ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাব কমিশন গঠনের প্রস্তাব বাংলাদেশের

আগের সংবাদ

চিকিৎসার ফি নির্ধারণ কতদূর? : বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নেন ৮৬ শতাংশ মানুষ, স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে

পরের সংবাদ

নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় : ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলায় সাংবাদিক শামস গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য নিয়ে করা একটি সংবাদের জের ধরে সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলার বাদী ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া। এর আগে, গতকাল বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন আমবাগান এলাকার ভাড়া বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে শামসকে তুলে নেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তিনি হলি আর্টিজান হামলায় নিহত সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল করিমের ছোট ভাই।
এদিকে শামসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও উঠেছে সমালোচনার ঝড়। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ ও এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশ। এটিকে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং অবিলম্বে শাসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সাংবাদিক শামসুজ্জামান একজন মানুষের উক্তি, সত্য কথা তুলে ধরেছেন। এটি করে তিনি কী অপরাধ করেছেন, সেটি বোধগম্য নয়। শাসুজ্জামানের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
এদিকে শামসকে গ্রেপ্তারের সাফাই গেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসের দিন যেভাবে অসত্য বক্তব্যটি প্রচার করা হয়েছে, তাতে যে কেউ সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায় তাহলে পুলিশ কিন্তু ব্যবস্থা নিতেই পারে। তবে, একজন সাংবাদিককে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যেতে হবে কেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তেজগাঁও থানায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন একটি ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করে। একই সঙ্গে সংবাদটি তাদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হয়। সংবাদটিতে দেখা যায়, একটি শিশু ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাকির হোসেন নামে ওই শিশুটি বলেছে- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’
এজাহারে আরো বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদটি ভাইরাল হয়ে যায়। দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত হাজার হাজার মানুষ তাদের ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রিনশটসহ সংবাদটি শেয়ার করেন। এই ঘটনায় মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের সোনালি গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে দেশের জনগণসহ বহির্বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ৭১ টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, প্রথম আলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করেছে। যে শিশুটির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার নামপরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পত্রিকায় বলা হয় শিশুটির নাম জাকির হোসেন, কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায় ওই শিশুর নাম সবুজ আহমেদ। তার বাড়ি সাভার থানার কুরগাঁও পাড়ায়। তার বাবা একজন রাজমিস্ত্রি, মা মুন্নী বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে মেজো সন্তান সবুজ। প্রথম আলোর তথ্যে বলা হয়েছে, সে দিনমজুর। কিন্তু সাত বছরের শিশু সবুজ আহমেদ প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে এবং স্কুল শেষে মাঝেমধ্যে ফুল বিক্রি করে।
এজাহারে বলা হয়, শামসুজ্জামানের প্রস্তুত করা প্রথম আলোর ওই সংবাদে উল্লেখ করা বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে ওই শিশুটির নয়। শিশুটি জানিয়েছে, প্রথম আলোর সাংবাদিক শিশুর হাতে ১০ টাকা দিয়ে এই ছবি তুলেছে। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন উদ্দেশ্যে একটি অশুভ চক্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এই মিথ্যা সংবাদ তৈরি ও পরিবেশন করে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. ইমরান হোসেন মোল্লা বলেন, প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান বলেন, মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। আইনি পদক্ষেপ তারাই নেবে। আসামিও তাদের কাছে রয়েছে।
এদিকে সাংবাদিক শামসকে তার বাসা থেকে বুধবার ভোর ৪টার দিকে সিআইডির পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়। এ সময় সিআইডির পরিচয় দেয়া ব্যক্তিরা সাধারণ পোশাকে ছিলেন। শামসের বাসা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমবাগান এলাকায়। বাসাটির নিচতলায় মাকে নিয়ে গত এক বছর ধরে ভাড়া থাকেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ভোর ৪টার দিকে তিনটি গাড়িতে মোট ১৬ জন শামসের বাসার সামনে যান। তাদের মধ্যে ৭-৮ জন বাসায় ঢোকেন। একজন শামসের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তার ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যান। বাসায় ১০-১৫ মিনিট অবস্থান করার পর তাকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যান তারা। বটতলার নূরজাহান হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন, একজন নিরাপত্তা প্রহরী ও শামসসহ মোট ১৯ জন ব্যক্তি সেহেরি করেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে বটতলা থেকে তারা আবার শামসের বাসায় যান। এ সময় আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু মন্ডল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খবর পেয়ে স্থানীয় এক সংবাদকর্মীও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
ওই সাংবাদিক জানান, শামসের বাসায় এসে জব্দ করা মালামালের তালিকা করেন সিআইডির পরিচয়ে আসা ব্যক্তিরা। এ সময় শামসকে জামাকাপড় নিতে বলা হয়। কক্ষের ভেতরে দাঁড় করিয়ে তার ছবিও তোলা হয়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে আবার তারা বের হয়ে যান।
এ বিষয়ে শামসের ভাবী হলি আর্টিজান হামলায় নিহত পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউলের স্ত্রী উম্মে ইসলাম বলেন, কী কারণে তাকে নিয়ে গেছে, কী তার অপরাধ কিছুই জানি না। মঙ্গলবারও শামসের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তখনো এ বিষয়ে শামস আমাকে কিছু বলেনি। এদিকে শামসকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার খবর শুনে উৎকণ্ঠায় কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা করিমন নেসা। আবেগাপ্লুত হয়ে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমার স্বামী নিছ, এক সন্তানরে নিছ। আমার এই সন্তানকে বুকে ফিরায় দাও আল্লাহ, আমি আর কিচ্ছু চাই না। আমার সন্তান ঘরে থাকব, আমি ওর মা ডাক শুনব।’ মামলার খবর শুনে করিমন নেসা বলেন, ‘আমার পোলায় কি চোর না ডাকাত? ওরে কীসের মামলায় দিছে? আর ওরে ধইরা নিল কেন, আমার ছেলেরে বললে তো নিজেই যাইত, এমনি কইরা ওরে তুলে নিল ক্যান?’
সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ প্রকাশ : প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮/এর ২৫(২), ২৬(২), ৩১(২) এবং ৩৫(২) ধারায় মামলা ও আটকে সম্পাদক পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ ইতোমধ্যেই সাংবাদিকতাসহ বাকস্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সাংসদদের নিকট হতেও আইনটির পরিবর্তন, পরিমার্জন, বিয়োজন ও সংযোজনের বিষয়ে নানা ধরনের পরামর্শ, সুপারিশ ও উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।
আইনটি তৈরির সময় থেকেই সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিকরা এ আইনের বিষয়ে উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। আইনমন্ত্রী এই আইনের বিভিন্ন রকম অপব্যবহার এবং সেই প্রেক্ষিতে আইনটি সংশোধনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও এই আইনের মাধ্যমে সংবাদকর্মী ও মুক্তমত প্রকাশকারী ব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
কোনো সংবাদে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ ও মামলা করতে পারেন। কিন্তু সেটি না করে সরাসরি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের হচ্ছে। তাই সাংবাদিকতার স্বাধীন ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্রুত সংশোধনসহ সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসসহ সব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি করছে সম্পাদক পরিষদ। একই সঙ্গে এই আইনে কেউ গ্রেপ্তার বা আটক থাকলে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করছে।
এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের উদ্বেগ : গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটির সভাপতি মোজাম্মেল বাবু বলেন, গণমাধ্যমের জন্য মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা সবার কর্তব্য। প্রথম আলো যদি সাংবাদিকতার নীতিবিরুদ্ধ কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে, তাহলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারে। প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি হওয়া উচিত বলে মনে করে এডিটরস গিল্ড।
উল্লেখ্য, গত ২৬ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদে একজন দিনমজুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে উদ্ধৃত করা হয়, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ সেই সংবাদের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ছিল, যে গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও ওই প্রতিবেদনের সমালোচনায় মুখর হন। পরে প্রথম আলো প্রতিবেদনটি সংশোধন করে এবং শিরোনাম বদলে দেয়। পাশাপাশি তাদের সোশাল মিডিয়ায় দেয়া পোস্টও প্রত্যাহার করা হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়