শেখ পরশ : নোবেলজয়ীর জন্য কি আইন হবে অন্যরকম?

আগের সংবাদ

ছাত্র সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী : স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাণ্ডারি হবে ছাত্রলীগ > বিএনপির উদ্দেশ্য ভোট নয়

পরের সংবাদ

রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি উদযাপন করে বাংলাদেশের কী লাভ?

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ২৫ আগস্ট ছিল রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি। বাংলাদেশের সর্বত্র এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন সংবাদ পোর্টালগুলো রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং অসংখ্য সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় ছেপেছে। বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও ২৫ আগস্ট দিনব্যাপী রোহিঙ্গা ইস্যুকে ‘প্রথম বিটের সংবাদ’ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে এবং ৬ বছারান্তে রোহিঙ্গারা কী অবস্থায় আছে তা নিয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে বেশ পরিশ্রম করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এছাড়াও সন্ধ্যার পর থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিভিন্ন টকশো এবং আলোচনার আয়োজন করে রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে দৃশ্য মাধ্যমকে রীতিমতো গরম করে তুলেছে। আবার ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ২৫ আগস্ট উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা নিজেদের উদ্যোগে বেশকিছু সমাবেশের আয়োজন করেছে। এবং নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য জোর দাবি জানিয়ে সেøাগান দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা এটাকে ‘জেনোসাইড রিমেমব্রাস ডে’ হিসেবে পালন করে উদযাপন করে, যেখানে ২০১৭ সালে অর্থাৎ ৬ বছর আগে আরাকানের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের যে দমন-পীড়ন, খুন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে সেটার স্মরণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার দাবি করে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন এনজিও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কিছু মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছরকে স্মরণ করে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটি সাধারণ মানুষকে জানান দিয়ে ছেড়েছে যে, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ যে মহাধুমধাম করে রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি পালিত হলো বা রোহিঙ্গা জেনোসাইডের ঘটনাকে স্মরণ করা হলো, এতে বাংলাদেশের কী লাভ হলো? এ প্রশ্নের উত্তর জানাটা জরুরি। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে, কেননা নিকট অতীতে শরণার্থীদের এতবড় ঢল বিশ্বের আর অন্য কোনো দেশে দেখা যায়নি। ফলে ঘরের ভেতরে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল এবং ৬ বছর পর পরিস্থিতি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা কাভার করা মিডিয়ার পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে বিবেচনায় প্রিন্ট, অনলাইন এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে আমি সাধুবাদ জানাই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর উপলক্ষে যে কিছু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সেটাও রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ অবস্থা বোঝার জন্য স্বাস্থ্যকর এবং জরুরি। কেননা সেখানে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং নানা পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এনজিওগুলোর কার্যক্রম নিয়ে আমি খুব একটা কিছু বলতে চাই না, কেননা তাদের অর্থদাতাদের নানা শর্ত থাকে এবং তাদের নানা প্রেসক্রিপশন থাকে। ফলে তারা প্রেসক্রিপশনের বাইরে খুব একটা কিছু করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। সার্বিক বিবেচনায় রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি নিয়ে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বাংলাদেশে আদৌ কোনো লাভ হয়েছে কিনা, এ লেখায় সামান্য আলোকপাত করব।
এখানে উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্তি নিয়ে দেশে এবং বিদেশে এমন করে সংবাদ ও প্রতিবেদন ছাপা হয় বা প্রচারিত হয় এবং বিভিন্ন আলোচনায় আলাপ করা হয়, যেন বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা মাত্র ৬ বছর আগে এসেছে এবং এর আগে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল না। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই, রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রথম প্রবেশ করে ১৯৭৮ সালে। এরপর মোটাদাগে দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসে ১৯৯১-৯২ সালে। তারপর দীর্ঘ বিরতি কিন্তু তার মানে এ নয় যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ কখনো বন্ধ ছিল। বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১২ সালে। চতুর্থ দফা ২০১৬ সালে। সর্বশেষ মোটাদাগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে টানা দুই মাস। এবং এ সময় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ হিসাবটা অবশ্য জাতিসংঘের কিন্তু সংখ্যার বিচারে এটা আরো অনেক বেশি বলে অনেকে মনে করেন। উখিয়া এবং টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পে বিগত ৬ বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষাধিক। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় ঢলটি এসেছে ২০১৭ সালে। তাই এটাকেই গুরুত্ব দিয়ে ‘রোহিঙ্গা ঢলের বর্ষপূর্তি’ উদযাপন করা হয়।
আমার জানা মতে, রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আয়োজন এবং আনুষ্ঠানিকতার ব্যবস্থা করা হয়নি। আমি ২৬ তারিখের বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি; কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোনো ধরনের কোনো আয়োজনের খবর চোখে পড়েনি। এমনি শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কমিশনারের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের আলোচনা, সভা, সেমিনার আয়োজনের কোনো খবর আমরা পাইনি। ফলে রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিডিয়া এবং রোহিঙ্গারা ‘বর্ষপূর্তি’ পালন করলে বাংলাদেশের ৩ ধরনের লাভ হয়। এক. বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর মানুষ জানে যে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে একটা বড় মানবিক কাজ করেছে। দুই. সবাই জেনে যায় যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার ৬ বছর হয়ে গেলেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি প্রধানত মিয়ানমার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অসহযোগিতার কারণে। তিন. ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে আর ফেরত যেতে চায় না’ জাতীয় যে বয়ান সমাজে জারি আছে, সেটা যে পুরোপুরি সত্য নয়, সেটা এ বর্ষপূর্তি উদযাপনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা জানিয়ে দেয়। এটাও বাংলাদেশের নগদ লাভ। সবকিছু মিলে আমার কাছে মনে হয়, রোহিঙ্গা ঢলের বর্ষপূর্তি সরকারিভাবে পালন করা যেতে পারে। যদি আগস্টের ২৫ তারিখ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে অবস্থিত সব বিদেশি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ও সিনিয়র কর্মকর্তা, জাতিসংঘের প্রতিনিধি ও সিনিয়র কর্মকর্তা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র ও সিনিয়র কর্মকর্তা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিসহ সবাইকে একটা চা-চক্রের দাওয়াত দিত এবং রোহিঙ্গা সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরত, তাহলে মন্দ হতো না। বাংলাদেশ একটা ছোট আকারে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারত যেখানে ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের কী ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রতিবেশগত এবং নিরাপত্তার সংকট তৈরি হচ্ছে, তার বিস্তারিত বিবরণ ও বিশ্লেষণ থাকতে পারত যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘বার্ডেন শিয়ারিং’ ও ‘গেøাবাল জাস্টিসের’ আওতায় একটা বাধ্যবাদকতায় ফেলতে পারত। এছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা যেত সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান গবেষণা-লব্ধ জ্ঞান দিয়ে তুলে ধরা যেত। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে এসব বিষয় নিয়ে আরো সক্রিয়ভাবে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ‘নন-স্টেট এক্টর’ অনেক কিছু বলতে পারে বা করতে পারে এবং তারও গুরুত্ব আছে বটে, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘স্টেট-এক্টর’কেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়