রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু

আগের সংবাদ

সিসিক মেয়রের প্রতি প্রধানমন্ত্রী : মেয়র নয়, সেবক হিসেবে কাজ কর

পরের সংবাদ

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর : পাল্টে গেল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ৩ কোটি মানুষের জীবনমান

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাবুল আকতার, খুলনা থেকে : গত এক বছরে পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার তিন কোটি মানুষের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র। খুলনা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ অঞ্চল থেকে বিদেশে রপ্তানিকৃত পণ্য থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ২৫ জুন দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর কারণে এ অঞ্চলে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে চাঙা হয়েছে। সেইসঙ্গে মৃতপ্রায় মোংলা বন্দর এখন কর্মচাঞ্চল্যে মুখর। এছাড়া পদ্মা সেতু ঘিরে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ১৮টি প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। যশোর-খুলনা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করাসহ আরো সাতটি প্রকল্পের কাজের প্রস্তুতিও চলছে। চলমান প্রকল্প ও নতুন ছয় লেনের প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাওয়ায় পদ্মা সেতুর দাবিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ আন্দোলনে রাজপথে নামে। দাবি বাস্তবায়নের জন্য সর্বশেষ পদ্মার মাওয়া ঘাটে এই অঞ্চলের পেশাজীবীদের ডাকে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা খুলনা সফরে এলে আন্দোলনরত নেতারা সাক্ষাৎ করেন তার সঙ্গে। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নেতারা সার্কিট হাউসে শেখ হাসিনার কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। এ সময় শেখ হাসিনা নেতাদের প্রতিশ্রæতি দেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। খুলনাসহ পদ্মার এপারের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত সেই স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়। ২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। এরপর থেকে এ অঞ্চলের মানুষের আশা, আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণ হতে শুরু করে। একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে
ছোট বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। খুলনা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে ৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৫৬ ডলারের কাঁচা পাট, চিংড়ি, কাকড়াসহ বিভিন্ন সামগ্রী রপ্তানি করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৬ হাজার ৪৭ কোটি ৩৮ লাখ ২৫ হাজার ৮১৫ টাকা। পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৭ হাজার ১ কোটি ৬৪ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৫ টাকা। এক বছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯৫৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬০ টাকা। অর্থাৎ রপ্তানি আয় বৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
খুলনা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক জিন্নাত আরা আহমেদ বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের সবকিছুর মাপকাঠি। পদ্মা সেতু বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। গত এক বছরে এ অঞ্চলে প্রচুর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা খুলনা, মোংলা, ভোমরা ও বেনাপোলকে রপ্তানির রুট হিসেবে বেছে নিয়েছেন। জিন্নাত আরা আরো বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯২৫ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে ৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৫৬ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর এখন ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীরা পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন বলেও জানান খুলনা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর এই পরিচালক।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, পদ্মা সেতু শুধু মানুষের যাতায়াত আর পণ্য পরিবহনের সমাধান করেনি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য আমূল বদলে দিয়েছে। মৃতপ্রায় মোংলা বন্দরকে সচল করে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছে পদ্মা সেতু।
খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়ে এ দেশকে বিশ্বে সম্মানের স্থানে নিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী যে কয়টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা সেতু। মিজান বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। চ্যালেঞ্জের মুখে এই পদ্মা সেতু নির্মাণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করছেন। তারা কম খরচের জন্য চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহার না করে বর্তমানে মোংলা পোর্ট থেকে তাদের গাড়ি ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। যে কারণে গত বছরের ২৫ জুনের পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মোংলা পোর্ট হয়ে বেশি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বেড়ে গেছে। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্প থেকে রপ্তানির মাধ্যমে আয় অধিকাংশ খুলনা থেকে হতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সেই খাত তার হারানো গৌরব ফিরে পাচ্ছে, আয়ও বেড়েছে। এর পাশাপাশি কমে গেছে পণ্য পরিবহনের খরচও। পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে দিয়েছে বলে অভিমত মিজানের।
এদিকে পদ্মা সেতু হওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন এই অঞ্চলের হিমায়িত পণ্য রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সহসভাপতি শেখ আব্দুল বাকী বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য খাত। এই সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যথাসময়ে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ বিদেশে রপ্তানি করতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। এতে রপ্তানিকারকরা অনেক বেশি সুফল ভোগ করছেন।
খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এস এম জাহিদ হোসেন বলেন, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালীর অংশবিশেষ নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ৬৫১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই বনের এলাকা। দীর্ঘ সময় নষ্ট হওয়ায় ও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় একসময় সুন্দরবন ভ্রমণে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। পদ্মা সেতু হওয়ার পরে সেই দৃশ্য পাল্টে গেছে। গত এক বছরে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম ঘটছে সুন্দরবনে। এতে একদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা যেমন সুফল ভোগ করছে, তেমনি সরকার পাচ্ছে রাজস্ব।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলছে। এছাড়া কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এক বছরে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরির্বতনসহ পণ্য পরিবহনের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশরাফ বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় খুলনা থেকে ঢাকা যাওয়া-আসায় সময় সাশ্রয় হয়েছে। আগে ঢাকায় যেতে ফেরি পারাপারের ওপর নির্ভর করে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টায় এই অঞ্চলের মানুষ যাতায়াত করতে পারছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে এ অঞ্চলের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়