বিএনপির দাবি : রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সক্ষমতা নেই সরকারের

আগের সংবাদ

স্বর্ণ গায়েব নিয়ে অনেক প্রশ্ন

পরের সংবাদ

ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে দেশের অর্থনীতি : রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ, মূল্যস্ফিতির চাপ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য অর্জন থেকে অনেক পিছিয়ে আছে এনবিআর, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যও রয়েছে চাপের মধ্যে, মূল্যস্ফিতির চাপে জীবনযাত্রার মান কমেছে; বর্তমানে এ তিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে দেশের অর্থনীতি- এমনটাই অভিমত অর্থনীতিবিদদের। বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক বাজার এবং একই সঙ্গে এলডিসি-উত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ- অর্থনীতিতে এ ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। এ কারণে সরকারি ব্যয় যৌক্তিকীকরণ ও সার্বিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানোকেই অর্থনীতির জন্য করণীয় বলে মনে করছে সরকারের এ সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা অনেক পুরনো কথার মতো শোনা যায়। আরেকটু আধুনিক আলোচনা দরকার বলে মনে করেন তারা।
স¤প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে সম্পাদিত চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) তিন চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব সৃষ্টি হয়েছে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক করতে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়ার উন্নতি সাধন করাটাও চ্যালেঞ্জ। অর্থ বিভাগ মনে করছে, সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণে আগামীতে আর্থিক শৃঙ্খলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একটি দক্ষ আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছে অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক বিভিন্ন চলকগুলোর প্রাক্কলন ও মধ্যমেয়াদি প্রক্ষেপণের পাশাপাশি টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক খাতের সার্বিক শৃঙ্খলা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। বাজেট ও হিসাবরক্ষণ শ্রেণিবিন্যাস কাঠামোর কার্যকর বাস্তবায়ন ও আইবাসের পরিধি স¤প্রসারণসহ সরকারের আর্থিক নীতি সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি সেবা সময়মতো সঠিক

উপকারভোগীর কাছে পৌঁছানো এবং সম্পদের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা। অর্থ বিভাগ আরো বলেছে, কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। দারিদ্র্যের হার এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এই হার ছিল যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।
অর্থ বিভাগের চিহ্নিত করা চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে অর্থনীতিবিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, যে তিনটি বিষয় অর্থনীতি বিভাগ থেকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য বিশেষ কোনো ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, অনেক উন্নয়নশীল দেশ বিশেষ করে যারা এলডিসি থেকে বের হচ্ছে- সেইসব দেশের জন্যও এসব চ্যালেঞ্জ কার্যকর। অর্থাৎ নেপাল, ভুটান, কম্বোডিয়ার জন্যও এ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈশিষ্ট কী? তিনি বলেন, আমার মতে, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার, নীতি সমন্বয় দরকার, সেই ব্যাপারে আমাদের কোন উদ্যোগ দেখিনি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের রাজস্ব আদায়ের যে নি¤œ হার, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাত ও বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থা, এমনকি আইএমএফের কাছে যেসব প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে না পারা- সব সূচকই তো নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। এর ফলে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির পাশাপাশি বাজারের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ গবেষক বলেন, অর্থনীতিতে একটা দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো অ্যাকশন নেয়া হয়নি। ডলার পাচার হয়েছে, কোন অনুসন্ধান করা হয়নি বা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর নানা দেশে বড় বড় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে আসল ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায়ই এতদিনে হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তিনি বলেন, দেশের ভেতরে যদি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা না থাকে, কারো কাছে উত্তর দিতে না হয়, শেষ বিচারে এটার ফলাফল রাজনৈতিকভাবে দিতে হয়।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রধান (কান্ট্রি ডিরেক্টর) আবদুলায়ে সেক গত সোমবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় খুবই কম। এমনকি প্রতিযোগী অনেক দেশের রপ্তানি-জিডিপি অনুপাতের চেয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এ দেশের অর্থনীতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রধান বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের ব্যবসার পরিবেশের উন্নতির পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাত ও বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ বা ডায়ালগ দরকার।
যদিও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মনে করেন, দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই আছে। সম্প্রতি একনেক বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অর্থনীতি সবসময় একরকম চলে না। একটা বিষয় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি যাচাই করা যাবে না। আমাদের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কমবেশি হয় মাঝে মাঝে, মূল্যস্ফীতির সমস্যা আছে, কিন্তু এগুলো আমাদের সার্বিক গতিতে বিঘিœত করতে পারেনি। এখনো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রবৃদ্ধি যেখানে ইতিবাচক, সেখানে অর্থনীতিকে কীভাবে আমি নেতিবাচক বলব। আমাদের সবকিছু ঠিক আছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের আকার ছিল প্রায় ৪৪ লাখ কোটি টাকা। আর ওই বছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ডলারের গড় বিনিময়মূল্য ৯৯ দশমিক ৮৪৫ পয়সা ধরে)। সেই হিসাবে দেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশই একক খাতনির্ভর। গত অর্থবছর শেষে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় সাড়ে ৮৪ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক খাতের। এ কারণে রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার প্রতি জোর দেন বিশ্বব্যাংকপ্রধান। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ দেশের অর্থনীতিতে বদলেরও সম্ভাবনা তৈরি করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের টাকার মূল্য কমে যাচ্ছে, রিজার্ভ চাপে রয়েছে, আমদানি কমছে, মূল্যস্ফিতি কমানো যাচ্ছে না, বিভিন্নভাবে টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মানুষের কোয়ালিটি লাইফ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের নীতিগুলো যা-ই হোক, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো তার বাস্তবায়ন করতে পারছে না। তাদের কর্মদক্ষতা, সুশাসনের অভাব এজন্য দায়ী। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- সরকারের কোথাও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের সব পর্যায়েই ভালো এবং দক্ষ লোকও রয়েছে। অথচ তারা সামনে আসতে পারছে না। তাদের সামনে আসতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, দেশে এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে নানা ধরনের কৌশল বাস্তবায়ন করা সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার মতো দেশ সংকট থেকে এত দ্রুত উত্তোরণ ঘটাতে পারে, অথচ আমরা কেন পারি না? কারণ আমাদের এখানে করাপশান, রাস্তাঘাটের কোয়ালিটি খারাপ, দক্ষ জনবলের অভাব এজন্য দায়ী। তিনি আরো বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির আজ এই যে নাজুক দশা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। যেসব সমাধান করা সম্ভব ছিল, তার কিছুই করা হয়নি।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে অর্থ বিভাগের উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- রাজস্ব, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার নীতির সামঞ্জস্য বিধানে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো হালনাগাদকরণ। বাজেট ঘাটতি ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত রেখে সরকারি ঋণ ধারণক্ষমতা সহনীয় পর্যায়ে রাখা। রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাজেট প্রাক্কলন ও প্রকৃত অর্জনের মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনা। আইবাসব্যবস্থা স¤প্রসারণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন ইত্যাদি।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছি তা উত্তরণের জন্য চেষ্টা করা হবে। কিন্তু এটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে চলতি বছরটি একটি নির্বাচনী বছর। এ সময় খুব বেশি সংস্কার করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে সরকারের আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তারপরও চেষ্টা করা হচ্ছে অর্থনীতি সংকট থেকে উত্তরণের জন্য। চ্যালেঞ্জগুলো সামনে রেখেই সব কর্মপরিকল্পনা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়