উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিতে ২ জন নিহত

আগের সংবাদ

সতর্ক থেকেই ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ

পরের সংবাদ

পঞ্চাশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের আত্মম্ভরিতা না থাকলে ফলাফলের অর্ধেক তো অপ্রচারিতই থেকে যায়। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস পরীক্ষায় বসতে যাওয়া সুলতান-উজ জামান খানের বর্ণনাটা ভিন্ন ধরনের। বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থা, শারীরিক অসুস্থতা, পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার সুযোগের অভাব এবং অনীহা, বিক্ষিপ্ত মন তবুও মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে পরীক্ষার দু-তিন মাস আগে পাঠ্যপুস্তক জোগাড় করলেন। মাথায় অনেক কিছুই ঢুকত না, বিশেষ করে ‘লজিক’। ইতিহাস পড়তে বসে প্রমাদ গুনতাম, কারণ দুর্বল স্মৃতিশক্তির জন্য সন-তারিখের ধারাবাহিকতা মনে থাকত না। ‘লজিক’-এর ব্যাপারে আমার সহপাঠী কাজী জহিরের (পরবর্তীকালের বিখ্যাত চিত্র পরিচালক) শরণাপন্ন হলাম। সে বিষয়টি খুব ভালো বুঝত এবং অন্যকে বোঝাতে পারত… মোদ্দাকথা পরীক্ষা পাস করার ব্যাপারে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। কিন্তু পরীক্ষার ফল রীতিমতো অপ্রত্যাশিত যাকে বলে ‘ফ্লুক’-এ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি।
অপ্রত্যাশিত হলেও প্রথম বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সিংহ দরজা খুলে এই অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে আমন্ত্রণ জানাতে থাকে। তার ইচ্ছে সাহিত্য নিয়ে থাকবেন- বাংলা বা ইংরেজির অনার্স। কিন্তু শুভানুধ্যায়ীরা জানেন আর্টসের ছাত্রকে ভালো চাকরি পেতে হলে অর্থনীতি পড়তে হবে। আগের বছরের অর্থনীতি কীর্তিমানদের মধ্যে রয়েছেন এ এস এ এম কিবরিয়া (পরবর্তীকালে অর্থমন্ত্রী, আরহাম সিদ্দিকী, রকিব খোন্দকার (পরে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল) এবং আরো অনেকে। তার ক্লাসমেটদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ আর মোহাম্মদ ফারুক ভর্তি হলেন বাংলায়, নজরুল ইসলামের ইতিহাসে, এ কে এম গোলাম রাব্বানী স্ট্যাটিসটিক্সে। বিজ্ঞানের বদরুদ্দোজা চৌধুরী (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) আর ফজলুল করিম ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন। সাদেক খান আর রফিকুল ইসলাম পদার্থ বিজ্ঞান আর গণিতে অনার্সে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। অর্থনীতিতে মেধাবী ছাত্রদের ভিড়ে গড় মানের ছাত্র সুলতান-উজ জামান, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন (পরে চিফ হুইপ), কাজী জহির (চলচ্চিত্রকার)। ১৯৪৯-এর শেষের দিকে ভর্তি যখন হলেন জ্যেষ্ঠ হিন্দু শিক্ষকদের অনেকেই দেশভাগ পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে ভারতে চলে গেছেন। রয়ে গেছেন এস ভি আয়ার, মাদ্রাজি, বিভাগীয় প্রধান। ক’জন নতুন শিক্ষক যোগ দিলেন অর্থনীতি বিভাগে : ড. এম এন হুদা, আতোয়ার হোসেন, আবু নসর মাহমুদ, সা’দ আহমদ, নুরুল ইসলাম, এনায়েত করিম, আখলাকুর রহমান, মোশাররফ হোসেন, মিস অ্যালসপ; খণ্ডকালীন শিক্ষক ড. এ সাদেক, তিনি সরকারি চাকুরে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আরবির অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তার মেয়াদ শেষে এলেন ড. ওয়াল্টার জেনকিন্স।
অর্থনীতির তিনজন প্রিয় প্রভাষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। এনায়েত করিম যোগ দেন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে ১৯৫২ সালে, সা’দ আহমদ আইন ব্যবসা ও রাজনীতিতে যোগ দেন আর বামপন্থি আখলাকুর রহমানকে সরকারই চায়নি। সুলতান-উজ জামান খানের অর্থনীতি অনার্স কোর্সের প্রথম ক্লাসের শিক্ষক আবু মাহমুদ, আর এটা তার জীবনেরও প্রথম ক্লাস। তিনি অর্থনীতির তত্ত্ব পড়াতেন। তিনি অবশ্যই বিদ্বান ছিলেন, যত ভালো পড়াতেন ক্লাস নিয়ন্ত্রণে ততই ব্যর্থ। সুতরাং ক্লাসে গোলমাল হতো। কর্নেল থেকে পিএইচডি করে আসা এম এন হুদা ছিলেন সব দিক দিয়ে চৌকস, শিক্ষার্থীরা তাকে সমীহ করতেন। আতোয়ার হোসেন নম্র ও লাজুক স্বভাবের শিক্ষক, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে সদ্য পিএইচডি করে আসা। বিভাগীয় প্রধান আয়োর ডালটনের পাবলিক ফিন্যান্স মুখস্থ পড়িয়ে যেতেন, ভবতোষ বারোড়ী পড়াতেন সোভিয়েত অর্থনীতি। সে বছর (১৯৪৯) বিস্ময়কর সংখ্যক (!) ছাত্রী (সাত-আট জন) অর্থনীতিতে ভর্তি হন।
অর্থনীতির এই শিক্ষার্থী সুলতান-উজ জামান খানের যে পাঠ্যবইয়ে মনোযোগ কিছুটা কমই হবে এটা অনিবার্য। কারণ অশোক কুমার, রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, ভরত ভূষণ দেবানন্দ, নার্গিস, মধুবালা, সুরাইয়া, মীনা কুমারী গীতাবলী প্রমুখ চিত্রনায়ক ও চিত্রনায়িকার সিনেমা যখন মানসীর (তখনকার ঢাকার সেরা প্রেক্ষাগৃহ, পরে নাম বদলে নিশাত) চলত তাদের অভিনীত ছবি দেখার জন্য ‘ক্লাস ফাঁকি দিতে দ্বিধাবোধ করতাম না’। মানসীর মালিকানা তারই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ক্লাসমেট আরহাম উদ্দিন সিদ্দিকীর পরিবারের; সুতরাং বন্ধুর কল্যাণে বিনে পয়সার পাস মিলত সহজেই। যেসব স্মরণীয় ছবি বার্ধক্যেও তার মনে দোলা দেয় তার মধ্যে রয়েছে- দাগ, দাস্তান, বৈজুবাওরা, আওয়ারা, আগ, বারসাত, কালিঘাট, কার পাপে, পথে হলো দেরি, মহাপ্রস্থানের পথে ইত্যাদি।
অর্থনীতি পড়ে সাহিত্যের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সম্পর্ক ঠেকাতে তিনি সাবসিডিয়ারির জন্য পছন্দ করলেন ইংরেজি সাহিত্য, শিক্ষক হিসেবে পেলেন অমিয় ভূষণ চক্রবর্তী এবং জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে। ইংরেজি শেখার পেছনে অমিয় ভূষণ চক্রবর্তীর অসামান্য ঋণের স্বীকার তিনি করেছেন। তার দ্বিতীয় সাবসিডিয়ারি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, স্মরণীয় শিক্ষকদের মধ্যে মুজাফফর আহমদ চৌধুরী (ম্যাক, পরে ভাইস চ্যান্সেলর এবং শিক্ষামন্ত্রী), কফিলউদ্দিন মাহমুদ (পরে সিএসপি ও সরকারের সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) এবং এ কে সেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবসিডিয়ারিতে এত বেশি ফাঁকি দিয়েছেন যে হাজিরার প্রয়োজনীয় পার্সেন্টেজ না থাকায় পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। এ সময় তরুণ প্রভাষক খোরশেদ আলম এবং জি ডব্লিউ চৌধুরী (লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান গ্রন্থের লেখক এবং ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রী) তাকে উদ্ধার করেন। কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী ডক্টর নিউম্যান তখন বিভাগীয় প্রধান। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এবং মতাদর্শ বিরোধীদের প্রতি প্রতিহিংসায় তার বদনাম রটে। ‘তার নামে বদনাম রটেছিল যে চট্টগ্রামের দু’জন ধনী ছাত্র তার স্ত্রীকে মূল্যবান অলঙ্কার উপঢৌকন দিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছিল।’ তার কালে ছাত্রীদের মহিলা কমনরুম থেকে ক্লাসে আনার হাস্যকর প্রথার কথা বললেন তিনি- অধিকাংশ সময় অধ্যাপকরা নিজেরাই তাদের আগলে ক্লাসে নিয়ে আসতেন- ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীর মেলামেশা দূরের কথা ‘আলাপ ও ক্বচিৎ-কদাচিৎ হতো’, তিনি তার দু-একজন নিকটাত্মীয় নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গেও ক্যাম্পাসে কদাচিৎ কথা বলেছেন। তবুও যেসব ছাত্রী পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন : নুরুন্নাহার বেগম, খুরশিদী খানম, কুলসুম হুদা, খাদিজা খানম, কামরুন্নেসা, সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশন আরা, ফরিদা বারী মালিক, রওশন আরা বাচ্চু, হোসনে জাহান, মমতাজ লিলি খান, জোহরা রেজা, মমিমুন্নেসা, হোসনে আরা কামাল, মোসলেমা খাতুন, মোহসেনা খান পন্নী, তালেয়া রহমান, হোসনে আরা হক, জহরত আরা, রুহি ইস্পাহানি, শাফিয়া খাতুন প্রমুখ।
সে সময় পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জড়িত ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, মাহবুব জামান জাহেদী, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলউদ্দিন আল-আজাদ; সুলতান-উজ জামান নিজেও ছিলেন। প্রগতি লেখক সংঘের সদস্যদের সঙ্গেও তিনি পরিচিত ছিলেন। মুনীর চৌধুরী, সরদার জয়েনউদ্দিন, আতোয়ার রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, রণেশ দাশগুপ্ত, শাহাদতউল্লাহ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ ছিলেন এই সংঘে। নাট্যানুষ্ঠানে নারী চরিত্রে অভিনয়ে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন বাহাউদ্দিন চৌধুরী (পরবর্তীকালে পাসপোর্টেও মহাপরিচালক) কাজী ফজলুর রহমানও (১৯৫৬’র সিএসপি, সচিব এবং পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আবাসিক হলে বেশ জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। সেসব অনুষ্ঠানে অধ্যাপকদের মধ্যে আন্দালিব শাদানি, এস ভি আয়ার অমিয় ভূষণ চক্রবর্তী, এম এন হুদা, পুরনো ছাত্রদের মধ্যে বি এ সিদ্দিকী (বিচারপতি), আজিজুল হক (পরে কৃষিমন্ত্রী) ব্যারিস্টার এ টি এম মোস্তফা, এস এম আলী (ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) প্রমুখ অংশ নিতেন।
পঞ্চাশের দশকের ঢাকার সৌন্দর্য নিয়ে অনেক কথা লেখা হলেও পশ্চাৎপদতা নিয়ে খুব কম ছাত্রই লিখেছেন। সুলতান-উজ জামান খান লিখেলেন : পঞ্চাশের দশকের ঢাকা অনেক দিক থেকেই পশ্চাৎপদ ছিল। বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল খুবই ক্ষীণ। তখনো ট্রানজিস্টারের যুগ আসেনি বলে ঘরে ঘরে রেডিও ছিল না। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে আমরা এক প্রকার ‘কূপমণ্ডূক’ আবহের মধ্যে বসবাস করছিলাম।
সে সময় আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিনিধি দল, রয়াল শেকসপিয়ান নাটক কোম্পানি, বিদেশি অধ্যাপক বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের আগমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে।
‘দ্য আটলান্টিক মান্থলি’র সম্পাদক বক্তৃতা দিতে এসে মার্কিন সরকারের কমিউনিস্ট দমননীতি নিয়ে ছাত্রদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হন। ডক্টর শহীদুল্লাহ তার ভাষণ ‘দেশমাতৃকা’ শব্দ ব্যবহার করলে দৈনিক আজাদ তার কঠোর সমালোচনা করে জানায় শব্দটিতে হিন্দুয়ানির তীব্র গন্ধ রয়েছে। ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন ইকবালের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি জানিয়েছিলেন অসামান্য অবদানের জন্য তার বৃহত্তর স্বীকৃতি প্রাপ্য।
একুশের মিছিল এড়িয়ে চলেছে কথিত মেধাবী ছাত্রদের একটি বড় অংশ। যে মিছিলে গুলি চলেছে সুলতান-উজ জামান সেই মিছিলে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। সুলতান-উজ জামান লিখেছেন : ভাষা আন্দোলনের পর কালপ্রবাহ যতই এগিয়েছে, ততই আমরা লক্ষ করেছি যে নতুন ভুঁইফোঁড় কতিপয় ব্যক্তি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজেদের ‘ভাষাসৈনিক’ কিংবা ভাষা সংগ্রামের সময় অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল বলে জাহির করার প্রয়াস চালিয়েছে। দু’বছর চাচা ও বাবার বাসায় থেকে অনার্স শেষ বর্ষে ফজলুল হক মুসলিম হলে আবাসিক ছাত্র হলেন। সিঙ্গেল রুম পড়ার পরিবেশ বেশ ভালো। এমএ পড়ার সময় স্থানান্তরিত হলেন মেইন হলের এক্সটেনশনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে আধুনিক বইপত্র তেমন ছিল না, প্রয়োজনীয় পত্রপত্রিকা জার্নালেরও অভাব। উদ্যোগী ছাত্রদের সহায় ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল আর ইউএসআইএস লাইব্রেরি। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ধারাটি অনুসরণ করত বলে তার মনে হয়েছে তা ছিল ধ্রæপদ ও নব্য ধ্রæপদ ধারার অন্তর্গত। তিনি পড়েছেন অ্যাডাম স্মিথের ওয়েলথ অব ন্যাশনস, লর্ড কিনসের কর্মসংস্থান তত্ত্ব, হ্যারড-ডোমার মডেল। অর্থনীতি যে বিমর্ষ কিংবা নিরানন্দ বিজ্ঞান ‘হাড়ে হাড়ে সে অনুভূতি অন্তত আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল।’
অর্থনীতি বিভাগ বহুল প্রশংসিত ছিল বটে, বিভাগের সীমাবদ্ধতার কথা খুবই উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস যেটুকু পড়ানো হতো তাতে মার্ক্সীয় দর্শন থাকত অনুপস্থিত। ‘আর্থার লিউইসের প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত মতবাদ এবং অন্য যেসব সমকালীন গবেষণায় ইউরোপ-আমেরিকার প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা নিয়োজিত ছিলেন সেগুলো আমাদের কানে এসে পৌঁছত, আমাদের প্রভাষকরা ক্লাসে তার কোনো আলোচনা করতেন না।’ নীরস তাত্ত্বিক পাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল অর্থনীতি পাঠ। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উল্লেখযোগ্য লিখিত রচনা না থাকলেও তিনি সুলতান-উজ জামানের প্রজন্মকে তার কথোপকথন দিয়েই আকৃষ্ট করে রেখেছেন।
১৯৫৩ সালে এমএ পরীক্ষা যে দিন শেষ হলো তিনি স্বস্তি পেলেন যে পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা শেষ হলো। তখন তার চাচার বাড়িতে থাকা-খাওয়া চলছে- কিন্তু কতদিন? ৬০ টাকা মাসিক বেতনে কুর্মিটোলা হাইস্কুলে মাস্টারিতে যোগ দিলেন। বেতন কাগজে কলমে ৬০; বাস্তবে কম। ছাত্র বেতনের ওপর নির্ভরশীল। এমএ পরীক্ষার ফল বেরোলো, ২০০ টাকা মাইনেতে অর্থনীতির প্রভাষকের চাকরিটা হতে হতে শেষ পর্যন্ত মাযহারুল হকের অনাগ্রহের কারণে হলো না।
সিএসএস পরীক্ষা দিলেন, ১৯৫৫ ব্যাচে বাঙালিদের মধ্যে এ কে এম গোলাম রাব্বানী প্রথম হলেন, সুলতান-উজ জামান খান দ্বিতীয়। তাকে নির্বাচিত করা হলো পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের জন্য। কিন্তু তার পছন্দ প্রশাসন। পছন্দের অগ্রাধিকার তালিকাতেও তাই লিখেছিলেন। প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। তিনি ক্যাডার বদলাতে গিয়ে বিপাকে পড়লেন, সামাল দেয়া হলো। নজরুল ইসলাম সাগ্রহে এলেন তার জায়গায় আর তিনি গেলেন সিএসপির প্রশিক্ষণে নজরুল ইসলামের জায়গায়। নজরুল ইসলাম পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিলেন। সুলতান-উজ জামানও একাধিক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও এসকাপের বড় কর্তা ছিলেন। তার জন্ম ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ মৃত্যু ৮৩ বছর বয়সে ১৯ জানুয়ারি ২০১৪। তিনি একটি স্মৃতিকথা রেখে গেছেন : স্মৃতির সাতকাহন। স্মৃতিকথাটি একটি সময়ের প্রাণবন্ত দলিল। বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের কীর্তি নিয়ে দেশ গৌরব করতে পারত। একালে তাদের কুকীর্তি পেছনের আলোকিত ইতিহাসের ওপর কালো ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়