ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ১৫ দিনে মৃত্যু হয়েছে ১৯৭ জনের

আগের সংবাদ

চিকিৎসার নামে লোক ঠকানো : অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান আজ থেকে > অব্যাহত রাখলে জনগণ উপকৃত হবে

পরের সংবাদ

সেলফি ডিপ্লোমেসি আর আমাদের প্রজ্ঞা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের বক্তব্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কিছু আলাপের সুযোগ চাচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কিছু কথা বলার ছিল জো বাইডেনকে। সেই কারণে ড. মোমেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের কাছে কথা বলার বিষয়টি জানান। তিনি রাজি হলে ড. মোমেন জো বাইডেনের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। জো বাইডেন রাজি হলে শেখ হাসিনা তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে জো বাইডেনের কাছে তার মনের কথা বলেন এবং একটি ছবি তোলার বিষয়ে অনুরোধ করেন। সেটা শুনেই বাইডেন নিজেই সেলফি তুলে নতুনমাত্রা যোগ করেন সেলফি ইতিহাসে। এই দৃশ্য গোটা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। আর বাংলাদেশের শিক্ষিত সচেতন ও রাজনীতিকরাও দেখেছেন। কেউ কেউ আপ্লুত হয়েছেন, কেউ কেউ বলেছেন বালিকাসুলভ আচরণ। আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন ইতিহাসে ডিপ্লোমেসিতে নতুন নাম যোগ হলো সেলফি কূটনীতি। বাইডেনের সঙ্গে কী কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। সেরকম কোনো প্রশ্ন দেখিনি। তাদের লক্ষ্য হাস্যোজ্জ্বল বাইডেন ও শেখ হাসিনা এবং কন্যা পুতুলের ছবিকেই বলছেন ইতিহাসের মোড় ফেরানোর ঘটনা। এর আগেও জো বাইডেন অনেকের সঙ্গেই সেলফি তুলেছেন। সেগুলো কোনো রকম আলোচনায় আসেনি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সেলফি কালচার এদেশের গণমানুষের কাছে নতুন অভিজ্ঞানের মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বাইডেন স্যাংশন তুলে নেবেন আর ভিসানীতি যে আরোপ করেছেন তাও হাওয়া হয়ে যাবে। যদিও মার্কিনি কর্তৃপক্ষ বলেছেন বাংলদেশের সঙ্গে তাদের দেশের নীতিগত কোনো পরিবর্তন হয়নি এখনো। চলমান যা ছিল, তাই চলছে।
বিষয়টি অনেকের কাছেই হাসির কারণ হয়েছে। তারা বলছেন তিনি বালিকাসুলভ আচরণ করেছেন। তার মনে রাখা উচিত ছিল যে তিনি যত ছোট দেশেরই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, সেই দেশের রাজনৈতিক ইনটিগ্রিটি ও সরকারের রাজনৈতিক সম্মান অনেকটাই ধূসর হয়ে গেছে। নিজের মান ও দেশের মান এক সঙ্গেই তিনি খুইয়ে এলেন দিল্লিতে। তার এটা মনে রাখা উচিত ছিল যে বাইডেন প্রশাসন র‌্যাবের ৭ জনের ওপর স্যাংশন দিয়েছে মানবাধিকার হরণের অভিযোগ তুলে। এটা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ, সন্দেহ নেই। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে বাংলাদেশের আইনি শাসনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। তারপর বাইডেন প্রশাসন কেবল বাংলাদেশের মানুষের ওপর, বিশেষ করে যারা রাজনৈতিকভাবে আগামী নির্বাচনে ভোট নিয়ে তালবাহানা করবে, পরিবেশ নষ্ট করবে, ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেবে কিংবা নির্বাচনী পরিবেশ নস্যাৎ করবে, তারা মার্কিনি ভিসা পাবে না। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আমরা ওই দূরের দেশে যাব না। পৃথিবীতে আরো দেশ আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। জনান্তিকে বলে রাখি তার এই কথার পরই মনে পড়েছে গোটা ন্যাটোভুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আমেরিকান এতে যুক্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে সেই ২৭টি দেশও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এবং আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের সঙ্গে। আমাদের ডলার আয়ের ৭০-৮০ শতাংশই আসে ওই দেশের বাণিজ্য আর প্রবাসীদের হাত ধরে। আজকে যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আমাদের বন্ধুত্ব অর্জন করেছেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের ৩ ভাগেরও কম পণ্য আমদানি করে বাংলদেশ থেকে। উল্টো আমরা আমদানি করি তাদের ৩-৪গুণ বেশি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য ৪০-৪৫ বছর ধরে চলছে। এসব ভাবনার জাল ছিন্ন করতেই বোধহয় আমাদের, তিনি একটি অভিনব সুযোগ খুঁজছিলেন কী করে তার মন্তব্যগুলো ওয়াশ করা যায় মার্কিনি মগজ থেকে। জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি সেই সুযোগই নিয়ে থাকবেন। আমার এই ব্যাখ্যা অ্যাবসুলিট কিছু নয়, অনুমান ও তথ্যগত বিচার বা ইলাবরেশন মাত্র।
জি-২০-র একজন সদস্য না হয়েও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ওই সম্মেলনে একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে। তার কর্তব্য ছিল বিশ্ব নেতাদের কথা শোনা ও অনুধাবণ করা। তাদের কথা ও আচরণের প্রতিটি বিষয় উপলব্ধি করার জন্যই তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সম্মেলনে এমন একটি কাজ করলেন, যা দেশের মানুষের সমালোচনার মধ্যে পড়লেন। তাতে তিনি ক্ষুব্ধ নন, কারণ তার লক্ষ্য তো তার ভোটার জনগণ। সেই আমপাবলিককে তিনি গেলাতে পেরেছেন যে আমেরিকার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালো। কোনো সমস্যাই নেই আমেরিকার সঙ্গে। তার দুই তুড়িতেই উবে যাবে দুটি অপমানজনক বিষয়।
আওয়ামী অন্ধজনদের বক্তব্য হচ্ছে নেত্রী বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন ডিপ্লোমেসি কাকে বলে। তা ঠিকই বলেছেন তারা। নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর কোনো তুলনা হয় না। শুধু কাবাব মে হাড্ডি হিসেবে ড. মোমেন যে কাহিনীটি ফেঁদেছেন, সেটাই কিন্তু প্রশ্নবোধক হয়ে রইল। তবে ড. মোমেন বেশ চালাকই বলা চলে। তিনি বলেছিলেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। তার সেই ডিপ্লোমেসিটি এবার বাস্তব সত্যে কি প্রমাণ হলো?
দেশ এখন সেলফি ডিপ্লোমেসিতে ভেসে যাচ্ছে।

দুই.
দেশ উন্নয়নের ধারায় যে গতি সৃষ্টি করেছে তারও অতীত তুলনা নেই। বিশেষ করে এই সরকারের মেগা সব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত খুবই ত্বড়িৎ (ত্বরা বা ত্বরিৎ, ত্বড়িৎ হরণ নয়) হওয়ায় নানা সমস্যা সংকটও হয়েছে। ডিজাইনের ভুল তো আছেই, সেই সঙ্গে অর্থ বিষয়ে প্রাক্কলনের ভুল অনেক বেশি। এই বেশিকে চাপমুক্ত করতে তিনি কোয়ার্টার বা তার চেয়ে কম পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেই তা উদ্বোধনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। মেট্রোরেল দিয়ে তার উদ্বোধনী যাত্রা। আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি ৬টি মেট্রো প্রকল্প নিয়ে ঢাকা মহানগরের যাতায়াত ব্যবস্থাকে সুমসৃণ করতেই এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই ৬টির মধ্যে ১টি প্রকল্পের কিয়দংশ নির্মাণের পর তিনি তা উদ্বোধন করেন। দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বা কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণের পর যদি উদ্বোধন হতো তাহলে যাত্রীদের সামাজিক ও কর্মজীবনের জন্য যাতায়াত অনেকটাই ভালো সুফল দিত। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই লাইনের কাজ শেষ হয়নি। তাহলে আগামী ৭ বছরে কি বাকি ৫টি লাইনের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে? এর মধ্যে একটি লাইনের বড় একটি অংশ মাটির নিচ দিয়ে যাবে।
উন্নয়নের ধারায় বাধা কী? এই প্রশ্নটি মনে হতেই পারে। কেননা, আমরা লক্ষ করেছি বিচারাধীন বিষয়ে বিশ্বের ক্ষমতাবান ও ধনী দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রশাসন আমাদের ব্যাপারে মতপ্রকাশ করছে এবং নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছে। অধিকার নামের মানবাধিকার সংগঠনের কর্মকর্তা আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার রায় হয়েছে। তার ২ বছরের জেল হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে এবং সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা গুম নিয়েও তারা প্রায় নিয়মিতই কথা বলছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করেছে। সেই বিষয়ে রিপোর্টের একটি অংশ পড়ে নিই।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে অধিকারের মামলা’ শীর্ষক প্রস্তাবটি উত্থাপন করে মধ্য ডানপন্থি, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, বামপন্থিসহ ৭টি গ্রুপ। ফ্রান্সের স্থানীয় সময় গত বুধবার রাতে এ প্রস্তাবের ওপর বিতর্কে অংশ নেন ৬ পার্লামেন্টারিয়ান। প্রস্তাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। (ব/বা ১৫/০৯/২৩)
আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কেন এত সোচ্চার, তা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের বিষয় আমরাই দেখব, এটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না। আমাদের প্রশাসন তো রাজনৈতিক সরকারের টুআইস-তে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায় কাজ করে মানবাধিকার হরণের দুর্নাম কামিয়ে চলেছে। এখন আন্তর্জাতিক সমাজের নেতারা বা তাদের পার্লামেন্ট বাংলাদেশ বিষয়ে সোচ্চার। কারণ তারা আমাদের পণ্যের ক্রেতা। তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। তারা আমাদের সমাজ ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা কোনো অভিযোগ করলে তাকে তো আর হেলা করা যায় না। কিন্তু আমরা সেগুলো ড্যামকেয়ার করে চলেছি। আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্টের এই প্রস্তাব গ্রহণ হস্তক্ষেপ। হ্যাঁ, ঠিক, হস্তক্ষেপ। কিন্তু কেন তারা এটা করল? কারণ সরকার মানবাধিকার হরণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু ব্যক্তির অতি নির্মম আচরণ যে করছে, সেই প্রেক্ষিতেই তো কথাগুলো বলেছে তারা। বিরোধী রাজনীতিকদের রাজনৈতিক অধিকার পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। সেটা প্রমাণ করতে কোথাও যেতে হবে না। পুলিশ তাদের মিছিলে হামলা করছে। পুলিশের সঙ্গে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ছেলেরাও হামলা করছে। পড়াশোনার বাইরে ওই ছাত্রদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার তো বাজে উদাহরণ। ছাত্ররা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে গৌরবজনক আন্দোলনের ইতিহাস গড়েছে, তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। সেই বিবেচনা করতে হবে। আজকের ছাত্ররা কেন রাস্তায় সরকারের পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলের কর্মীদের লাঠিপেটা করবে? তাদের বাবা-মা কি তাদের এই কাজে মহানগরে পাঠিয়েছে? নাকি লেখাপড়ার নামে তাদের রাজনৈতিক ঠেংগারে বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে? হেলমেট বাহিনী নামেও তাদের চেনা যায়। আমাদের শিক্ষা পরিবেশে যে নোংরা সংস্কৃতি ও হিংসাত্মক উপাদান জারি করা হয়েছে, তার পরিণাম তো ভয়াবহ হতে বাধ্য। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার পরামর্শ দিয়েছে, সেটা তারা দেয় কেন? তারা তো দেখেছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সরকারি দল কী রকম নির্বাচন করেছে। কথায় আছে, ঢিল মারলে তা পাটকেল হয়ে ফিরে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর পার্লামেন্ট এজন্যই তাদের মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করতে চাইছে। তারা যে আমাদের উন্নয়নের সহযোগী, সেটা ভুলে গেলে চলবে না।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়