প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
ইমরান রহমান ও সাইদুর রহমান, রাজশাহী থেকে : রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচন শেষ হয়েছে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে। গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছেন সব পর্যায়ের ভোটাররা। প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হওয়ায় প্রার্থীরা যে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন, বাস্তবে তেমনটি হয়নি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই সবাই নিজের পছন্দমতো ভোট দিতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ছাড়া অন্য দুজন মেয়র প্রার্থীর শুরু থেকে প্রচার-প্রচারণায় নিষ্ক্রিয় থাকার প্রতিফলন দেখা গেছে ভোটের দিনও। কোনো কেন্দ্রে তাদের কোনো পোলিং এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ছিল না তেমন ব্যক্তিগত তৎপরতাও। ফলে প্রথমবারের মতো একপ্রকার একপেশে ভোটের সাক্ষী হলো রাজশাহীবাসী। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ভোটে অংশ না নেয়াকে দায়ী করেছেন অনেকে। অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার মতো করেই নিজের নগরভবনে ফিরলেন জাতীয় ৪ নেতার মধ্যে অন্যতম শহিদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। এ বিজয়ের মাধ্যমে রাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে হ্যাটট্রিক করলেন তিনি। তৃতীয়বারের মতো নগরপিতা হিসেবে তাকে নির্বাচিত করল রাজশাহীর মানুষ। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (নৌকা) ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি হাতপাখার প্রার্থী মো. মুরশিদ আলম ফারুকী পেয়েছেন ১৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। এদিকে লিটনের বিজয়ের পর আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন নৌকার সমর্থকরা।
ফলাফল ঘোষণার পর লিটন বলেন, যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সেইসঙ্গে বলতে চাই,
আমি রাজশাহীবাসীর জন্য অতীতে সব ধরনের উন্নয়ন কাজ করে এসেছি।
সরজমিন দেখা যায়, গতকাল সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোতে উপস্থিত হতে থাকেন ভোটাররা। বেলা বাড়ার সঙ্গে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। বিশেষ করে সকালের দিকে নারীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোট চলে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। সবমিলিয়ে সারাদিনই রাজশাহীতে বিরাজ করেছে উৎসবের আমেজ। প্রথমবার ইভিএমে ভোট দিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেছেন সব শ্রেণিপেশার ভোটাররা। তবে, কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএমে ধীরগতি থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল কঠোর। এতে সন্তোষ জানিয়েছেন সাধারণ ভোটাররা। আগেই ঘোষণা দেয়া ৫ স্তরের নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিল গোটা নগরী। তৎপর ছিল পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের মোবাইল পেট্রোল টিমগুলোও।
গতকাল বেলা ১০টার দিকে রাজশাহী পলিটেকনিট ইনস্টিটিউট ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে নারী ভোটারদের ছিল দীর্ঘ লাইন। কেন্দ্রটিতে ভোট দেন শাপলা আক্তার নামে এক গৃহিণী। ভোট দেয়ার পর হাসিমুখে বের হতে দেখা যায় তাকে। প্রতিবেশীদের বলতে দেখা যায়, ভয় পায়েন না কেউ। আমিও পেরেছি, আপনারাও পারবেন। জানতে চাইলে শাপলা আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, মনে সংশয় ছিল পারব কিনা। কিন্তু একদমই সহজ কাজ। ডিজিটালি ভোট দিতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। মোছা. ডেজি বেগম ভোরের কাগজকে বলেন, ইভিএমে ভোট দিতে পেরে আমরা সবাই খুশি। তবে, ইভিএমে কিছুটা সময় লাগায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্কুলশিক্ষিকা সানজিদা খাতুন। তিনি বলেন, কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। আরেকটু দ্রুত ভোট দেয়া গেলে ভালো হতো। এই কেন্দ্রে মেলেনি জাতীয় পার্টি ও জাকের পার্টির কোনো পোলিং এজেন্ট। রাজশাহী স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল ভোটকেন্দ্রে কথা হয় নতুন ভোটার রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তারের সঙ্গে। উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ দেখে আমরা অনেক খুশি। এই কেন্দ্রেও মেলেনি নৌকার প্রতিদ্ব›দ্বী কোনো পোলিং এজেন্ট। এমনকি জাতীয় পার্টির প্রার্থীর বাড়ির পাশের কেন্দ্র নগরীর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের মালদা কলোনি এলাকার আটকশি হাইস্কুল কেন্দ্রে ও জাকের পার্টির প্রার্থী লতিফ আনোয়ারের বাড়ির পাশে মুসলিম হাইস্কুল কেন্দ্রেও তাদের কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। শুধু এই কেন্দ্র দুটি নয়, ২৭টি ভোটকেন্দ্র ঘুরেও তাদের কোনো এজেন্টের দেখা মেলেনি।
এদিকে পূর্ব ঘটনা অনুযায়ী গতকাল সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে দুই মেয়েকে নিয়ে ভোট দেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট চলছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে। কারণ সামনে জাতীয় নির্বাচন। ভোটে অংশ নিলে, তারা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পেত। তবুও তাদের দলের ও জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছে প্রায় সব ওয়ার্ডে। ওই প্রার্থীরাই বিএনপির ভোটার নিয়ে আসবে কেন্দ্রে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব প্রার্থীরই আশা থাকে জয়ী হবে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
পরে তিনি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে বের হলে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের আটকশি হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়া জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপনের সঙ্গে দেখা করেন। ভোটের মাঠে প্রতিদ্ব›িদ্বতা ভুলে একে অপরকে আলিঙ্গন করেন দুই মেয়র প্রার্থী। এ সময় খায়রুজ্জামান লিটন গণমাধ্যমে কথা না বললেও সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, আমরা চাচা-ভাতিজা। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো। তবে ভোটের মাঠে কেউ কাউকে ছাড় দিব না। তিনি বলেন, মাঠের বাইরে আমাদের সম্পর্ক সবসময় চাচা-ভাতিজার মতোই থাকবে। তবে ভোটের মাঠে আমরা থাকব প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে।
ভোটকেন্দ্রে জাপার পোলিং এজেন্ট কেন পাওয়া যাচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব কেন্দ্রে এজেন্ট রাখার প্রয়োজন মনে করিনি। যেমন এই কেন্দ্রে (আটকশি হাইস্কুল কেন্দ্রে) আমার এজেন্ট রাখিনি। আমার নিজের কেন্দ্র এটা, এখানে এজেন্ট রাখার দরকার কী? সব মিলিয়ে ৭০/৭২টির মতো কেন্দ্রে এজেন্ট রাখা হয়েছে। ইভিএমের সমালোচনা করে স্বপন বলেন, আমরা শুরু থেকেই ইভিএমে ভোট নেয়ার পরিবর্তে ব্যালট পেপারের দাবি জানিয়ে আসছি। খোঁজ নিলাম অনেকে ভোট দিতে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন।
এজেন্ট না রাখার বিষয়ে জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী বলেছেন, রাজশাহীর মানুষ সচেতন ও শান্তিপ্রিয়। তাদের ওপর আমার অন্ধবিশ্বাস রয়েছে। এজন্য কোনো কেন্দ্রেই আমি এজেন্ট রাখিনি। আর ভোটের পরিবেশ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।
এদিকে মেয়র নির্বাচন একপেশে হলেও কাউন্সিলর পদের নির্বাচনে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। সব কাউন্সিলর প্রার্থীরা যার যার কর্মীদের নিয়ে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। তবে, ৩০টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৮টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ দলীয় একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী এবং বিএনপির বহিষ্কৃত ১৬ কাউন্সিলর প্রার্থী এবং জামায়াতের অঘোষিত ৯ জন প্রার্থীকে নিয়ে সহিংসতার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল- তেমন কিছু ঘটেনি। শুধুমাত্র রাজশাহী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. রুহুল আমিন টুনু (টিফিনকারী) ও আশরাফুল ইসলাম বাবুর (র্যাকেট) সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংঘর্ষের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার মো. আনিসুর রহমান ও অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) বিজয় বসাক। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সোয়া ১২টার পর ৪নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি কাউন্সিলর প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম বাবুর অর্ধশত সমর্থক কেশবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অপর প্রার্থী রুহুল আমিন টুনুর সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর করা হয় বেশ কয়েকটি চেয়ার। এ হামলার ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থী টুনুর স্ত্রী বেবি আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের এসআই জলিল ভোরের কাগজকে বলেন, ভোটকেন্দ্রে কোনো সমস্যা হয়নি। বাইরে থেকে একদল লোক আচমকা হামলা চালায়। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
নিরাপত্তার বিষয়ে আরএমপি কমিশনার মো. আনিসুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ৫ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা সফল হয়েছে। তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) বিজয় বসাক ভোরের কাগজকে বলেন, ভোট শুরু হওয়ার আগে থেকেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। যা আগে কখনো নেয়া হয়নি। পুলিশের ৩ হাজার ৫১৪ জন সদস্যের পাশাপাশি র্যাব, আনসার ও বিজিবি দায়িত্ব পালন করেছে। সক্রিয় অবস্থানে ছিল মোবাইল পেট্রোলিং টিমও। সত্যি বলতে, রাজশাহীবাসীর ভোটকে আমরা আমানত হিসেবে নিয়েছিলাম। সবাই যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন, সেজন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
উল্লেখ্য, এবারই প্রথম রাসিকের সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতিতে নগরীর ১৫৫টি ভোটকেন্দ্রের এক হাজার ১৫৩টি কক্ষে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটারের এই নগরীতে মোট ভোটার রয়েছে তিন লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭১ হাজার ১৬৭ জন। আর নারী ভোটার এক লাখ ৮০ হাজার ৮০৯ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ভোটার ৬ জন। এবার নতুন ভোটার হয়েছেন ৩০ হাজার ১৫৭ জন। ২০নং ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় রবিউল ইসলাম কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় ২৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১১১ জন ও ১০টি সংরক্ষিত আসনে মহিলা কাউন্সিলর হিসেবে লড়েন ৪৬ জন প্রার্থী। আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা) নির্বাচন বর্জন করায় মেয়র পদে লড়াই করেন ৩ জন প্রার্থী।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।