‘প্রস্তাবিত বাজেট তামাকমুক্ত দেশ গড়ার অন্তরায়’

আগের সংবাদ

রাজনীতির ছায়ায় ব্যবসার জাল : জামায়াতের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক দেশ জুড়ে বিস্তৃত, গোপনে চলছিল সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, এবার প্রকাশ্যে মাঠে নামার হুংকার

পরের সংবাদ

যে মৃত্যু রোধে পদক্ষেপ নেই : বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে > ইয়াসিনের মতো ৪০ শিশু হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন > রোগে নয়, পানিতে ডুবে বেশি মৃত্যু

প্রকাশিত: জুন ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : দিগন্ত জোড়া ধান ক্ষেত, পাকা-আধা পাকা ঘর, সামনে কিংবা পেছনে ২০ মিটারের মধ্যে পুকুর- আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। ঘরের সঙ্গে পুকুর শুধু মাছের জোগানদাতাই নয়, রোজকার গোসলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পানির চাহিদাও মেটায়। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পুকুরগুলো একেকটা মরণ ফাঁদ। এসব মরণ ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরা। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) সবশেষ জরিপ (২০১৬ সালে) অনুযায়ী, বছরে প্রায় ১৪ হাজার ৪৩৮ জন ১৮ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০ শিশু কুঁড়িতে ঝরে যাচ্ছে। এমনকি রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে দেশটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি বলে মনে করেন গবেষকরা। সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো, শিশুদের সাঁতার শেখানো, অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে এলাকাভিত্তিক দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন এবং গ্রামে মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকার সময় শিশুদের নজরে রাখা- এই চার কৌশলে এই নীরব ঘাতক প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্লæমবার্গ ফিলানথ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বা সিআইপিআরবি এবং আইসিডিডিআরবি,র এক গবেষণা মতে, জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টারের (আইডিআরসি) তথ্য মতে, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় নয়; বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। কিন্তু এটা রিপোর্ট হয় না। পুলিশের খাতায়ও এ নিয়ে তথ্য থাকে না। এদিকে ডিপথেরিয়া, পোলিও, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য শিশুরোগে পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্য অর্জিত হলেও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
মায়ের শূন্য বুকে দগদগে ঘা : ১২ মে, ২০২৩। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ইটবাড়িয়া গ্রামের জিয়া কলোনির দুই ভাইবোন শারমিন (৫) ও রুমান (৭) চাচাতো বোন মরিয়মকে (৮) নিয়ে বাড়ির পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুকুরে গোসল করছিল। পুকুরে গোসল?ই কাল হলো তাদের। পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে তিন ভাইবোনের। মর্মান্তিক এ ঘটনায় এখনো ভারি এলাকার বাতাস। দুই সন্তানকে একসঙ্গে কবরে শুইয়ে বাকরুদ্ধ বাবা-মা।
প্রায় সাড়ে চার বছর আগে বাড়ির পুকুরে ডুবে মারা যায় চার বছরের ছোট্ট ইয়াসিন। সরজমিন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ১০ নম্বর বালিয়াতলীর কোম্পানিপাড়ার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ইয়াসিনের মা কোহিনূর বেগম এখনো সেই পুকুর পানে চেয়ে থাকেন শূন্য দৃষ্টিতে। সন্তানের কথা বলতেই ভেঙে

পড়েন কান্নায়। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও আঁচলে (যেখানে ছোট শিশুদের সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রাখা হয়) গিয়েছিল শিশুটি। সেখান থেকে ফিরে মায়ের কাছে বায়না করে শাক দিয়ে ভাত খাওয়ার। মা কোহিনূর তখন রান্নায় ব্যস্ত। ছোট্ট ইয়াসিন নিজেই গোসলে ব্যবহৃত মগে করে পুকুরের পাশের পুঁইতলা থেকে কয়েকটি পাতা তুলে মাকে দেয়। এরপর বাবা কামাল ফিদার পাশে বসে সিঙ্গাড়া খাওয়া শেষে একাই ছোটে গোসলে। বাবা তখন ব্যস্ত জ্বরে আক্রান্ত ইয়াসিনের দেড় বছরের ছোট বোনটিকে নিয়ে।
একপর্যায়ে ইয়াসিনের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কোহিনূর খোঁজ করেন ছেলের। উত্তরে বাবা জানান, কিছুক্ষণ আগেই পুকুরঘাট থেকে কথা বলেছে ইয়াসিন। একথা শুনে মা ছুটে যান পুকুরে। গিয়ে দেখেন ইয়াসিনের মগ, জুতো সব পুকুরপাড়ে সাজানো। নেই শুধু ইয়াসিন। সন্তানের এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিজেকেই দোষারোপ করেন মা। বললেন, আমার বাবা কত কষ্ট পেয়ে মারা গেছে, পানিতে ডুবে! আমার বাবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে না জানি কত কষ্ট হয়েছে। শাক খেতে চেয়েছিল। খেতে পারল না।?
শীর্ষে চট্টগ্রাম : গবেষণা অনুযায়ী, এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি মোট শিশুমৃত্যুর ৫৮ শতাংশই পানিতে ডুবে হয়। সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটার মধ্যে মায়েদের ব্যস্ততার সময় ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে। এসব মৃত্যুর ৮০ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পুকুর, ডোবা ও বালতির পানিতে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে গেøাবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এবং গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মারা গেছে ১ হাজার ১৩০টি শিশু। প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ২৮২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া রংপুর বিভাগে ১৬০, ঢাকা বিভাগে ১৪৯, বরিশালে ১৩১, রাজশাহীতে ১১০, ময়মনসিংহে ১০৪, খুলনা বিভাগে ১০৩ ও সিলেট বিভাগে ৯১ জন মারা যায়।
সমাধান কী? : ৫ বছরের নিচের শিশুদের সঠিক তত্ত্বাবধান; ৫ বছরের বেশি বয়সিদের সাঁতার শেখানো; কমিউনিটি সচেতনতা তৈরি করা; কর্মব্যস্ত অভিভাবকদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার যেখানে কেয়ার গিভারের তত্ত্বাবধানে শিশুরা থাকবে এবং বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিআইপিআরবি কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের জন্য এলাকাভিত্তিক দিবাযতœ কেন্দ্র ‘আঁচল’ এবং ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুদের সাঁতার ও উদ্ধার কৌশল শেখাতে ‘সুইমসেফ’ নামের দুটি কার্যক্রম পরিচালনা করে কার্যকর ফল পাওয়া গেছে। বরিশালের তিনটি উপজেলায় ‘ভাসা’ প্রকল্পের আওতায় ওই দুই কার্যক্রমের সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ডুবে মৃত্যুর উপক্রম হওয়া যেসব শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের দিকেও নজর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, পানিতে ডোবার পর পর ২৩ সেকেন্ড অক্সিজেনের অভাব শিশুদের ওপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সম্পৃক্ত করলে কার্যকর ফল আসবে।
গেøাবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া ম্যানেজার সারওয়ার ই আলম বলেন, সচেতনতার অভাব পানিতে ডুবে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এমনকি বালতি কিংবা পাতিলের পানিতে ডুবেও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বেশির ভাগ দেখা যায় জোড়া মৃত্যুর ঘটনা। সেক্ষেত্রে শিশুটি যখন ডুবে যেতে থাকে তখন তাকে রক্ষা করতে বয়সে তুলনামূলক বড় অপর যে শিশু (তার ভাইবোন বা আত্মীয়) যায় তাকে সে এমনভাবে আকড়ে ধরে যে দুজনের কেউ-ই বাঁচতে পারে না। এক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই। ৫ বছরের শিশুকে নজরে রাখা, ৫ বছরের ওপরের শিশুকে সাঁতার শেখানোর বিকল্প নেই।
সরকার কী করছে : সংশ্লিষ্টদের মতে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর অনেক ঘটনা নথিভুক্ত হয় না। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুকে এখনো বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোন মন্ত্রণালয় কী কাজ করবে, তা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগ পানিতে ডোবা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মকৌশলের খসড়া তৈরি করেছে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৩০৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযতœ কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার-সুবিধা প্রদান’ প্রকল্পের ৮০ ভাগ অর্থই দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাকি অর্থ আসবে ব্লæমবার্গ ফিলানথ্রোপিজ ও রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট (আরএনএলআই) নামের দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে। এ প্রকল্পে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুর সুরক্ষায় দিবাযতœ কেন্দ্র, ওই বয়সি দুই লাখ শিশুর জন্য সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা, ছয় থেকে ১০ বছর বয়সি তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো, দুই লাখ অভিভাবককে শিশুর লালন-পালনে সক্ষমতা বাড়ানো ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্য রয়েছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমির অধীনে ২৭১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ‘ইনট্রিগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন এন্ড সুইম-সেইফ ফ্যাসিলিটিজ’ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
এছাড়া সারাবিশ্বে পানিতে ডুবে যাওয়াকে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এবং পানিতে ডুবে প্রতিটি মৃত্যুই যে প্রতিরোধযোগ্য তা তুলে ধরতে ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তুলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়