তারেক-জোবায়দার বিরুদ্ধে আরো তিন ব্যাংকারের সাক্ষ্য

আগের সংবাদ

বিপাকে রোহিঙ্গারা, বিপাকে বাংলাদেশ : ভূ-রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে কমল খাদ্য সহায়তা > এক বেলা খাবারের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ কমে ৯ টাকা

পরের সংবাদ

আড়ালে থেকেই চির আড়ালে রাজনীতির ‘রহস্যপুরুষ’

প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই তিনি আড়ালেই ছিলেন। তাকে বলা হতো বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’। তিনি ছিলেন না কোনো সভা সমিতিতে। ছিলেন না কোনো ধরনের নেতৃত্বে। তবে তিনি ছিলেন জাসদ নেতাদের পরামর্শক, ‘তাত্ত্বিক গুরু’। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেও ডাকতেন। সব পরিচয় ছাপিয়ে তার প্রধান পরিচয় তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান। আড়ালে থেকেই চির আড়ালে চলে গেছেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক সিরাজুল আলম খান। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাজনীতির একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ডেএসডি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্র জানায়, সিরাজুল আলম খান বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণ, প্রস্রাবে জটিলতা নিয়ে ২০ মে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তখন ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছিলেন,

কয়েকদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েও উন্নতি হচ্ছিল না সিরাজুল আলম খানের। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
পিতার চাকরির সুবাদে জন্মের কয়েক বছর পর খুলনায় চলে যান সিরাজুল আলম খান। সেখানেই কাটে তার কিশোরকাল। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন। অনার্স ডিগ্রি অর্জনের পর কনভোকেশন মুভমেন্টে অংশ নেয়ার কারণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের অভিষেক ঘটে ১৯৫৯ সালে স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই বছর হন ছাত্রলীগের সদস্য। এরপর ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের দুই সহযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ১৯৬২ সালে গড়ে তোলেন গোপন সংস্থা ‘নিউক্লিয়াস’।
জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করতে ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করেন।
এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অপরাপর ছাত্র নেতাদের সঙ্গে মিলে গড়েন মুজিব বাহিনী। এই বাহিনীর সরকারি নাম বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স। এর প্রধান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আর উপপ্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি কখনো নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।
সিরাজুল আলম খান কখনো জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না। আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি চলে যায় পাকিস্তানপন্থায়। এ সময় থেকেই রাজনীতিতে অপাংক্তেয় হয়ে উঠতে শুরু করেন সিরাজুল আলম খান। আর রাজনীতি থেকে তার চিরবিদায় রচিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর, যখন কর্নেল তাহেরের হাত থেকে পাল্টা অভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমানের হাতে চলে যায় দেশের সামরিক ক্ষমতা।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালে জিয়ার আমলে আবার গ্রেপ্তার এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৯২ সালে বিদেশে যাওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।
জাসদের দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, সিরাজুল আলম খানের মরদেহ বিকালে হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুলে নেয়া হয়েছে। সেখানে গোসল শেষে রাতে শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। আজ শনিবার সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে জানাজা শেষে নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে পুনরায় জানাজা শেষে বেগমগঞ্জের আলীপুরে মায়ের কবরে তাকে দাফন করা হবে।
এদিকে, সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এক শোক বার্তায় সিরাজুল আলম খানের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
শোক জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-স্বজনদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোকবার্তা দিয়েছে বিএনপি। গতকাল এক শোকবার্তায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও দেশের কিংবদন্তি রাজনীতিক সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে তার নিকটজনদের মতো আমিও গভীরভাবে সমব্যথী। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তার অবদান ছিল অসামান্য। নেতৃত্বে না থাকলেও তিনি অন্তরালে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি মুক্তিযুদ্ধের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও গুণী রাজনীতিককে হারালো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়