প্রাথমিকে বৃত্তি প্রদান : পরীক্ষায় নয়, নানা অলিম্পিয়াডে হতে পারে মেধা যাচাই

আগের সংবাদ

দিল্লির আন্তরিকতার বার্তা স্পষ্ট :চীন নিয়ে উদ্বেগ দূর করল বাংলাদেশ > স্থিতিশীলতার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস ভারতের

পরের সংবাদ

তিরিশ ও চল্লিশের দশকের স্মৃতি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে ১৯৩২ সালের এমএতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন দুজন- সাইদুর রহমান এবং বিনয় গোপাল রায়। অনার্সের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ফার্স্ট ক্লাস পেলেন না। হরিদাস ভট্টাচার্য কেবল দর্শন বিভাগের প্রধানই নন, ভারতেরও প্রথিতযশা দার্শনিক। সাইদুর রহমান রাজশাহী সরকারি কলেজে চাকরির আবেদন করেন, সেখানে তখন প্রিন্সিপাল ডব্লিউ এ জেনকিন্স পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। সেকালে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মুসলমান ছাত্রের জন্য অবশ্যই দুর্লভ। রেজাল্টের কারণেই জেনকিন্স সাহেবের নিরপেক্ষতার কারণে প্রতিদ্ব›দ্বীদের হারিয়ে কলেজে যোগ দিলেন ৪ নভেম্বর ১৯৩২। কিন্তু সেখানকার হিন্দু ছাত্রচক্র এতটাই শক্তিশালী ছিল তারা শিক্ষক হিসেবে তাকে মেনে না নিয়ে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে বদলি করাতে সক্ষম হলো। সেই কলেজটি আবার তখনকার হিন্দু রক্ষণশীল দুর্গ, সেখানে মুসলমানের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে তার চাকরি না থাকার মতোই অবস্থা।
প্রতিকার চাইতে তিনি গেলেন প্রভাবশালী মুসলমান নেতা আবুল কাশেমের কাছে (বদরুদ্দীন ওমরের পিতামহ, আবুল হাশিমের পিতা)। সাহসী স্পষ্টবাদী ও পরোপকারী আবুল কাশেম তাকে বালিগঞ্জে শিক্ষামন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়ি নিয়ে গেলেন। তিনি নাম ধরে শিক্ষামন্ত্রীকে ভর্ৎসনা করলেন- ‘তুমি কোন ধরনের মন্ত্রী? তোমার লেখার ওপর হিন্দু কেরানিরা হাত চালায়?’ সুবিচার না পেলে শিক্ষামন্ত্রীকে অ্যাসেমব্লিতে নাস্তানাবুদ করার হুমকিও দিলেন।
সাইদুর রহমান শিক্ষামন্ত্রীর ওপর ভরসা করতে না পেরে এলেন বিরোধীদলীয় নেতা এ কে ফজলুল হকের ঝাউতলার বাড়িতে। জনতা পরিবেষ্টিত ফজলুল হক তার কাহিনী শুনে বললেন, ‘টেক মাই পেয়ার অব স্যান্ডালস’ এবং যাও নাজিমুদ্দিনের দু’গালে দুটা বাড়ি মেরে এসো। তাহলে আমি তোমার চাকরির সমস্যাটা দেখব।
ফজলুল হকের পরামর্শ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে চাকরিই চলে যাবে, এটা নিশ্চিত। ফজলুল হক তাকে বললেন, মাসে দেড়শ টাকার মাইনেই তো, নিয়মিত যেন তার কাছ থেকে নিয়ে যান।
অবশ্য উদ্যোগ শিক্ষামন্ত্রীই নিয়েছিলেন, কেরানিচক্র ভেদ করে তিনি সফল হন, সাইদুর রহমান রাজশাহী কলেজে ফিরে যান। পরবর্তীকালে ‘নাস্তিক’ দার্শনিক হিসেবে চিহ্নিত সাইদুর রহমান মুসলমান ছাত্রদের জন্য হিন্দুশূন্য ছাত্রাবাস দখল এবং কুরবানির সময় গরু জবাইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষক আখ্যা পেয়েছেন। রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ আপাত সংস্কারমুক্ত, ছাত্র-শিক্ষকের প্রিয় স্নেহময় দত্ত সাইদুর রহমান সম্পর্কে গোপনীয় রিপোর্টে সরকাকে জানিয়েছেন, ‘জনপ্রিয় শিক্ষক বটে, তবে ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক নেতা।’
১৯৩২ থেকে ১৯৪১- ১০ বছর তিনি রাজশাহী কলেজে পড়িয়েছেন, ছাত্রদের সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। তার শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলে দেলদুয়ারের জাঙ্গালিয়ার দরিদ্র মেধাবী ছাত্র এম এন হুদাকে রাজশাহীতে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। কলেজের প্রথম বছর এম এন হুদা তার বাসাতেই থাকলেন, অন্যরা জানল সাইদুর রহমানের শ্যালক। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় হুদা যখন ফার্স্ট হলেন হিন্দুরা বিস্মিত হলো- মুসলমান ছাত্র এত মেধাবী হয় কেমন করে। সুতরাং রটিয়ে দিল সাইদুর রহমান শ্যালককে পরীক্ষার প্রশ্ন আগেভাগে জোগাড় করে দিয়েছেন, তাই এমন রেজাল্ট। কিন্তু পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএ পরীক্ষার মেধা তালিকায় যখন অষ্টম স্থান অধিকার করলেন তার মেধা নিয়ে প্রশ্ন করার আর কোনো সুযোগ থাকল না।
অর্থকষ্টে পড়া ছাত্রদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিনি ঘটকালি করে তাদের বিত্তবান পরিবারের কন্যার সঙ্গে বিয়ের অনেক আয়োজন করেছেন, এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়েছেন। দুস্থ এক ছাত্র যেন পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে পারে সে জন্য বগুড়ার পুলিশ ইন্সপেক্টরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলেন। তিনি বরযাত্রীর আগেই এসে হাজির হলেন পাত্রীর বাড়িতে। কিন্তু বিয়ের নির্ধারিত দিনে পাত্রের দেখা নেই। পাত্রীপক্ষ বিচলিত। তিনিও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পাত্রীর বাবা তাকে অনুরোধ করলেন সারদা পুলিশ ট্রেনিং একাডেমিতে গিয়ে কাউকে বিয়ে করতে রাজি করিয়ে যেন নিয়ে আসেন। দুদিন পর সত্যিই পূর্ব নির্ধারিত বর কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে হজির এবং জানায় ডায়রিয়ার কারণে সময়মতো আসতে পারেনি। বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু পরে জানা গেল ডায়রিয়া নয়, পাত্র আগেও বিয়ে করেছিল। তার বাবা-মা নতুন করে বিয়েতে অনুমতি দিতে চাননি। উত্তরকালে এই মিথ্যাচারী ছাত্র রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন।
১৯৪৭-এর ভারত ভাগ ও দাঙ্গার উসকানিতে যেসব হিন্দু ছাত্র দেশত্যাগ করে তাদের আইএ পরীক্ষায় বসানোর দায়িত্ব পান শিক্ষা বিভাগের স্পেশাল অফিসার সাইদুর রহমান। তিনি প্রশ্নপত্র নিয়ে কলকাতা যান। প্রেসিডেন্সি কলেজে দেশত্যাগী ছাত্রদের পরীক্ষা নেয়া হয়। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া বিখ্যাত অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের বালিগঞ্জের বাড়িতে যান। সাইদুর রহমান লিখেছেন : ‘তিনি ছিলেন আমার ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের হেড। তাকে কেউ কেউ ‘চানক্য’ বলে অভিহিত করতেন। তখন ভারতের দার্শনিক মহলে তিনি নাম্বার টু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নাম্বার ওয়ান ছিলেন স্যার রাধাকৃষ্ণান। হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হোয়াট ইজ ইউর কনট্রিবিউশন ফর পাকিস্তান?’ আচমকা এ প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। …আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিনি তিরস্কার করে বললেন, একসময় তো তুখোড় ছাত্র ছিলে, এখন দেখছি আস্তা ইডিয়ট হয়ে গেছ।… তুমি আমার প্রশ্ন ধরতে পারনি। আমি জানতে চেয়েছি তোমার সন্তান-সন্ততি কতজন। যেহেতু পাকিস্তান ব্রুট মেজরিটির ওপর অধিষ্ঠিত, সেই মেজরিটিতে তোমার অবদান কতটা?

ছবি বিশ্বাসের বাড়ি লুট
১৯৪৬-এর দাঙ্গা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে বিজয় এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভ মুসলমানদের শক্তিশালী করে তুলেছে। মুসলমানরা তখন কেবল মার খাচ্ছে এমন নয়, দিচ্ছেও। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস আগে থেকেই চলে আসছিল। সাইদুর রহমান ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক এবং বেকার হোস্টেলের সাবেক সুপার তখন থাকতেন পার্ক সার্কাসের মুসলমান অধ্যুষিত দিলখুশা স্ট্রিট। মুসলমান অধ্যুষিত বলেই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের অভাবে এদিকটায় দাঙ্গা তেমন ছড়াতে পারেনি। তিনি লিখেছেন, ‘তাছাড়া বালিগঞ্জ, আমীর আলী এভিনিউ প্রভৃতি এলাকায় ছিল বিত্তবানদের বসবাস। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র লোকেরাই মূলত দাঙ্গার শিকার হয়। বিত্তবানরা খুব কমই আক্রান্ত হয়েছিল ওই দাঙ্গায়।
দিলখুশা স্ট্রিটে সাইদুর রহমানের বাড়ির দুটো বাড়ি পরের বাড়িটিতে থাকতেন চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত নায়ক ছবি বিশ্বাস- অনেকটা অহংকারী রাশভারি মানুষ, পাড়ার লোকজনের সঙ্গে মোটেই মেলামেশা করতেন না। নিজের সন্তানদের পড়াতেন বিভিন্ন কনভেন্টে রেখে। তবে খুব শৌখিন ছিলেন। ইচ্ছামতো দামি দামি জিনিস আর আসবাবপত্র দিয়ে ঘরদোর সাজিয়েছিলেন। পার্ক সার্কাস এলাকায় থাকতে জীবনের ঝুঁকি আছে ভেবে দাঙ্গার শুরুতে তিনি অন্যত্র চলে যান বাড়ি খালি ফেলে রেখে। সেই সুযোগে পাড়ার এক শ্রেণির লোক তার বাসায় লুটপাট চালায়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাসার মালামাল অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে সঙ্গে পুলিশ নিয়ে ছবি বিশ্বাস এসেছিলেন। তাদের দেখে আশপাশ থেকে কৌতূহলী জনতা এসে অনেক ভিড় জমিয়েছিল। ছবি বিশ্বাস নিজে না ঢুকে একজন সেপাই পাঠালেন। সেপাই এসে বলল, বাসার মধ্যে কিছু নেই, সব লুট হয়ে গেছে। জিনিসপত্রের প্রতি তার এত মায়া জন্মে গিয়েছিল যে শোনামাত্র তিনি প্রায় মূর্ছা যান। এত বড় অভিনেতার এমন দশা হতে পারে- আশপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা কখনো ভাবতেই পারেনি। তাদের মধ্যে অনেকেই ওই লুটপাটে জড়িত ছিল। …ছবি বিশ্বাসের মতো ডাকসাইটে নায়কের মূর্ছা যাওয়ার দৃশ্য দেখে বা সংবাদ পেয়ে তার বাসা যারা লুট করেছিল তাদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। তারা সবাই লুট করে নেয়া মালপত্র একে একে এনে ছবি বিশ্বাসকে ফেরত দিয়ে যায়।

দেশ ভাগ ও ফার্নিচার ভাগ
দেশ ভাগ ও বাংলা ভাগ চূড়ান্ত হতে বাকি নেই। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমানকে বাংলার প্রাদেশিক সরকার বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে দার্জিলিং পাঠায়। তিনি চার সদস্যের একটি দলের প্রধান। তাদের কাজ সেখানকার সরকার সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা। ট্রেনে দার্জিলিং, কাঞ্জনঝঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ আর ভাগাভাগিতে কেটে গেল দশদিন। বাটোয়ারাতে পূর্ববঙ্গ পাবে ৬০ ভাগ পশ্চিমবঙ্গ ৪০; তবে স্থাবর সম্পত্তি যেমন আছে তেমনই থাকবে, হাত দেয়া যাবে না। সম্পত্তি ভাগাভাগি বেশ কষ্টকর কাজ, প্রতিদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। আত্মকথা ‘শতাব্দীর স্মৃতি’তে প্রথিতযশা দার্শনিক ও অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান লিখেছেন :
তখন দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন মি. ক্রিক। ইংরেজ ভদ্রলোক। তার স্ত্রীর বয়স পঁচিশের বেশি না হলেও যাকে বলে একেবারে জাঁদরেল মহিলা ছিলেন। তিনি মোটেই আসবাবপত্র ভাগাভাগির পক্ষে ছিলেন না। আমরা যখন তাদের বাংলোতে গেলাম, মিসেস ক্রিক বেশ রুষ্ট হয়েই আমাকে বললেন, ‘ফার্নিচার তো ভাগ করবেন, সঙ্গে করাত আনেননি?’
আমি তাকে বলেছিলাম যে করাতের দরকার পড়বে না। ড্রইং রুমে যেসব আসবাবপত্র আছে ভাগাভাগির সময় তার কোনোটাতেই হাত দেয়া হবে না। তবুও ভদ্রমহিলা সন্তুষ্ট হওয়া তো দূরের কথা আমাকে শাসিয়ে বললেন, ‘আমার ড্রইং রুমের সৌন্দর্যহানির জন্য আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবের কাছে আপনার নামে নালিশ করব।
আসবাবপত্রের ভাগ যতটা সম্ভব আদায় করেছিলেন, সেই সঙ্গে একটি আস্ত সরকারি ছাপাখানা, নাটবল্টু খুলে মালগাড়িতে পূর্ববঙ্গের পথে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে স্মৃতি মনে পড়লে এখনো তার মনে হয় ক্লান্তি কাটেনি, পরিশ্রান্ত শরীরে ঘাম ঝরছে।

জাস্টিসের বাড়ি দখল
১৯৪৭-এর ভারত ভাগের পরপরই সাইদুর রহমান জানতে পারেন তাকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে চট্টগ্রাম কলেজে বদলি করা হয়েছে। তিনি ঢাকায় এসে কয়েক দিন থেকে স্বল্পকালীন কর্মক্ষেত্রে চলে যান এবং সেখানে তার বিপরীত চরিত্রের বন্ধু ও শিক্ষক জালালউদ্দিনের বাড়িতে উঠেন। তিনি উগ্র ডানপন্থি, ধর্মানুরাগী, পরবর্তীকালে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এবং গভর্নর মোনায়েম খানের অনুগত প্রিয়পাত্র। সাইদুর রহমান শিক্ষা বিভাগের স্পেশাল অফিসার (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি- তবে একালে যেমন কর্মহীন তেমন নয়) হয়ে ঢাকা ফিরে আসেন।
সে সময় কলকাতার অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র ঢাকায় চলে এসেছে, থাকার মতো হোস্টেল না থাকায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা আবাসনের দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু তাদের প্রতি কেউ মনোযোগ দেয়নি। অগত্যা তারা জাস্টিস শাহাবুদ্দিনের নামে বরাদ্দ করা ভবনটি দখল করে নেয়। ‘এতে তৎকালীন সরকারের টনক নড়ে। এ নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়। আলোচনার পর পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জানতে চাইলেন- কলকাতায় এসব ছাত্রের সমস্যা সামাল দিত কে? যেহেতু কলকাতায় বিষয়টি সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম, তাই আমার ডাক পড়ে। অতি সত্বর আমাকে শিক্ষা বিভাগের স্পেশাল অফিসার করে (চট্টগ্রাম থেকে) ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সাময়িক সমাধানের জন্য তিনি ঢাকা বোর্ড অফিসের পূর্বদিকে কয়েকটি বাড়ি ভাড়া নেন। তা হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বৃহত্তর আবাসন হিসেবে ইকবাল হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে সেখানে বেশ ক’টি সেমি পার্মানেন্ট শেড নির্মাণ করা হয়।
জাস্টিস শাহাবুদ্দিন দক্ষিণ ভারতীয় খাঁটি ভদ্রলোক। তিনিও আবাসন সমস্যায় ভুগছিলেন। ইচ্ছে করলে পুলিশের শক্তি ব্যবহার করে নিজের নামে বরাদ্দ করা বাড়িটা উদ্ধার করে বসবাস শুরু করতে পারতেন। কিন্তু সংবেদনশীল মানুষটি চাইলেন আগে ছাত্রদের থাকার জায়গা নিশ্চিত হোক। ছাত্ররাও তার বাড়ি দখলে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল না। সাইদুর রহমান যখন তাদের বোর্ড অফিসের কাছে ভাড়া বাড়িতে প্রস্তাবিত হোস্টেলে আসার আমন্ত্রণ জানালেন তারা সানন্দে বিচারপতির বাড়ির দখল ছেড়ে দিল।
জাস্টিস মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন (১৮৯৫-১৯৭১) পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম বোর্ডের তৃতীয় প্রধান বিচারপতি। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর এডওয়ার্ড নরমাল বেকারের নামে ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত বেকার হোস্টেল চল্লিশের দশকে চার তলা ভবন ২০০ রুম, ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের পাশাপাশি প্রেসিডেন্সির মুসলমান ছাত্রদেরও নিবাস এটি। হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন খান বাহাদুর ইউসুফ, ডক্টর আতাউল হাকিম এবং মোজাফফর উদ্দিন নাদভীর মতো প্রবীণ অধ্যাপক। লেকচারার অবস্থাতেই সাইদুর রহমান সুুপারিনটেন্ডেন্ট হন ১৯৪৩ সালে। প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকই জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের ডিঙ্গিয়ে তাকে এ পদে আসীন করেছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন তার অধ্যাপক না হওয়ার বিলম্ব অনেকটাই ঘুচিয়ে ছিল। সে সময় ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ইতরাত হোসেন জুবেরী অত্যন্ত প্রিয়ভাজন দক্ষিণ হস্ত হিসেবে তিনি সমাদৃত ছিলেন। ২০০ ছাত্রের প্রতিদিনের খাবার বাণিজ্যটি বাবুর্চিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, টাকা-পয়সা মেরে দেয়ার ঘটনা হামেশাই ঘটত। তিনি বাজার-সদাই কমিটিতে ছাত্রদের ঢুকালেন। কিন্তু মুসলমান ছাত্ররা দারিদ্র্যদশাতেও এ কাজে অনাগ্রহী ছিল, মনে করত এটা চাকর-বাকরের কাজ। তিনি ডাইনিং হল স্টিস্টেম চালু করলেন।
তেতাল্লিশের দাঙ্গায় হোস্টেল চালানো অসম্ভব হয়ে উঠল। বাজারে চালই নেই। অগত্যা তিনি গিয়ে হাজির হলেন শিক্ষামন্ত্রী তমিজউদ্দিনের কাছে। তিনি ছাত্রদের ভাতের বদলে আলু খাবার পরামর্শ দিলেন। তিনি এবার হাজির হলেন সোহরাওয়ার্দীর কাছে। তিনি সমস্যাটি অনুধাবন করলেন এবং শিক্ষা সচিব রাজনকে নির্দেশ দিলেন- সিভিল সাপ্লাই থেকে বেকার হোস্টেলে নিয়মিত চালের সরবরাহ দেয়া হোক। তিনি দেখলেন বড় বরাদ্দ এসেছে প্রতি মাসে ৭৫ মণ চাল। কিন্তু তা এসেছে বেকার হসপিটালের নামে। বিষয়টি শিক্ষা সচিবকে দেখানো হলে তিনি বললেন, চেপে যান। হসপিটাল দেখিয়েই বরাদ্দ দিয়েছি। হোস্টেল বললে অন্য হোস্টেলও দাবি জানাবে, তখন কোত্থেকে সরবরাহ দেব? সেই দুর্মূল্যের দিনগুলোতে সাইদুর রহমানের ছাত্রদের মাসিক থাকা-খাওয়ার খরচ পড়ত মাত্র কুড়ি টাকা। দোতলায় দুটি কক্ষ নিয়ে তিনিও থাকতেন বেকার হোস্টেলে।
অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান সন্ধিগ্ধবাদী দার্শনিক, জন্ম ১৯০৯ সালের ১ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের রসুল্লাবাদ গ্রামে; ২৮ আগস্ট ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। (শতাব্দীর স্মৃতি : সাইদুর রহমান ১৯৯৫, যায় যায় দিন প্রকাশনী)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়