রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু

আগের সংবাদ

সিসিক মেয়রের প্রতি প্রধানমন্ত্রী : মেয়র নয়, সেবক হিসেবে কাজ কর

পরের সংবাদ

শিবির থেকে হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : ছাত্রজীবন থেকেই শামিন মাহফুজ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডে পঞ্চম স্থান অর্জন করে রংপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। এ সময় শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ার পর তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর অন্য একটি কলেজে ভর্তি হন মাহফুজ। এইচএসসি পরীক্ষায় ৭ম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জড়িয়ে পড়েন জঙ্গিবাদে। গ্রেপ্তার হয়ে ২য় বার কারাগারে গিয়ে হুজি ও জেএমবির শীর্ষ নেতাদের সংস্পর্শে পড়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন খোলার পরিকল্পনা করেন। এরপর জামিনে বেরিয়ে শুরু করেন সদস্য সংগ্রহের কাজ।
২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে কুকি-চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। রাজধানীর ডেমরা থেকে মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি শামিন মাহফুজকে তার স্ত্রীসহ গ্রেপ্তারের পর ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) এসব তথ্য জানায়। সংস্থাটি বলছে, গ্রেপ্তার শামিন মাহফুজ বিভিন্ন জনের কাছে স্যার, ওরফে আরিফ ওরফে আসলাম ওরফে মেন্ডিং নামে পরিচিত। তার স্ত্রীর নাম নাজনীন। গত শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও বিপুল বিস্ফোরক জব্দ করা হয়।
এদিকে গতকাল স্ত্রীসহ শামিন মাহফুজকে আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত শামিনের ৪ দিন ও তার স্ত্রীর ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গতকাল শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসিপ্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার পরই বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে যান শামিন মাহফুজ। যে সংগঠনটি পরে আনসার আল ইসলাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭ সাল থেকেই শামিন মাহফুজ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রহমানীসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন। সে সময় আরেকটা বিদেশি চরিত্র বাংলাদেশের জঙ্গিবাদে আবির্ভূত হয় বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু সে চরিত্রের বিষয়ে আমরা স্পষ্ট নই, সেই চরিত্রের বিষয়ে আমরা শামিন মাহফুজের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করব।
ঢাবিতে পড়ার সময়ে শামিন মাহফুজ পাহাড়ে ক্যাম্পের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনি পাহাড়ে যান। ঢাবি থেকে বের হয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এনরোলমেন্ট হয়। তার গবেষণার বিষয় ছিল পাহাড়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। ইচ্ছা করেই তিনি এ বিষয়টি নেন, যাতে পাহাড়ে যেতে পারেন এবং সেখানে নিরাপদ আস্তানা তৈরি করতে পারেন।
সিটিটিসিপ্রধান আরো বলেন, শামিন মাহফুজকে ২০১১ সালে বিজিবি একবার গ্রেপ্তার করে। পরে জেল থেকে বেরিয়ে একই কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। ২০১৪ সালে শামিন ডিবি কর্তৃক আবার গ্রেপ্তার হন। এরপর কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। সেখানে থাকাকালে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের প্রথম পরিকল্পনা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় আটক হুজি এবং জেএমবির শীর্ষ নেতৃত্ব সাইদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তখন জঙ্গি নেতা মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সিও জেলখানায় ছিলেন। তখন জঙ্গি নেতারা জানতেন শামিন এবং রক্সি আগেই জেল থেকে বের হবেন।
তাই তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির। ২০১৭ সালে রক্সি এবং ২০১৮ সালে শামিন জেল থেকে জামিনে ছাড়া পান। এরপরই তারা সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন কিন্তু সংগঠনের নামকরণ হয়নি। তবে তারা একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে থাকেন।
রক্সি দাওয়াতি কার্যক্রম এবং শামিন মাহফুজ পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তখন ২০১৯ সালে রক্সিকে সংগঠনের আমির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ঢাবিতে থাকার সময়ে শামিন মাহফুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কুকি-চিনের প্রধান নাথান বম। শামিন মাহফুজ উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নাথান বমের সঙ্গে পরিকল্পনা করে ঘনিষ্ঠতা করেন। তখনই নাথান বমের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যান শামিন মাহফুজ। ২০১৯ সালে নাথান বমকে জঙ্গি সংগঠন তৈরির কথাটি জানান এবং সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতের জন্য তাকে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দেন শামিন মাহফুজ। শামিন ছিলেন পুলিশের
মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত জঙ্গি।
পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে কুকি-চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক হয়। আমরা শামিনের কাছ থেকে হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার স্মারকটি উদ্ধার করতে পেরেছি। সেখানে কুকি-চিন কর্তৃক জঙ্গি সংগঠনটিকে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তখনই কুকি-চিনের আওতায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২১ সালে সিলেট থেকে ৬ তরুণ নিখোঁজ হন। এপ্রিলে প্রথম ১২ জন নিয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। কুকি-চিনের ক্যাম্পের পাশেই কেডিসি ক্যাম্প নামে ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। তখনই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ৩০ এর বেশি তরুণ নিখোঁজ হন। তখনই আমরা এ সংগঠনের তৎপরতার বিষয়ে অবগত হই।
রক্সি গ্রেপ্তারের পর মূল ব্যক্তি হিসেবে তমালকে আমির হিসেবে নিয়োগ দেন শামিন মাহফুজ। ২০২২ সালে শুরা কমিটি গঠন করে বিভিন্ন জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা শামিনের মোবাইল থেকে একটি গোপন কথোপকথন উদ্ধার করেছি। সেখানে শুরা কমিটির সঙ্গে নাথান বমও কানেক্টেড ছিলেন। অভিযানের শুরুর দিকে শামিনকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন নাথান বম। কিন্তু শামিন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নাকচ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। শামিন নির্দেশনা দিয়েছেন, যুদ্ধ হবে আক্রমণাত্মক, রক্ষণাত্মক নয়। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের উদ্দেশ্য সশস্ত্র জিহাদ। তাদের মতে যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কাজ করে তারা মুরতাদ। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিশ্চিত হতে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত থাকবে।
সিটিটিসিপ্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, শামিন মাহফুজের স্ত্রী নাজনীন ছিলেন আনসার আল ইসলামের ইজাজ কারগিলের স্ত্রী। ইজাজ আহমেদ কারগিল পাকিস্তানে গিয়ে আল কায়েদার অন্যতম শীর্ষ নেতা বনে যান এবং আল কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জঙ্গি কার্যক্রম মনিটরিং করতেন। পাকিস্তানে ড্রোন হামলায় নিহত হন কারগিল। তার আগেই সংগঠনের সিদ্ধান্তে ইজাজ কারগিলের স্ত্রীকে বিয়ে করেন শামিন মাহফুজ। এটি তার দ্বিতীয় বিয়ে। তার স্ত্রীও সংগঠনের নারী সদস্য হিসেবে নারীদের দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
সিটিটিসিপ্রধান আরো বলেন, আমরা নাথান বমের সঙ্গে শামিনের সর্বশেষ যোগাযোগটা উদ্ঘাটন করতে পারিনি। আমরা মনে করি কোনো না কোনোভাবে তার যোগাযোগ থাকতে পারে। হিজরতে যাওয়া অধিকাংশকেই আমরা গ্রেপ্তার করেছি। নাথান বমের উপদেষ্টা শামিনকে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে। তার কথায় কেন নাথান বম আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন এ প্রশ্নগুলো আমাদেরও। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাব এর ভিত্তিতে বিস্তারিত জানা যাবে। আশা করি শামিনকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়