ডেমরায় পুলিশের অভিযান, গুলিতে যুবক আহত

আগের সংবাদ

ডিমের বাজারে মুনাফার থাবা : ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন, আমদানি করা ডিমে চাহিদা মেটাবে মাত্র একদিনের

পরের সংবাদ

আলুতে গোলমাল : তালগোলে রাজনীতি-কূটনীতি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অনাকাক্সিক্ষত অস্থিরতা সবখানে, সবদিকে। কোনটা আরোপিত বা তৈরি করা বা যৌক্তিক- তা বলার অবস্থা নেই। এ সুযোগে যে যা পারছেন, করে ছাড়ছেন। মন যা চায় বলে দিচ্ছেন ফ্রি-স্টাইলে। কথার নামে কুকথার এখানে অন্তহীন স্বাধীনতা। অথচ ডেঙ্গুতে প্রতিদিন কত মানুষ মারা পড়ছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বজনের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে কতজন সর্বহারা হচ্ছেন- এসব প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। এর চেয়ে ‘উন্নয়নের ফিরিস্তি’ আর ‘গণতন্ত্রের বয়ান’-এ বাজার গরম। যুক্তরাষ্ট্র কাকে সাপোর্ট দিল, ভারত কী বলছে, কার মামলা ঠেকাতে কে চিঠি দিল, কে প্রতিবাদ জানাল- এসব সংবাদের বাজার বেশি চড়া। খবরের এমন বাজারের মধ্যে রাজনীতির হাটে নয়া নিশান উড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি।
অক্টোবরের মধ্যে তারা এসপার-ওসপার দিতে চায়। ২০১৩ সালে দেয়া তাদের টানা অবরোধ আজতক সমাপ্ত বা স্থগিত করেনি। এর মাঝে হরতাল বাদে মানববন্ধন, লংমার্চ, ঢাকা চলো, বিভাগীয় সমাবেশসহ কোমল-কুসুম আন্দোলনের সবই করেছে। অবশেষে যোগ হয়েছে রোডমার্চ। শুরুটা হয়েছে রংপুর টু দিনাজপুর দিয়ে। আচরণ ও কথায় ওজনদার হিসেবে খ্যাত দলের মহাসচিব রংপুরে বলেছেন, তাদের রোডমার্চ শেষ হবে সেদিন, যেদিন সরকারের পতন ঘটবে। সেই দিনটি কবে বা কোন ঈদের পরে- এমন একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এতে কেয়ার করছে না। স্পষ্ট করে দেশি-বিদেশি সবার বোঝার মতো করেই জানিয়ে দিয়েছে- নো রেজিগনেশন, নো কেয়ারটেকার। সরকারের তরফে নির্বাচন বা গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে বেশি সামনে আনা হচ্ছে। মিনিমাম ডেমোক্রেসিতে মেক্সিমাম ডেভেলপমেন্টের সূত্র তারা বহু আগেই দিয়ে রেখেছে। যে কারণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বললে তারা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ নানা মেগা প্রকল্প দেখিয়ে দেয়। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, তারা ভালো নির্বাচন উপহার দিতে চান তাদের দলের অধীনেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন তিনি আস্থা রাখতে চান।
বিএনপি আর এসব শুনতে নারাজ। এসব করে সরকার ২০১৪, ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করে নিতে চায় বলে তাদের দৃঢ় ধারণা। সেই নমুনাও দেখছে তারা। কয়েক ওসি-ডিসি কাণ্ড তাদের এই ধারণাকে আরো পোক্ত করে দিয়েছে। যেই উপলব্ধি থেকে বিএনপি নেতারা বলতে শুরু করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও এই প্রশাসন দিয়ে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যা শুধু সরকার নয়, নির্বাচন কমিশনের জন্যও একটি বার্তা। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন ঠেকাতে পারবে কি পারবে না, তা আরেক প্রশ্ন। সরকারের পক্ষে যে ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন তুলে আনার পরিবেশ নেই, তাও অনেকটা স্পষ্ট। এরপরও দেশি-বিদেশি কাউকে তোয়াক্কা না করে রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণ বা দমনের শক্তিতে সরকারের সক্ষমতা প্রমাণিত হলেও নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এরই মধ্যে সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। কথিত সিন্ডিকেট সরকারকে শুধু চ্যালেঞ্জ নয়, বিপজ্জনকও হয়ে উঠেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা সরকারের চেয়েও বেশি সক্ষমতার জানান দিচ্ছে।
এর লাগাম টানতে সরকার চেষ্টার কমতি করছে না। কিন্তু পেরে উঠছে না। সবশেষে ডিম-আলু-পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয়ার রেকর্ড তৈরি করেছে সরকার। যা এর আগে কখনো হয়নি বাংলাদেশে। সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্যমন্ত্রী প্রতি কেজি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা, আলু কেজিতে ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা, কোল্ড স্টোরেজ থেকে ২৬-২৭ টাকা, ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি পিস ১২ টাকা বেঁধে দেন। কিন্তু বেঁধে দেয়া দামে বাধা যায়নি ব্যবসায়ীদের। আলুর কেজি বাস্তবে ৫০ টাকা। পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার ওপরে। সরকার যখন দাম বেঁধে দেয় ব্যবসায়ীরা তখন মুখ টিপে হাসে। কারণ তারা এর শানেনুযুল জানে।
বাজারে আলুর কেজি ১৫ দিন আগেও ছিল ৪০ টাকার নিচে। সরকার দাম বেঁধে দেয়ায় ব্যবসায়ীরা যেন মাইন্ড করে আরো চটেছেন। ঠিক এক বছর আগে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ২৮ টাকা দরে; অর্থাৎ এক বছরে আলুর দাম ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। অথচ আলু উৎপাদনে কমতি হয়নি। মজুতে বা সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বাস্তব বুঝতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছুটে গেছেন আলুর মোকাম মুন্সীগঞ্জে। উপলব্ধিতে তিনি বলেছেন, একটি অদৃশ্য হাত আলুর বাজার অস্থির করে তুলেছে। নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা তদারকিতে বাজারে চলছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান। মূল্য তালিকা না থাকায় বা বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে টুকটাক জরিমানাও করা হচ্ছে। নানা ইঙ্গিত এবং চোখটিপ পেয়ে প্রথমে ব্যবসায়ীরা বাজারে যথেষ্ট সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও পালাপার্বণ থাকা-না থাকা নির্বিশেষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায়। সরকারের লোকজন অভিযানে নেমে দু-চারটা মুদি দোকানিকে ধরে টুকটাক জরিমানা করে, মেমো সংরক্ষণ করতে বলে, এমনকি ডাবওয়ালাকেও মূল্যতালিকা টাঙানোর আদেশ দেয়, ফুটপাতেই ফাইলপত্রসহ অফিস খুলতে বলে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএওর বরাতে খবর হলো, জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের সূচক গত আগস্টে দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। কারণ চাল ও চিনির দাম বাড়লেও এর আগের মাসে বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশ কমে যাওয়ায় সার্বিক মূল্যসূচক নিম্নমুখী রয়েছে। সারা বিশ্বে কমছে, বাংলাদেশে কেন কমছে না? প্রশ্ন করলে মুখস্থ ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর সব দায় চাপানো। ইউক্রেন যুদ্ধের সব দায় কেবল বাংলাদেশেরই। বাংলাদেশ বলেই কথা। তা এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি সবকিছু নিয়েই। ক্ষেত্রবিশেষে এক একটি ঘটনা বেশির চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে।
কূটনীতিতে তালগোল যেন আরো বেশি। এক আচানক এলোমেলো অবস্থা। দুনিয়ার বাদশাহ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন। তার নেতৃত্বে দুটো গণতন্ত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। নির্বাচনের আগে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে এবং সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব চাপ দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং ভিসানীতি প্রণয়ন করেছে। সর্বশেষ দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে সেলফি তোলারও ব্যবস্থা করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশে রাজকীয় সফর করে যান। কিন্তু সফর শেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ঢাকা ত্যাগ করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তোলার পাঁচ দিনের মাথায় মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতের দেয়া রায়ের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের। বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস আরেকটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, আইনটি ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে’।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে জি-২০ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন, তার একদিন পরে ভিয়েতনাম সফরের সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দেয়া বক্তব্যে সব ফিকে হয়ে যাওয়ার দশা। বাইডেন হ্যানয়ে বলেন, দিল্লিতে মোদির সঙ্গে আলোচনার সময় সুশীল সমাজ, স্বাধীন সংবাদপত্র এবং মানবাধিকারের বিষয় তিনি উত্থাপন করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না। সংবাদ সম্মেলনও করেন না। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে জো বাইডেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করতে ভারত অস্বীকৃতি জানায়। হোয়াইট হাউসের জোরাজুরি এবং ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঐতিহ্য’ রক্ষায় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সম্মতি দেন। শর্ত ছিল- দুই দেশের দুজন সাংবাদিক প্রত্যেকে দুটি করে প্রশ্ন করবেন। জি-২০ সম্মেলনেও জো বাইডেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারত রাজি হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সংবাদ সম্মেলনের ওপরই কি ভারত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল? না কি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারত রাজি হয়নি?
এত কিছুর পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুশীল সমাজ, স্বাধীন সংবাদপত্র, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের বিষয়ে ভারত এবং বাংলাদেশকে যে এককাতারে নিয়ে আসবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় (১৯৭১-৭৫) ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক এমনই ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু পরাশক্তিগুলোর দ্ব›েদ্বর কারণে অনেক কিছুই ঘটেছিল তখন। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় অনুরূপ পরিস্থিতিতে কী ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। ঘটনাচক্রে সে ধরনের কিছু ঘটে বসলে তা কোনো দলের জন্যই শুভ হবে না। বড় জোর ক্ষতি কার বেশি, কার কম হবে- এ প্রশ্ন অবশিষ্ট থাকতে পারে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়