কাগজ প্রতিবেদক : পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর উদযাপন করল সারাদেশের মানুষ। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দেয়া বীর শহীদদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে পুরো জাতি। সেই সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে অসা¤প্রদায়িক এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়। জোরালো দাবি ওঠেছে, ২৫ মার্চের ভয়াল গণহত্যার কালরাতসহ দীর্ঘ ৯ মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের। জনগণের এই দাবির সঙ্গে একাত্ম সরকারপক্ষ জানিয়েছে, গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের চেষ্টা চলছে।
একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করতে অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে অট্টহাসি হেসেছিল পাক সেনাবাহিনী। তারা ভেবেছিল ২৫ মার্চের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিরোধ গড়ার সাহস পাবে না বাঙালি। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে গণহত্যার পরদিন ২৬ মার্চই রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত স্বদেশ গড়ার সংগ্রাম শুরুর দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করছে বাংলাদেশ। ভোরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেখানে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায় এবং বিউগলে বেজে উঠে করুণ সুর।
শ্রদ্ধা জানানোর পর স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রদ্ধা জানানোর পর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুল-উল আলম হানিফ তার সঙ্গে ছিলেন।
এরপর শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। কেন্দ্রীয় চৌদ্দ দলের পক্ষ থেকে মাহবুব-উল-আলম হানিফের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর ফুল দেন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু
এবং সংসদের হুইপ। এরপর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নেতৃত্বে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সন্তানরা।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের শ্রদ্ধা জানানো শেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় স্মৃতিসৌধ। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানার নিয়ে দলে দলে জনস্রোত প্রবেশ করে স্মৃতিসৌধে। বড়দের হাত ধরে পতাকা হাতে ছোট্ট শিশুরাও শ্রদ্ধা জানায়। বেশিরভাগের পরনে লাল-সবুজ জামা।
বিভিন্ন সংগঠন ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে শ্রদ্ধা জানানোর কণ্ঠে ছিল জয় বাংলা স্লোগান। মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা। সকাল ৭টার দিকে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটক।
দিনটি উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর নানা সাজে সাজানো হয়। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি ইট ঘষে-মেজে ব্যবহার করা হয়েছে খয়েরি ও সাদা রং। আর আলোকসজ্জা করা হয়েছে সৌধ চত্বর এলাকায়। পানি পাল্টিয়ে নতুন করে পানি দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে কৃত্রিম হ্রদটি। এলাকার আকর্ষণ বাড়াতে প্রস্তুত রাখা হয় পানির ফোয়ারাটিও। ভোর থেকে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণজুড়ে দেশাত্মবোধক গানের সুর বাজতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডিতে আসেন জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রথমে সরকারপ্রধান হিসেবে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। এ সময় সামরিক বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান তিনি। এ সময় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, শাজাহান খান, আব্দুর রহমান, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এস এম কামাল হোসেন, আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, শফিউল আজম নাদেল, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধু ভবন ত্যাগ করার পর আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগের তরফ থেকেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি : এদিকে স্বাধীনতা দিবসে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি আরো শক্তিশালী হয়েছে। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের মুখে মুখে ছিল এই দাবি। বীর মুক্তিযোদ্ধা সফের আলী বলেন, আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি। আমাদের যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তা সর্বোচ্চ। আমরা আত্মমর্যাদাশীল যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম আজ সেটি অনেকাংশেই পূর্ণ। আজ আমার শহীদ ভাইদের যেভাবে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে তা দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেছে। এখন প্রয়োজন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আমি বিশ্বাস করি, সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই দাবি পূরণ হবে। শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তান যা বলে বিএনপি তাই বলে, কারণ তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় উজ্জীবিত, এই অপশক্তিকে পরাস্ত করতে হবে।
গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের চেষ্টা চলছে : রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও চলছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা ও বিজয় উদযাপনের পাশাপাশি সারা বিশ্বের কাছে আজকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করেছিলেন তাদের আমরা বিচারের মধ্যে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করেছি এবং কয়েকজন এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদেরকেও আনার জন্য আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা যেখানে যেখানে আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং আমরা চেষ্টা করছি অচিরেই তাদের নিয়ে আসার জন্য এবং আমাদের এই ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য।
প্রথমে পুলিশ শহীদ স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (সুরক্ষা) আমিনুল ইসলাম, আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ কামরুল হাসান, ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ও র?্যাবের মহাপরিচালক খুরশীদ আলমকে সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা জানান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরপর একে একে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি মনিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামানসহ নেতারা, ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন) নেতারা পৃথক পৃথকভাবে রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।