প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
কাগজ প্রতিবেদক ও গাজীপুর প্রতিনিধি : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের করা মামলায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ঢাকাই সিনেমার আলোচিত নায়িকা মাহিয়া মাহি। সৌদি আরব থেকে ওমরা শেষে গতকাল শনিবার দুপুরে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে চিত্রনায়িকাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে দুপুর দেড়টার দিকে তাকে গাজীপুরের আদালতে তোলা হলে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর হাকিম মো. ইকবাল হোসেন। তবে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে অন্তঃসত্ত্বা এই চিত্রনায়িকার জামিনের আদেশ দেন একই বিচারক। এরপর জামিনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান মাহি।
তার আইনজীবী আনোয়ার সাদত সরকার বলেন, দুপুরে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়ার সময় তারা জামিনের আবেদন করার সুযোগ না পেলেও পরে আদালত চলার মধ্যেই জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত দুটি মামলায় জামিন মঞ্জুর করেছেন। তিনি আরো বলেন, জামিন আবেদনে আমরা বলেছি, তিনি (মাহি) মামলার কথা শুনেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি সন্তানসম্ভবা- এ বিষয়টিও আবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরে বিচারক জামিন মঞ্জুরের পরপরই কাগজপত্র কারাগারে পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাহি ফেসবুক লাইভে পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তোলায় গত শুক্রবার রাতে মাহি ও তার স্বামী রকিব সরকারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। বাসন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রোকন মিয়া বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
এছাড়া জমি দখলের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে হুকুমের আসামি করে আরো একটি মামলা করেন স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। গতকাল দুপুরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় মাহি গ্রেপ্তার হলেও সৌদি আরব থেকে না ফেরায় রকিবকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে ইসমাইল হোসেনের মামলায় আরো ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জিএমপি। মাহি গ্রেপ্তারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর তিনি (মাহি) পুলিশের বিরুদ্ধে যে ঘুষের অভিযোগ তুলেছেন, সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
অন্যদিকে মাহির ফেসবুক লাইভের পর সংবাদ সম্মেলন করে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন জমিসংক্রান্ত মামলার বাদী স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, মাহির স্বামী রকিব তার প্রায় সোয়া ১১ শতাংশ জমি দখল করে গাড়ির শো-রুম করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তিনি এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।
এদিকে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মাহিয়া মাহিকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানোয় তার ভক্তরা বিস্মিত, ক্ষুব্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেকে। আবার বিরূপ মন্তব্যও করছেন নেটিজেনরা। তবে মাহি যে অঙ্গনের মানুষ, সেই ঢালিউড পাড়ায় বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। গ্রেপ্তারের খবরে চাপা উত্তেজনার আভাস টের পাওয়া গেলেও মুখ খোলেননি তেমন কেউই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তেমন প্রতিবাদ দেখা যায়নি অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছ থেকে। অবশ্য নির্মাতা শিহাব শাহীন, রেদওয়ান রনি ও আশফাক নিপুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির তেমন কিছু করার নেই জানিয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তারের গণমাধ্যমকে বলেছেন, আসলে এটা হলো রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। ওর বিরুদ্ধে বাদী হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাংগঠনিকভাবে আমরা কী করতে পারব, বুঝতে পারছি না। কারণ আইন তো সবার ঊর্ধ্বে। শুধু এটুকুই বলব যে, মাহির যে শারীরিক অবস্থা, যতদূর জানি সে এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা; যতটা সম্ভব ওকে
যাতে ভালোভাবে রাখে।
গত শুক্রবার ভোরে স্বামীর সঙ্গে ওমরাহ পালনরত মাহি সৌদি আরবের মক্কা শহর থেকে ফেসবুক লাইভে রকিবের গাড়ির শো-রুম ভাঙচুর ও হামলার অভিযোগ করেন। এ সময় তিনি দাবি করে বলেন, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের পূর্ব পাশে ‘সনিরাজ কার প্যালেস’ নামে তার স্বামীর একটি গাড়ির শোরুম রয়েছে। সেখানে দুর্বৃত্তরা হামলা করেছে। তারা শোরুমের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে আসবাব, দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ার ভাঙচুর করেছে। শোরুমের সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছে। অফিসকক্ষ তছনছ করে টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে।
ইসমাইল হোসেন ওরফে লাদেন ও মামুন সরকার নামে দুজনের নেতৃত্বে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মাহি। এ সময় ফেসবুকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) বিরুদ্ধে দেড় কোটি টাকা ‘ঘুষ’ নেয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি। তার এই অভিযোগকে মিথ্যা দাবি করে রাতেই মামলা দেয় পুলিশ।
চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে গ্রেপ্তারের পর জিএমপি কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, মাহিয়া মাহি জমিসংক্রান্ত ঘটনায় জিএমপির বিষয়ে ফেইসবুক লাইভে মিথ্যা মন্তব্য করেছেন। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করার অধিকার রাখেন না। মাহির বিরুদ্ধে পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে। তার প্রতিপক্ষের লোকজন জমিসংক্রান্ত ঘটনায় অইনশৃঙ্খলা অবনতি সংক্রান্ত মামলা করেছেন। মাহিকে বেলা পৌনে ১২টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে শুক্রবার রাতে মাহির প্রতিপক্ষের দেয়া মামলায় অভিযুক্ত সাজ্জাদ হোসেন সোহাগ, আশিকুর রহমান, ফাহিম হোসেন হৃদয়, জুয়েল রহমান, জমশের আলী, মোস্তাক আহমেদ, খালিদ সাইফুল্লাহ জুলহাস, সুজন মন্ডল ও মাহবুব হাসান সাব্বির নামে আরো ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, জমি-জমাসংক্রান্ত ঝামেলার বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে শুক্রবার ভোরে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুপক্ষই পালিয়ে যায়। এ সময় ইসমাইল হোসেনসহ তার পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তারা চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে আহত ইসমাইল বাদী হয়ে ২৮ জনের বিরুদ্ধে বাসন থানায় একটি মামলা করেছেন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
জিএমপি কমিশনার আরো বলেন, মাহির স্বামী রকিব সরকারের বিরুদ্ধে এর আগে অস্ত্র, হত্যা ও ধর্ষণের তিনটি মামলা রয়েছে। ওই মামলাগুলোতে কেউ সাক্ষী দেননি। কিন্তু ঘটনা সত্য ছিল। এখন মামলাগুলো পুনরায় তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি রকিব সরকারের আরেক ভাই গাজীপুরের পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি ও দখলের ঘটনা ঘটিয়ে আসছিল। গাজীপুরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহাসড়ক থেকে অননুমোদিত ও অবৈধ যানচলাচল বন্ধ করেছে পুলিশ। এতে সড়কে স্বাভাবিক গতি ফিরে এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনের পর পুলিশ মাহিকে গাজীপুর মহানগর হাকিম আদালতে পাঠায়। মহিলা পুলিশের পাহারার মধ্যে কালো রংয়ের বোরকা পরিহিত মাহিকে তোলা হয় মহানগর হাকিম মো. ইকবাল হোসেনের আদালতে। আদালত পুলিশের কর্মকর্তা উপকমিশনার আহসানুল হক জানান, প্রথম দফায় মাহিয়া মাহিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক। রিমান্ডের কোনো আবেদন ছিল না, তার পক্ষে কেউ জামিনও চাননি। তাই তাকে জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর তার পক্ষের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন একই আদালত।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, জিএমপি কমিশনার মোল্লা……… নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লাইভে এসে মাহিয়া মাহি কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, এজন্য মামলা হয়েছে। আমি সবকিছু জানি না, শুনেছি। বিষয়টি ভালো করে জেনে বলতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মাহিয়া মাহি যে অভিযোগ (ঘুষ নেয়ার) করেছেন সেটা সঠিক কিনা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চিত্রনায়িকা মাহি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
উল্লেখ্য, রাজশাহীর মেয়ে মাহির সিনেমায় অভিষেক ২০১২ সালে জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রযোজনায় ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। এরপর এক দশকে ‘অগ্নি’, ‘কী দারুণ দেখতে’, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘লাইভ’ এর মতো বেশ কয়েকটি ব্যবসাসফল সিনেমার নায়িকা হন তিনি। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ২০২১ সালে ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ও গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। এরপরই রাজনীতির পথে পা বাড়ান বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। স¤প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচন করেননি। গত সেপ্টেম্বরে মাহি জানান, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় থাকার মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে ৫ ঘণ্টা কারাবাস করতে হলো তাকে।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।