরিকল্পনা কমিশনের জন্য এ এম এ মুহিতকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তার উদ্যোগ এবং এ এম এ মুহিতের অনাগ্রহের বিষয়টি আমার মতো অনেকেরই জানার সুযোগ হয়। তারও অনেকদিন পরে এ এম এ মুহিতকে তার না ফেরার কারণটি জিজ্ঞেস করার সুযোগ আমার হয়। তিনি তার স্বভাবসুলভ আমুদে মেজাজে বললেন, ‘প্রফেসর ইসলাম হিমসেল্ফ ওয়াজ ওয়ান অব দ্য রিজনস’। তিনি আর এর ব্যাখ্যা দেননি, উত্তরটি পর্যাপ্ত মনে করে আমিও এর বেশি কিছু জানতে চাওয়া সমীচীন মনে করিনি।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়