বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা : মার্কিন দূতাবাসের ‘তথ্য’ ও ‘পর্যবেক্ষণ’ চেয়ে ডিবির চিঠি

আগের সংবাদ

ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে দেশের অর্থনীতি : রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ, মূল্যস্ফিতির চাপ

পরের সংবাদ

তিস্তায় জল গড়ানোর আশা! জি-২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে হাসিনা-মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : অকৃত্রিম বন্ধু বাংলাদেশ-ভারতের গলায় ‘অস্বস্তির কাঁটা’ তিস্তা। দুই দেশের অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় এই নদীটি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির উদ্যোগ বাংলাদেশের মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল গজলডোবায় ৫০ : ৫০ অনুপাতে জল ভাগাভাগির। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মানলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা মানতে নারাজ। রাজ্য সরকারের অনুমোদন না পাওয়ায় চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কাক্সিক্ষত জল গড়ায়নি তিস্তায়। তবে আবারো আশা জাগানিয়া স্বপ্ন নিয়ে সামনে এসেছে ‘তিস্তা’। আসন্ন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে তিস্তা নিয়ে সুখবর মিলবে- এমন আশাবাদী বাংলাদেশ। সরকারপক্ষ বলছে, দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিস্তা চুক্তির দ্রুত সুরাহার বিষয়টি উত্থাপন করবে ঢাকা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতে, তিস্তায় সফল হলে নির্বাচনী কৌশলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে শেখ হাসিনার নৌকা। উন্নয়ন, রাজনীতি, কূটনীতির প্রাপ্তির ঝুলিতে যুক্ত হবে আরেকটি মাইলফলক। আর আলোচনার মাধ্যমেই সুফল আসবে- এমন প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের।
বাংলাদেশে তিস্তার প্লাবনভূমির ২ হাজার ৭৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মানুষের স্বার্থ জড়িত। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে পানির হিস্যা অনুযায়ী, মোট প্রবাহের ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ আর ভারত পাবে ৩৯ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ থাকবে নদীর জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু সুস্পষ্ট নির্দেশনার অভাবে চুক্তিটিও শেষ অবধি থেকে যায় অমীমাংসিত। ২০০৭ সালের মে মাসে যৌথ বৈঠকেও বাংলাদেশ দাবি করেছিল ৮০ শতাংশ পানি দুই দেশে সমানভাবে ভাগ করে নেবে। বাকি ২০ শতাংশ পানি নদীর জন্য থাকবে সংরক্ষিত। এভাবেই আলোচনা চলছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়াই সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে গজলডোবায় বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে ভারত এবং ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ১৯৯৮ সালে। বাঁধে মোট গেটের সংখ্যা ৪৫টি। ৪৩ গেটের মাধ্যমে তিস্তার প্রায় পুরো পানি সরিয়ে নেয় তারা। সেই পানি মহানন্দার ভেতর দিয়ে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, মালদহ, জলপাইগুড়িসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজে সেচের পানি হিসেবে সরবরাহ করে।
সবশেষ ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা সম্পন্ন করা যায়নি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ, রংপুরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের পর তিস্তা ইস্যুতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। গত ২৫ জুলাই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো উন্নত করতে তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যু দ্রুত সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি সুপারিশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংসদের উভয় কক্ষ রাজ্যসভা, উচ্চকক্ষ ও লোকসভার নি¤œকক্ষে ‘ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন জমা দেন সব দলের আইনপ্রণেতাদের সমন্বয়ে গঠিত স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। সুপারিশ সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানান, তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা এবং এর ফলাফল কমিটিকে অবহিত করা হবে। তিনি জানান, জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় তিস্তা প্রসঙ্গটির সমাধান হতে পারে।
এ ব্যাপারে আশাবাদী বাংলাদেশও। গতকাল রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘে পানি নিয়ে বাংলাদেশের অঙ্গীকার বিষয়ক এক আলোচনা সভা শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, তিস্তার পানি চুক্তি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করবেন। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ও রয়েছে। আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। গঙ্গার পানি চুক্তির মেয়াদও সামনে শেষ হবে। সুতরাং সব বিষয়ে আলাদা করে যৌথ নদী কমিশন আলোচনা করছে। তবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে তিস্তা নিয়ে আমরা আলোচনা করে এসেছি বা রেখেছি। এদিকে চলতি বছরের মার্চে তিস্তার পানি প্রত্যাহারে পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে দুটি খাল খননের বিষয়ে নয়াদিল্লির কাছে কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে জানতে চেয়েছে ঢাকা। প্রায় পাঁচ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এ বিষয়ে নয়াদিল্লির কোনো বার্তা পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এখনো পাইনি।
সরকারের স্পর্শকাতর বিষয় ‘তিস্তা’ : আগামী জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই সরকার চাচ্ছে, ডিসেম্বরের আগেই তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সই হোক। তিস্তা চুক্তি বর্তমান সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। যদি এই চুক্তি সই হয়, তাহলে তা হবে সরকারের কূটনীতির একটি বড় সাফল্য। এর মাধ্যমে শুধু তিস্তা নদীর পানিই বাংলাদেশে আসবে না, ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকারের বোঝাপড়া ও ভালো সম্পর্কের বিষয়টিও দৃশ্যমান হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি সামনে আসা ইতিবাচক বলে মনে করছি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে দুদেশের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত বিভিন্ন চুক্তির ফলে সম্পর্কের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়েছে। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সৌহার্দপূর্ণ সমাধানে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আমরা প্রত্যাশা রাখছি। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত অনেক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে স্থলসীমান্ত ও সমুদ্র সীমানার মতো জটিল বিষয়গুলো বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, দুই দেশের জনগণের প্রত্যাশা তিস্তা চুক্তি সম্পাদনসহ অমীমাংসিত অন্য বিষয়গুলোরও দ্রুত সমাধান হবে- আমরাও এমন প্রত্যাশা করছি। পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকুক।
সমাধান আলোচনার ‘টেবিলে’ই : ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। এই বন্ধুত্ব রক্তের। মহান একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে মিশেছে ভারতের শহীদ সৈন্যদের রক্তও। এজন্য বাংলাদেশ-ভারতের অমিমাংসীত ইস্যুগুলোর সমাধানে আলোচনা এবং ঐকমত্যের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আমি আশাবাদী হতে চাই। এক দশক ধরে যেটুকু হতাশা, আশা, বঞ্চনা বা আশাভঙ্গ হয়েছি, তার অবসান হোক। তিস্তার সমাধান হোক। এটিই আমাদের চাওয়া। তিনি বলেন, একটি চুক্তি তো ২০১১ সালেই তৈরি হয়ে আছে। এখন শুধু স্বাক্ষর করা বাকি। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বজায় রেখে তারা যদি মনে করেন স্বাক্ষর করবেন, তাহলেই চুক্তি সম্ভব।
এদিকে ‘ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতি’ শীর্ষক ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনের উদাহরণ টেনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার তিস্তা ইস্যুতে ভারতকে অনেক আন্তরিক মনে হচ্ছে। জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এত বড় বন্ধু আমাদের কেউ নেই। যদি বিষয়টি মোদির হাতে থাকতো, তাহলে তিনি করে ফেলতেন। কিন্তু এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও জড়িত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও আমাদের ভালো বন্ধু। কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আলোচনা হবে। আমি মনে করি, আলোচনা চলুক। এটি ইতিবাচক দিক।
তবে আলোচনা হলেই যে সফলতা আসবে এমনটা মনে করেন না কেউ কেউ। তাদের মতে, তিস্তা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দীর্ঘদিনের। এর সমাধান না হলে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন অসম্ভব। এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিস্তা চুক্তি উত্থাপন হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এসব অমীমাংসিত বিষয়গুলোও আলোচনায় আসে। আর তিস্তা দীর্ঘদিন ধরে প্রায় হয়ে যাওয়া অমীমাংসিত ইস্যু- যা ভারতের অভ্যন্তরীণ কারণে হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করতে পারেন এই সমস্যার সুরাহার জন্য। তিনি বলেন, আমি তেমন আশাবাদী নই। কারণ যেসব কারণে গত ১৫ বছর ধরে ভারত তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি, ওই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছাপিয়ে প্রতিবেশিকে গুরুত্ব দেবে এমন অবস্থান তাদের নেই। তবে তিস্তা চুক্তি হলে গোটা দেশের মানুষ খুশি হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়