সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিপাকে ভুক্তভোগীরা

আগের সংবাদ

উন্নয়ন ও প্রত্যাশায় ফারাক অনেক : ক্লিন সিটি খ্যাত রাজশাহীর মানুষ অনেক সেবা পান না

পরের সংবাদ

জন্মই যাদের আজন্ম পাপ : হুমকিতে শিশুস্বাস্থ্য

প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা ছুঁই ছুঁই। চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত রাজপথ শাহবাগ মোড়ের গাড়িগুলো তখন ছুটছে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়তেই ফুটপাত থেকে ফুল ও বেলুন হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল কয়েকটি শিশু। সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ির জানালা ঘেঁষে তাদের কোমল কণ্ঠের আকুতি, ‘ফুল লাগব, নেন না একটা ফুল। খিদা লাগছে। খামু।’ এদের মধ্যে ক্ষুদে ফুলওয়ালীর নাম সিনথিয়া। বয়স ৬ বছর। বাবা কে জানে না সিনথিয়া। শুধু জানে জন্মের পর তাকে ও মাকে ফেলে চলে গেছে অন্যত্র। দিনভর মা ফুলের মালা বানিয়ে দেয় আর ছোট্ট সিনথিয়া দৌড়ে দৌড়ে বিক্রি করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শাহবাগে। ‘কোথায় থাক?’ জিজ্ঞেস করতেই জানায় শাহবাগ এলাকায় ফুটপাতের একাংশে পলিথিনের এক ছাপড়ায় মায়ের সঙ্গে থাকে সে।
ঢাকা শহরে এক সিনথিয়ার জীবনচিত্র এটি। শুধু সিনথিয়াই নয়, ঢাকা শহরে এমন প্রায় আড়াই লাখের বেশি সিনথিয়া এভাবেই বেঁচে আছে জল-ঝড় আর ঝাঁঝালো রোদে। ওরা ঠিক সাধারণ শিশুর মতো নয়। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর ওদের ভাগ্যে কমই জোটে। সিনথিয়ার মতো কেউ হয়তো জন্মের পর দেখেইনি বাবাকে। একটু বুঝে ওঠার পর থেকে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে জীবিকার খোঁজে। আরেকটু বড় হলে মা এক পথে, ওরা অন্য পথে ঘুরতে থাকে পেটের দায়ে। এভাবে জীবন তাদের দাঁড় করিয়ে

দেয় এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। যেন জন্মই ওদের আজন্ম পাপ। মাতৃ জরায়ু থেকে নেমেই বুঝে যায় দুনিয়া কত কঠিন, কত নির্মম-নিষ্ঠুর। পথে পথে ঘুরে কখনো পরিচয় মেলে টোকাই হিসেবে, কখনো বা পথশিশু।
বর্তমানে বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। কেউ বলেন ২১ লাখ। আবার কেউ বলেন ২৪ লাখ। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ, এর মধ্যে আড়াই লাখের বেশি রাজধানীতেই। এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পথশিশু জরিপ-২০২২ এর তথ্যমতে, দেশের মোট পথশিশুর (৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি) মধ্যে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থান ঢাকা বিভাগে। এর ২২ দশমিক ৭ শতাংশের অবস্থান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে রয়েছে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। পথশিশুদের মধ্যে ৮২ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে। পথশিশুদের গড় বয়স ১২ দশমিক ৩ বছর। পথশিশুদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৪ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগ এবং সর্বনি¤œ ৪ দশমিক ৯ শতাংশ সিলেট বিভাগে। আর জেলাগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বরিশাল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ভোলা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কুমিল্লা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জ ৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং কক্সবাজার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। জরিপটি পরিচালনায় সহায়তা করেছে ইউনিসেফ।
জন্মের সময় প্রতিটি শিশুই নাগরিক অধিকার নিয়ে জন্মায়। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ভোরের কাগজকে বলেন, শিশুরা যত ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে, তার সবই আছে পথশিশুদের। অধিকারের জায়গা থেকে, বঞ্চনার জায়গা থেকে, সব ধরনের ঝুঁকিতে থাকা শিশুরাই পথশিশু। একটি শিশুর সবার আগে বাসস্থানের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই পথশিশুরা পাচ্ছে না।
যৌন নির্যাতনের শিকার ৪৬ শতাংশ মেয়ে পথশিশু : সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণার তথ্যমতে, পথশিশুদের ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। এর মধ্যে মেয়ে পথশিশুরা ৪৬ ভাগ। ৫১ ভাগ অশ্লীল কথার শিকার হয়। আর বেসরকারি সংস্থা সোশ্যাল এন্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। ওই গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে। খোলা আকাশের নিচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মাস্তানদের দিতে হয়। তারা পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন, কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন, লিডো, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি ও আহসানিয়া মিশনের এক সমন্বিত গবেষণায় বলা হয়, ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশুই পুরোপুরিভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ক্ষুধার তাগিদে তারা গড়ে ১০ ঘণ্টা কাজ করে এবং ৩৫ শতাংশ পথশিশু ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পথশিশুদের মূল¯্রােতে সম্পৃক্ত করতে পুনর্বাসনের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সুস্থ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সরকার পথশিশু উন্নয়ন কার্যক্রম নামে একটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেখানে শিশুদের থাকা-খাওয়া এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে সারাদেশের যেখানে যত পথশিশু রয়েছে, তাদের জন্য নিরাপদ আবাসন তৈরি করা দরকার। প্রথমেই থাকার ব্যবস্থা এবং তাদের বয়সোপযোগী ভোকেশনাল শিক্ষা এবং তারা যেন নির্দিষ্ট বয়সে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মাদক বহন করতে গিয়ে মাদকে আসক্ত হচ্ছে পথশিশুরা, তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এর পেছনে সব সময় সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মাদক পথশিশুদের মধ্যে প্রবলভাবে ছড়িয়ে গেছে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী শিশুদের টার্গেট করে পণ্য বাজারজাত করছে। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যেই পথশিশুর বেড়ে ওঠা। রয়েছে অর্থনৈতিক নিপীড়ন। মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে শিশুদের জড়ানো হচ্ছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পথশিশুরা।
প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী : জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শিশু দিবসে ঘোষণা করেছেন, কোনো শিশু পথে থাকবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে, যা এখনো চলমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য বড় ধরনের প্রকল্পের প্রয়োজন। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নতি করতে চাই। দেশের সব মানুষ যাতে সমান সুযোগ পায় সেই উন্নয়ন প্রয়োজন। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই সক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করছি। যেসব মানুষ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের আরো কীভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়া যায় প্রধানমন্ত্রী তার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সোশ্যাল সেফটি নেট আরো বাড়াতে চাই।
সরকার পথশিশুদের জন্য শেল্টারহোম করছে, কিন্তু সেখানে তারা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে- এক্ষেত্রে পথশিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান বলেন, পথশিশুরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে অভ্যস্ত,তাদের মতো করে তারা বন্ধুমহলে চলতে অভ্যস্ত- এই মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। যখন পুনর্বাসন কার্যক্রমগুলো নেয়া হয়, তখন অনেক সময় শিশুবান্ধব হয় না। তার কাছে এটি বন্দিশালার মতো মনে হয়। তার কাছে এটাকে আকর্ষণীয় করতে হবে। শিশুর ভেতর স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে হবে। একটা পর্যায়ে সে নিজেই মনে করবে, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তার একটি ভালো জায়গায় থাকা প্রয়োজন। তখন সে নিজেই সেখানে চলে যাবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় পথশিশুদের সামাজিক সুরক্ষা ও পরিবারে পুনঃএকীকরণ প্রকল্পের আওতায় দুটি ড্রপ-ইন-সেন্টার ও রাতে থাকার জন্য একটি ইমার্জেন্সি নাইট শেল্টার বা রাত্রি আবাস রয়েছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তৌহিদুল হক বলেন, সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পথশিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেও সমন্বয়হীনতার কারণে প্রত্যাশিত অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে প্রকল্পভিত্তিক নানামুখী কার্যক্রমেও শিশু অধিকার সুরক্ষায় কাক্সিক্ষত অগ্রগতি নেই। পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়