শিশুশ্রম নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান

আগের সংবাদ

ভারত-আমেরিকার বৈচিত্র্যময় অংশীদারত্ব গড়ার প্রত্যয় : হোয়াইট হাউসে মোদি-বাইডেন বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

পরের সংবাদ

হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদন : মোদি-বাইডেন সাক্ষাৎ ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমেরিকা সফর করছেন। এ সফর নিয়ে দিল্লি এবং ওয়াশিংটন বেশ উত্তেজনায় আছে। কারণ আমেরিকা পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতিতে একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ফলে যে কোনো দেশের সরকারপ্রধানের আমেরিকা সফর সে দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আবার ভারতও পৃথিবীর মানচিত্রে ১৩০ কোটি মানুষের দেশ হিসেবে বাজার অর্থনীতিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে তথা এশিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। কাজেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফর এবং আমেরিকার প্রেসিডিন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ এতদঅঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ভারত এবং আমেরিকার ‘কমন এনিমি’ হচ্ছে চীন। ফলে মোদি-বাইডেনের সাক্ষাৎ, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর এবং যৌথ ঘোষণা বিশ্ব রাজনীতির জন্যও একটা বড় ইস্যু হিসেবে সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে তীব্র আগ্রহের জায়গা। এ রকম নানা বিবেচনায় মোদির আমেরিকা সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষও তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে মোদির আমেরিকা সফরের ওপর। এটার কারণও প্রধানত তিনটা : (১) বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার ঘোষিত নতুন ভিসানীতি, (২) আগামী নির্বাচনকে নিয়ে আমেরিকার অতি আগ্রহ এবং (৩) বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান। ভারত এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে কেবল কিছু ‘রুটিন ডিপ্লোমেটিক বক্তব্য’ ছাড়া তেমন কোনো কিছু পরিষ্কার করেনি। এ রকম একটি অবস্থায় ভারতের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দুস্থান টাইমস’ মানুষের মুখে ‘মিন মিন’ করা ইস্যুটিই প্রকাশ্যে এনে রাষ্ট্র করেছে। দ্য হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ’। এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, মোদি-বাইডেন সাক্ষাৎ এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষেরও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
দ্য হিন্দুস্থান টাইমসের পররাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক রেজাউল এইচ লস্কর প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। যদিও এ প্রতিবেদনে যেসব সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনোটারই সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি; তথাপি দ্য হিন্দুস্থান টাইমসের মতো একটি ক্রেডিবল পত্রিকা কোনো ধরনের বিশ্বাসযোগ্য সূত্র ছাড়া এ ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা নয়। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফরকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলবেন এমন আশায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। গত ১২ জুন বারানসিতে জি২০ ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টারদের সভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি অন্য বাংলাদেশ-ভারত উভয় পক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু এসব বক্তব্যের স্বপক্ষে দ্য হিন্দুস্থান টাইমসে কোনো অথেনটিক সূত্র উল্লেখ করেনি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। সেটা হতেই পারে কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে সবসময় বসন্ত বজায় রাখতে হলে তাদের সঙ্গে সবকিছুতেই ‘জি হুজুর জি হুজুর’ পলিসি নিতে হবে, যা সব সময় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো জাতির পক্ষে বজায় রাখা এবং মেনে চলা সম্ভব নয়। ফলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে একটা টানাপড়েন চলে। কেননা আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং কূটনীতির খবর যারা রাখেন তারা জানেন যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সরকারের উত্থান এবং পতনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থের বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করে না। যখনই তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত আসবে বা আঘাত আসার আশঙ্কা তৈরি তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশক্তি দিয়ে সেখানে তাদের তাবেদার সরকার বসানোর জন্য উঠে পড়ে লাগবে। তার নিজের স্বার্থের বিষয়টি নিজের পলিসির মধ্যে রেখে উপরে সে মানবতার ঢোল পেটাবে, গণতন্ত্রের জন্য আহাজারি করবে, মানবাধিকারের প্রশ্নকে সামনে এনে নিজেকে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ডিলার হিসেবে উপস্থাপন করবে। এগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং সুকৌশল ভূ-রাজনীতি, যা বৈশ্বিক আদিপত্য বিস্তারের এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক সাম্রাজ্য বিস্তারে দারুণভাবে কার্যকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এভাবে নানা কূটনীতি এবং রাজনীতির কূটচালে ক্রমান্বয়ে বিশ্বে মোড়লে পরিণত হয়েছে। ডলারকে আন্তর্জাতিক বিনিময় মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পাইকারি হারে মুনাফা লাভ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন আঞ্চলিক বলয় তৈরি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা সফলতা এলেও, যেমন ইউরোপের ২৭টা দেশে ইউরো মুদ্রা চালু করা কিংবা ব্রিক্স গঠন করা প্রভৃতি, এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের নিচে বাস করে পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র। সুতরাং বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ অতি আগ্রহ যতটা না বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি আলগা দরদ থেকে উদ্ভূত, তার চেয়ে অধিকতর হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থ। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোস্সা ভাঙানোর জন্য ভারতের দ্বারস্থ হওয়ার মধ্যে হয়তো কিছুটা কূটনৈতিক লাভালাভের হিসাব-নিকাশ থাকতে পারে, কিন্তু একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের এবং আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতির জন্য কোনোভাবেই সম্মানজনক বিষয় নয়। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ এবং ভারতের সঙ্গে আমাদের সুন্দর, চমৎকার এবং স্বস্তিকর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোস্সা ভাঙানোর জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ভারতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এটাও কোনোভাবে আমাদের জন্য সম্মানজনক নয়। বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি তৈরি করেছে এবং এটা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে লেভেলের প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, এতে করে সম্পর্কের টানাপড়েন আরো বেড়েছে। এখন বাংলাদেশকেই এ টানাপড়েনের মাত্রা এবং তীব্রতা কমাতে হবে নিজস্ব কূটনৈতিক শক্তি দিয়ে। ভারতের ওপর ভর করে এ টানাপড়েন কমাতে পারব বলে আমার মনে হয় না। তাই শুরুতেই বলেছি, লস্কর সাহেবের প্রতিবেদন একটি স্পেকুলেটিব রিপোর্ট। এর আদৌ কোনো সত্যতা আছে বলে আমার মনে হয় না। যদিও ঘটনার পরম্পরা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ, মোদির ওয়াশিংটন সফর এবং বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রভৃতি কারণে এ প্রতিবেদনের টাইম-বাউন্ড গুরুত্ব আছে এবং খানিকটা বিশ্বাসযোগ্যতার দিকে ঝুঁকে পড়ে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন ভারতকে দিয়ে মেরামত হবে না। চীনকে ‘কমন এনিমি’ বানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ গোস্সা বাংলাদেশকে চীনের দিকে ঠেলে দিতে পারে, এ ‘বড়ি’ দিয়ে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন রোগ সারবে বলে আমার মনে হয় না। পেইন-কিলার পেইন সারলেও কখনো রোগ সারে না।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়