শাহজালালে ১২ কোটি টাকার কোকেনসহ ভারতীয় গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

খুলনায় খালেকের হ্যাটট্রিক, বরিশালে খোকন : খুলনায় শান্তিপূর্ণ ভোট, উপস্থিতি কম > তালুকদার আবদুল খালেক ১,৫৪,৮২৫ ভোট, আবদুল আউয়াল ৬০,০৫৪ ভোট

পরের সংবাদ

ইউএনএইচসিআরকে দেয়া সতর্কবার্তা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই প্রত্যাবাসনকেই সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং সে অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নদীর অনেক জল গড়িয়ে সম্প্রতি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে ৪ পরিবারের ২৪ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়াকে যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য ইতোমধ্যে ভাসানচর থেকে ২৪ জন রোহিঙ্গাকে কুতুপালং প্রত্যাবাসন সাইটে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য জরুরি হচ্ছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটা একবার শুরু করা এবং একবার শুরু করতে পারলে, হয়তো সেটা ত্বরান্বিত করা যাবে। পরে মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চাপ প্রয়োগ করা যাবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও শক্তিকে সম্পৃক্ত করা যাবে। কিন্তু সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রত্যাবাসনে রাজি হওয়া ৪ পরিবারের ২৪ রোহিঙ্গাকে খাওয়া-দাওয়া দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইউএনএইচসিআর বা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এসব খবর ফলাও করে প্রচার হওয়ার পর এ প্রশ্নটা বড় করে সামনে আসছে, ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে কিনা কিংবা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে অসযোগিতা করছে কিনা বা তারা সেটা করতে পারে কিনা! এরকম একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশের কান্ট্রিপ্রধানকে তলব করা হয় এবং এ ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ইউএনএইচসিআর যেন তাদের ম্যান্ডেটের ভেতরে থেকে কাজ করে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। কারণ ৬ বছর ধরে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এখানে অবস্থান করছে। আমরা একটি ছোট দলকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় পাঠানোর চেষ্টা করছি। আমরা চাই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোসহ এ কাজে জড়িত সবাই যেন এটিতে সহায়তা করে।
রোহিঙ্গাদের সম্মতির ভিত্তিতে তাদের প্রত্যাবাসন করা হবে কিন্তু যারা যেতে চায়, তাদের ভিন্ন উপদেশ কেউ প্রদান করুক বা প্রভাবিত করুক, এটি সরকার চায় না। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার বাংলাদেশ প্রধানকে আমরা ডেকেছিলাম তাকে মনে করিয়ে দিতে, তার ম্যান্ডেট কতটুকু এবং চুক্তি অনুযায়ী কাজ করার জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে যখন রোহিঙ্গাদের ঢল নামে এবং প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা রোহিঙ্গাদের দেখভাল করার পাশাপাশি তারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায় কিনা, সেটা দেখার দায়িত্ব শরণার্থী সংস্থার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইলে তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা বা তাকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ম্যান্ডেটের মধ্যে পড়ে না। এ কথাটা বাংলাদেশ সরকার তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে।
আমি মনে করি, এ ঘটনা উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অনেক বেসরকারি সাহায্য সংস্থার জন্য অনেক বড় একটা বার্তা দেবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থা এবং দেশীয় অনেক বেসরকারি সাহায্য সংস্থার বিরুদ্ধে প্রত্যাবাসনবিরোধী নানা কর্মতৎপরতার অভিযোগ আছে। আমরা যারা মাঠ লেভেলে কাজ করি, আমরাও খানিকটা এসব ঘটনার সাক্ষী। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ যখন প্রথম দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ২০১৯ সালের আগস্টের ২২ তারিখ দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন অনেক বিদেশি ও দেশি এনজিও রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণা চালায় বলে অভিযোগ আছে। তখন একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। তারপর ২০২০ ও ২০২১ সাল গেল কোভিড-১৯ মহামারির কারণে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ মিয়ানমারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করা অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডিকে হটিয়ে একটি রক্তপাতহীন সামরিক ক্যুর মাধ্যমে মিয়ানমারের মিলিটারি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৪৮০ রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে। তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেয়। রোহিঙ্গারা মুখের কথায় আস্থা আর বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারার কারণে তাদের নিয়ে ২২ সদস্যের একটি বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল রাখাইন ভিজিট করে। তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, কোথায় রাখা হবে, তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে কিনা, তারা যে ভিটা-মাটি রাখাইনে ফেলে এসেছিল সেগুলো ফেরত দেয়া হবে কিনা প্রভৃতি তারা স্বচক্ষে দেখে এসেছে এবং জেনে এসেছে। রাখাইন থেকে ফেরার পর কিছু রোহিঙ্গা সেখানে ফেরত যেতে আপত্তি জানায়। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, তাদের রাখাইনে ফেরত নিয়ে নতুন করে তৈরি ক্যাম্পে রাখা হবে; তাদের ফেলে আসা ভিটা-মাটিতে ফেরত নেয়া হবে না। কিন্তু কিছু কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি হয়েছে, কারণ তাদের বলা হয়েছে, আপাতত তারা রাখাইনের ট্রানজিট ক্যাম্পে থাকবে এবং পরে তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ কথায় কেউ কেউ আশ্বাস রাখছেন আবার কেউ কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে, যারা স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হয়েছে এবং মিয়ানমার যাদের নিতে রাজি হয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের সবার একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকা উচিত। সেখানে বাধা সৃষ্টি করলে সরকারের কঠোর পলিসি থাকাটা জরুরি। তাই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধানকে ডেকে সতর্ক করে দেয়ার ঘটনা সবার জন্য একটা সতর্কবার্তা বটে।
পরিশেষে বলব, এখানে বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন হচ্ছে, বাংলাদেশ গত ছয় বছর ধরে প্রায় ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ৩৪টা অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় দিয়ে বহুবিধ সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হলেও, একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশ জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়নি। আন্তর্জাতিক সব বিধিবিধানের আওতায় বিভিন্ন ধরনের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন শুরু করার একটা পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়নের প্রাক্কালে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার এ ধরনের আচরণ (৪ রোহিঙ্গা পরিবারের ২৪ সদস্যকে খাদ্য সরবরাহ না করা!) কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় (যদিও তারা সেটা অস্বীকার করেছে)। যদিও চীনের মধ্যস্থতায় এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার নানা আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ আছে এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের নানা ব্যাকরণ আছে (যে আলোচনা অন্য একটি লেখায় হবে), তথাপি আমরা চাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অন্তত শুরুটা হোক। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, মর্যাদাকর এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসন কামনা করি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়