ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাব কমিশন গঠনের প্রস্তাব বাংলাদেশের

আগের সংবাদ

চিকিৎসার ফি নির্ধারণ কতদূর? : বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নেন ৮৬ শতাংশ মানুষ, স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে

পরের সংবাদ

রেলওয়ের দেড় লাখ কোটি টাকার ৬৫ প্রকল্প : বাড়েনি যাত্রীসেবার মান > শতাধিক স্টেশন ও ৮০টি লোকাল ট্রেন বন্ধ

প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ৬৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যার মধ্যে প্রায় ডজনখানেক মেগা প্রকল্প। বিদেশ থেকে এসেছে ৫ শতাধিক নতুন এসি, নন এসি বগি ও নতুন ইঞ্জিন। কিন্তু এত বিনিয়োগের পরেও রেলে যাত্রীসেবার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বাড়েনি। এত উন্নয়নের জোয়ার বইলেও বন্ধ হয়েছে শতাধিক রেল স্টেশন, বাড়েনি এক কিলোমিটারও রেললাইন। উপরন্তু লাফিয়ে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। লেভেলক্রসিংয়ে প্রাণহানিতে রেকর্ড গড়েছে রেলওয়ে। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলওয়ের সেবার মান কমছে। কয়েকটি দূরপাল্লার ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হলেও প্রায় ৮০-৯০টি লোকাল ও কমিউটার ট্রেন অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে গেছে। জনবলের অভাবে বন্ধ রয়েছে শতাধিক রেল স্টেশনও। এর মধ্যে বহু স্টেশনে ট্রেন থামে না বলে অভিযোগ। প্রায় প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনের সময় বাড়ানো হয়েছে, যাকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলে মনে করছেন তারা। আর ২৫-৩০ শতাংশ ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকেট কালোবাজারী যেন রেলওয়ের পিছু ছাড়ছেই না, অগত্যা অনলাইন টিকেটিং এর ওপর ভরসা করে চলেছে রেলওয়ে। এছাড়া প্রতি মাসে ১-২টা করে দুর্ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। লেভেল ক্রসিংগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ। গত এক বছরে ৫ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তারপরেও বাংলাদেশ

রেলওয়ের টনক নড়ে না। বর্তমান সরকারের তিন টার্মে গত ১৪ বছরে সাড়ে ১৪ হাজার কর্মী নিয়োগ হলেও শূন্য পড়ে আছে ২৫ হাজার কর্মীর পদ। নিয়োগে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির মামলায় তা বন্ধ আছে। নতুন প্রকল্প ৩ বছরের স্থলে ১৩ বছরেও শেষ হয়না। তার ফলে মেরামত হয় না পুরনো, ভাঙা রেললাইন, রেলব্রিজ-কালভাট। মান্ধাতার আমলের ইঞ্জিনকোচ দিয়ে কোনো রকমে চলছে ট্রেন, লোকসানে চলা সংস্থাটির ভরসা বিদেশি বিনিয়োগ।
রেল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার বিগত বছরগুলোতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তার বেশির ভাগ অবকাঠামো উন্নয়ন, রেলের ইঞ্জিনকোচ কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতার পেছনে গেছে। আর ওই সময়ে ট্রেনে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে দুই দফা ভাড়াও বাড়ানো হয়। বেশ কিছু দুর্নীতিও ধরা পড়ে রেলওয়েতে। যেমন- বিভিন্ন স্টেশনে আসবাবপত্রসহ সরঞ্জাম কেনাকাটায়, কোরিয়ান হুন্দাই কোম্পানি থেকে ১০টি ইঞ্জিন কেনায় দুর্নীতি। তারও আগে ডেমু কেনা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয় রেলওয়েতে। ইঞ্জিন- কোচ মেরামত নিয়ে দুর্নীতি তো আছেই, যার বেশ কয়েকটি দুদকে তদন্তাধীন।
রেল পরিচালনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলার হার ছিল ৮৭ শতাংশ। এরপর থেকেই পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। গত অর্থবছরে সময়ানুবর্তিতার হার নেমে দাঁড়ায় ৮২ শতাংশে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ট্রেন বন্ধ হওয়ার আগে সময়সূচি মেনে ট্রেন চলার নি¤œধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমানে ৭০-৭৫ শতাংশ ট্রেন সময়সূচি অনুযায়ী চলাচল করে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।
কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দিনের পর দিন অবহেলা, পরিচর্যা ও মনিটরিংয়ের অভাব, রেল কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতাহীনতার কারণে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে রেল লাইন সব স্তরে ভঙ্গুর অবস্থা। যার ফলে ট্রেনের গতি কমিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় বাড়ানো হয়েছে। এদিকে বর্তমানে ট্রেনে ব্যবহৃত ৭১ শতাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। অর্ধেকের বেশি কোচ বেহাল। রেললাইন ও সেতুর অর্ধেকই জরাজীর্ণ। অধিকাংশ স্টেশনে নেই পর্যাপ্ত কর্মী, কর্মীর অভাবে বন্ধ হয়েছে ৮০টি রেল স্টেশন। বন্ধের পথে আরো বেশ কয়েকটি বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, যে কটি আন্তঃনগর ট্রেন চলে সেখানে টিকেটবিহীন যাত্রীদের ঠেলায় বৈধ যাত্রীদের নাভিশ্বাস। ট্রেনগুলোতে বাথরুম-টয়লেট ব্যবহার অযোগ্য।
অন্যদিকে, গত ১০ বছরে দুই দফা ভাড়া বাড়ানো হয়, যার লক্ষ্য ছিল লোকসান কমানো। কিন্তু গত অর্থবছরেও রেলওয়েতে পরিচালনা লোকসান (অপারেটিং লস) ১ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে কখনো মুনাফা করেনি। পাঁচ বছর ধরে লোকসানের পরিমাণ প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। রেলওয়ে প্রায় ৫-৬ হাজার কোটি টাকা লোকসানের বোঝা নিয়ে যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কর্মীদের বেতন ভাতা ও পেনশন রেলের ঘাড় থেকে নামানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।
রেলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের পরও তেমন সুফল না পাওয়ার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, উন্নয়নকাজে দুর্নীতি-অপচয়, পরিকল্পনায় গলদ ও অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এর ফলে নির্মাণকাজে সময় বেশি লাগছে, অযৌক্তিক ব্যয় বাড়ছে। এছাড়া দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পরামর্শক থেকে ঠিকাদার নিয়োগ করার সঠিক মূল্যমান নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আসলে রেলওয়ে পুরো সরকারি সংস্থা হওয়ায় এখানে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ বেশি। পৃথিবীর সব সংস্থা পিপিপি অনুযায়ী চলে। এখানে বিমান ও নৌ পথে সরকারি-বেসরকারি দুটো খাতকে প্রাধান্য দেয়া হলেও রেলওয়ে খাতকে কেন সরকারি মালিকানায় রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এখানেও বেসরকারি মালিকানা যুক্ত করতে হবে। তাহলে সেবার মান বাড়বে, প্রতিযোগিতা বাড়বে। তাছাড়া আমরা রেলওয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছি। কিন্তু প্রায় সব নতুন প্রকল্পে ও কেনাকাটায় মনোযোগ বেশি। তাছাড়া কর্মীরা মনে করে তারা মাস গেলে বেতন-বোনাস পাবেন, বেতন বাড়বে, তাই দায়সারা কাজ করেন। আর কর্মকর্তারা নতুন প্রকল্প এলে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে তাদের সেদিকে নজর বেশি। তিনি বলেন, রেলওয়ের প্রতিটি সেক্টরের কর্মীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। আর প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, বিএনপি সরকার রেলওয়েকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। তারা গোল্ডেন হ্যাণ্ডসেকের মাধ্যমে ১০ হাজার কর্মীকে ছাটাই করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রেলওয়েকে প্রাধান্য দিতে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেল মন্ত্রণালয়কে আলাদা করেন। এরপর থেকে আমরা রেলের উন্নয়নে বিপুল অর্থ খরচ করে বহু ছোট-বড় প্রকল্প নিয়েছি। যার মধ্যে পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার, খুলনা- মোংলা, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন প্রকল্প, ইঞ্জিন ও বগি কেনা ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। আগামী জুন-জুলাইয়ে মেগা প্রকল্প তিনটি উদ্বোধন হবে। বেশ কয়েকটি ট্রেন বাড়ানো হয়েছে। টিকেট কালোবাজারী রোধে এনআইডি সমন্বিত অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোর দিক দিয়ে এখনো রেলওয়ে কিছুটা পিছিয়ে। তবে আমরা ২০৩০ সাল পর্যন্ত রেলওয়ের জন্য একটা মহাপরিকল্পনা নিয়েছি। সারা দেশে ডাবল লাইন হলে, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মিত হলে এবং লোকবল নিয়োগ করতে পারলে রেলের চেহারা পাল্টে যাবে।
এদিকে রেলে ছোট-বড় সেতু আছে ৩ হাজার ১৭৪টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০৬টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ বলে রেলওয়ের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। গত এক দশকে মাত্র ৪৬টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে। বর্তমানে রেলে ২৬৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে মিটারগেজ ১৭৮টি ও ব্রডগেজ ৯০টি। রেলের ইঞ্জিনের সাধারণ আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) ধরা হয় ২০ বছর। সে হিসাবে বর্তমানে রেলের ৭১ শতাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। গত এক দশকে বহু অর্থ খরচ করে ৯১টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৭৭টি পুরনো স্টেশন মেরামত ও পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। অথচ স্টেশন ভবন তৈরির পর লোকবলের অভাবে সেগুলো অকেজো পড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, বেশ কয়েক বছর আগে থেকে রেলওয়েতে নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনায় সংস্থাটির বিরুদ্ধে ২৫-২৬টি মামলা চলমান ছিল। ফলে নিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে। রেলওয়েতে অনুমোদিত জনবল ৪০-৪৫ হাজার । কিন্তু বর্তমানে আছে ২৬ হাজারের বেশি। ট্রেন পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার চালক ও স্টেশন মাস্টার। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে জনবলের অভাবে ৪৬৬টি স্টেশনের মধ্যে ১০৪টিই বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশে সব মিলিয়ে ৩৫৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এদের মধ্যে বেশ কিছু ট্রেন অনিয়মিত। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ১০৪টি। ঢাকা-কলকাতা-শিলিগুড়ি (ভারত) রুটে চলে তিনটি ট্রেন। বাকি সব কটি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন হিসেবে চলাচল করে। যার মধ্যে স্টেশন ব্যবস্থাপণায় পর্যাপ্ত কর্মী না থাকা, ইঞ্জিন ও রেক স্বল্পতায় বন্ধ রয়েছে বা অনিয়মিত প্রায় ৮০-৯০টি লোকাল-কমিউটার ট্রেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়