পেঁয়াজ-সবজির দামে স্বস্তি, মাছ চড়া

আগের সংবাদ

ভোটের জন্য প্রস্তুত খুলনা কার ভাগ্যে ছিঁড়বে শিকে

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের নির্বাচনের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারের যে কোনো সংস্থা যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাদের ভিসা দেয়া হবে না। এই মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সতর্কবার্তার পরপরই জাতিসংঘ বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে উৎসাহিত করতে (তাদের ভাষায়) গত ২৪ মে শুধু বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। এরপরই এলো জাতিসংঘের দরিদ্র ও মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক অলিভিয়ার ডি শুটারের উদ্বেগ। অলিভিয়ার বাংলাদেশে ১২ দিন সফর করেছেন। এ সময় তিনি মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেও তিনি আশ্রয়শিবির বসবাস অনুপযোগীর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘সুশীল সমাজের ওপর বাংলাদেশের সরকার নানাবিধ প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, ‘এ আইনের অধীনে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগের কারণে আটক করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের নির্বাচন আসন্ন। ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। ভোট যতই কাছে এগিয়ে আসছে, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ততই যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক মহলে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এমনটা হবে, তা সবাই মেনে নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিধরদের এভাবে নাড়া দিতে পারে, তা এত বেশি করে দেখা যায়নি কখনো এর আগে। তবে এর আগেও বারবার বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ আমরা লক্ষ করেছি। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘কফি গ্রুপ’ নামে কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবে আজ যেন বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশিদের চিন্তা-ভাবনা বিগত দিনের সবকিছু ছাড়িয়েই যেতে বসছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তুলকালাম কাণ্ড অন্তত ইতোপূর্বে হয়নি। কিন্তু এবার যেন সেটাও হয়ে গেল। কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কয়েকজন মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের একটি চিঠি লেখা নিয়ে হইচই হয়ে গেল। চিঠিতে সংসদ সদস্যদের দাবি- বাংলাদেশে ভোট আসছে, সেই ভোট শান্তিপূর্ণভাবে করতে হবে। তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ঠিক তারপরই বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন ভিসানীতির পরিবর্তন। গত ১৭ মে পাঁচ মার্কিন সংসদ সদস্য তাদের প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিলেন কিনা, তার কোনো কনফারমেশন আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশে নির্বাচন হচ্ছে, সেই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে হবে- এমন আহ্বান অন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংসদ সদস্যরা তাদের প্রেসিডেন্টকে করতে পারে কিনা, সে প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরিকে আমরা কীভাবে আখ্যায়িত করব- অশোভন না অনুচিত? বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনে বিদেশি চাপ কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নিয়ে নতুন ভিসানীতি কিছুটা চাপের মধ্যেই ফেলবে। এমন একটি ভিসানীতি ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র নাইজেরিয়ার জন্যও ঘোষণা করেছিল। পার্থক্য হলো, নাইজেরিয়ার নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তা ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে দিল যুক্তরাষ্ট্র। আরো একটি বিশেষ দিক হলো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় তারা বিচার বিভাগকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে কেন বিশ্বরাজনীতির তিন বড় শক্তির প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করে, সুষ্ঠু ম্যান্ডেটবিহীন নির্বাচন এ পরিস্থিতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। বিগত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে একটি চাপা বাতাস সব সময়ই আছে। বিরোধী রাজনীতির সরাসরি অভিযোগ দায়ের করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি সংশয় কাজ করছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি সংসদ আসনে কোনো ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে যে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কিংবা রাজনীতির পক্ষ থেকে তার সঠিক উত্তর কখনো দেয়া হয়নি। ফলে এ দুটি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ আজো রয়ে গেছে। ভারত সরকার ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিশেষভাবে সোচ্চার ছিল। কেউ কেউ ভাবেন, ভারত এখন পর্যন্ত তার পুরনো স্থানে দৃঢ়ভাবে আসীন আছে তেমনটা দৃশ্যত মনে হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পরস্পরবিরোধী স্বার্থের কাণ্ডারি। মাঝপথে ভারত। ভারত কোনোভাবেই চাইবে না, বাংলাদেশ চীনের প্রতি ঝুঁকে যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে- বাংলাদেশ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, চীনের সঙ্গে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছে। চীনের সঙ্গে ‘অতি সখ্য’ ভাবটি ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকেই যে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, বাংলাদেশকে তা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। সে সুযোগটাই নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহের চোখ বড় করে তাকাবার অবকাশ পাচ্ছে। ভারতও যেন একটু নড়েচড়ে বসার কথা ভাবছে। তবে ভারতের বর্তমান সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ইতিহাসের সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করছে- এমনটা দুই দেশের নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে অনেক সময়ই প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের বিদেশনীতিতে সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, কারো সঙ্গেই সংঘাত নয়- এই সংকল্প ব্যক্ত আছে এবং বাংলাদেশ আজো তা মেনে চলছে। সে ক্ষেত্রে তারা চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদ কিংবা চীন ও ভারতের বিবাদের জন্য বাংলাদেশ তাদের নিজস্ব বিদেশনীতি প্রভাবিত হতে দেবে না- এটাই সার্বভৌমত্বের স্বাভাবিক অধিকার।
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলীর সুড়ঙ্গপথ, মেট্রোরেলের মতো নজরকাড়া উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। অর্থনৈতিক প্রগতির ফলাও প্রচার আছে তাদের। কিন্তু তার মধ্যেও সেখানে নতুন করে যোগ হয় নির্বাচন নিয়ে একটি নতুন প্রশ্ন- নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো? এ প্রশ্ন যেমন আছে এদেশের মানুষের মনে, তেমনি আছে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানের মতো দাতা দেশগুলোরও। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার নতুন ভিসানীতি নিঃসন্দেহে আগুনে ঘি ঢালার কাজটিই করছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ‘সোশ্যাল ল্যাব’-এর সামাজিক মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্যান্ডার ভ্যানডের লিন্ডেন তার সাম্প্রতিক বই ‘ফুল প্রæফ’-এ ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে ভুল তথ্য বা ফেক নিউজের অসত্যের বিরুদ্ধে জনসমাজে প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি তৈরি করা যায়। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং করপোরেট দুনিয়া এ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করছে। নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্রের সামাজিক ইনজেকশন দেয়া বেড়ে যায়। একটা অলীক সত্য তৈরি করা হয় যেটাতে মানুষের মনে হবে যে, এটাই আসল ঘটনা। অথচ সেটা ফ্যাক্ট নয়, ফিকশন। নির্বাচনের পূর্বে এই অলীক সত্যের আগমন বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে ব্যক্তি মানুষের গবেষণা এবং চিন্তাশক্তি যেহেতু সীমিত, তাই এসব অলীক সত্যের ষড়যন্ত্র এখানে মানুষকে সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। এমন একটি দেশে মার্কিন ভিসানীতির প্রভাব অনেকটাই বেশি হবে। মার্কিন নতুন ভিসানীতি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জাতিসংঘের বিশেষ দূতের ঘোষণা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে পারে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিশ্ব সংস্থার মধ্যে কতটা কাজ করতে পারে ভবিষ্যতে। যদিও আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস পরিলক্ষিত করেছি। তিনি বলেছেন- ‘কারো মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, বাংলাদেশ নিজের পায়ে চলবে। কে আমাদের ভিসা দেবে, কে স্যাংশন দেবে- তা নিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ নেই। দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নাগরিকরা তাদের নিজেদের করণীয়টা সঠিকভাবে করলে কেউ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ঠেকাতে পারবে না।’ কিন্তু আমরা এখনো বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত দ্রুতগতির গণপরিবহন মেট্রোরেলের জানালায় ঢিল ছোঁড়ার ঘটনা ঘটাই। এখনো আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দল আহলাদে আটখানা হয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির সংবাদে।
‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘বাইরে থেকে দেশ যখন অপমানিত হয়, আমাদের দেশের কোনো দুর্বলতা, কোনো ত্রæটি স্বীকার করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। তখন যে কেবল আমরা পরের কাছে মুখরক্ষা করিবার জন্যই গরিমা প্রকাশ করি তাহা নহে, আহত অভিমানে নিজের অবস্থা সমন্ধে আমাদের বুদ্ধিও অন্ধ হইয়া যায়; আমরা যে অবজ্ঞার যোগ্য নহি, তাহা চক্ষের পলকেই প্রমাণ করিয়া দিবার জন্য আমরা একান্ত ব্যগ্র হইয়া উঠি।’

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়