সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা সমাধানে সার্বিক সহযোগিতা করব : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

সাইডলাইন কূটনীতিতে বাজিমাত : সম্মানিত করেছে ভারত, চাপমুক্ত সরকার > পঞ্চবটীতে ভূ-রাজনীতির নতুন সমীকরণ

পরের সংবাদ

দিল্লির আন্তরিকতার বার্তা স্পষ্ট :চীন নিয়ে উদ্বেগ দূর করল বাংলাদেশ > স্থিতিশীলতার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস ভারতের

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : দুই নেতার হাস্যোজ্জল ছবি, আবেগঘন টুইটবার্তায় স্পষ্ট বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোনো ভাটা পড়েনি। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দুই দেশ। বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগে ভারত কিছুটা নাখোশ হলেও, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলেও মনে করছেন তারা। সবমিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে আন্তরিকতায় স্পষ্ট বার্তা পাওয়া গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাত নম্বর লোককল্যাণ মার্গের বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির একান্ত আলোচনায় এসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার দিল্লিতে গিয়েছেন জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ ভারতের বিশেষ আমন্ত্রণে। গতকাল শনিবার জোটের নেতাদের মধ্যে মূল আলোচনাতেও অংশ নিয়েছেন তিনি। তবে দিল্লিতে পা রাখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি গত শুক্রবার নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও অংশ নিয়েছেন, যে বৈঠকে অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’ হয়েছে বলে নরেন্দ্র মোদি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করে জানিয়েছেন। পাশাপাশি গত শুক্রবার দেড়ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে বাংলাদেশ-ভারত দুপক্ষই জানায়, বেশ ফলপ্রসূ আর খোলামেলা আলোচনা হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর। এতে প্রাধান্য পেয়েছে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা ইস্যু। গুরুত্ব দেয়া হয় অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির ওপর। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্কের এই সময়ে এসে রাজনৈতিক সমঝোতাও গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র। যেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে বার্তা দেয় ভারত।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আন্তরিকতার বার্তা ফুটে উঠেছে উল্লেখ করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব

ওয়ালিউর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এটা বুঝতে হবে, দিল্লির সঙ্গে ঢাকার বিশেষ সম্পর্কের কারণেই এমনটি হয়েছে। তিনি বৈঠকের পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে জি-২০ সম্মেলনে নিয়েছেন এবং সেখানে তার বাসভবন ‘পঞ্চবটী’তে প্রথমে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন এবং পরে তারা দুজনে একান্ত আলোচনা সেরেছেন। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে তিনটি এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছে। বিশেষ সম্পর্ক না থাকলে এসবের কোনোটিই সম্ভব নয় বলে জানান এই কূটনীতিক।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জি-২০ সম্মেলন হলেও তিন দিনের সফরে দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কর্মসূচিই ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। বিশ্বের বড় বড় নেতাদের ভিড়েও নিকটতম প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাসভবনে ডেকে নিয়ে বৈঠকের আনুষ্ঠানিকতায় যে হৃদ্যতা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি- তা-ই এখন ঘুরে-ফিরে আলোচিত বিভিন্ন মহলে। পাশাপাশি গতকাল শনিবার ওই সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গতকাল দিনভর এই ছবির আলোচনা হাসিনা-মোদির সফল বৈঠকের ‘টিআরপি’কে ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতেই বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন। গত তিনটি মেয়াদেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছে ভারত। ফলে এবারের নির্বাচনের আগে ভারত ঠিক কী ধরনের অবস্থান নেয় সে দিকেও পর্যবেক্ষকের সতর্ক নজর ছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য আমেরিকা তাদের ‘ভিসানীতি’ ঘোষণা করার পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু ও অবাধ’ নির্বাচন নিশ্চিত করার নামে ওয়াশিংটন অতিসক্রিয়তা দেখাচ্ছে কিনা। ভারত যেহেতু মার্কিন এই ভিসানীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি, তাই এই বিষয়টিতে ভারতের অবস্থান কী- তা নিয়েও নজর ছিল সেই বৈঠকে। তবে গতকাল শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তোলার পর সে বিষয়েও নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন, ভারতই বাইডেনের সঙ্গে এমন আন্তরিক সম্পর্কের পরিবেশ গড়ে দিয়েছেন। যার ফলে বাইডেন-হাসিনা সেলফি তুলেছেন।
তবে হাসিনা-মোদি বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এটা আমাদের বুঝতে হবে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কখনো কোনো ভুল বোঝাবুঝি ছিল না, এখনো নেই। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনায় সেই জিনিসটাই আরো একবার পরিষ্কার হয়ে গেছে বলেই তার অভিমত। প্রসঙ্গত, শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদির বাসভবনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে। সেই বৈঠকের মধ্যেই প্রায় ১৫/২০ মিনিট নিজেদের মধ্যে একান্তে কথাবার্তা বলেছেন দুই নেতা; যেখানে তারা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করতে পেরেছেন।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের ঠিক আগে জি-২০ সম্মেলনে এবং তার আগে বাংলাদেশ ‘ঝোড়ো কূটনীতি’ চালিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে বৈঠকের পরপরই বাংলাদেশের সরকারপ্রধান দিল্লিতে গিয়েছেন। সেখানে মোদি-বাইডেনের সঙ্গে আলোচনার পর আজ রবিবার সন্ধ্যায় দেশে ফিরবেন। এরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রাজধানী ঢাকায় আসবেন। আগামী সোমবার তার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভারতের সিনিয়র সংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলেন, ভারত আর চীন সম্পর্কে উদ্বেগ আগে। ভারত চায় না যে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়–ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হয়ে থাকলে ভারত সেটা উল্লেখ করতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝিয়েছেন, বাংলাদেশ যেহেতু স্বাধীন সার্বোভৌম রাষ্ট্র, তারা আর্থিক উন্নয়নের জন্য সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু যদি (বাংলাদেশ ও ভারতের) পরীক্ষিত রক্তের সম্পর্ক হয়, তবে তারা এমন কিছু চাইবেন না যাতে সে সম্পর্কে চীন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। চীনা বিনিয়োগে হঠাৎ ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক শীতল হয়েছে, এমন সমালোচনারও কৌশলগত অবস্থান দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে উচ্চারিত হয়েছে বলেও ধারণা অনেকের। গৌতম লাহিড়ী বলেন, ভারত এই প্রথম শেখ হাসিনার নীতির প্রশংসা করল- যেটা ইন্দো-প্যাসিফিক। ইন্দো-প্যাফিসিফিক; এটা আর্থিক মঞ্চ হলেও আদতে এর উদ্দেশ্য হলো চীনের প্রভাব খর্ব করা। একান্ত কথাবার্তায় যেখানে আর কেউ ছিল না নিশ্চয় একে অপরকে পারস্পরিক উদ্বেগের কথা বলেছেন। তারপর কিন্তু প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) টুইট (এক্স) করেছেন, আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। তিনি বলেন, সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় তো আগে থেকেই ছিল। আমার ধারণা, সম্পর্কটা আরো উন্নত হচ্ছে এবং হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই বৈঠকে সরাসরি নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তবে কূটনৈতিক পরিভাষা যদি কেউ বিশ্লেষণ করতে চান তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন এই বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর ফলে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার হলো বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা এ-ও বলেছেন, বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার’ প্রতি ভারত বহু বছর ধরে যে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে তা আগামী দিনেও পুরোপুরি অব্যাহত থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত হলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়ই তার বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে শেখ হাসিনা যে বক্তব্য তুলে ধরেন- এর সঙ্গেও নরেন্দ্র মোদি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেছেন। বৈঠকের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা’র বিষয়টিকেই তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ভারতও এই বিষয়টিতে একমত হয়েছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশে যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছেন, তাকে হুমকিধমকি দিয়ে অপসারণের চেষ্টা করা হলে সেটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র অঞ্চলে অস্থিরতা ডেকে আনবে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে- সেক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার ঘটবে, নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। এই মূল্যায়নের সঙ্গে ভারতের একমত না হওয়ার কোনো কারণই নেই। আর তারা সেটা বাংলাদেশকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েও দিয়েছে।
তবে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরারত দিয়ে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন প্রক্রিয়া যাতে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব যাতে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না পায় সেটাও নিশ্চিত করা খুব জরুরি। দুই নেতার মধ্যে আলাপে এই প্রসঙ্গটাও এসেছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে কিন্তু ভারত একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারকেই’ দেখতে চায়, আর সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশই নেই।
দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যমে আরো বলা হয়, পৃথিবীর সব দেশই চায় নিজেদের চারপাশে বন্ধুসরকার ক্ষমতায় থাকুক। আমরাও একই জিনিস চাই, তাতে তো কোনো অন্যায় নেই! আর কারা আমাদের বন্ধু, কারা ততটা নয়- সেটা চিনতে পারার ক্ষমতা তো আমাদের আছে, তাই না? দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনাতেও ঠিক এই বার্তাটাই ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে বলে দিল্লি পরিষ্কার করে দিয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়