অর্থনৈতিক অঞ্চলে সৌদিকে জমির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

আগের সংবাদ

চিকিৎসা গবেষণায় আগ্রহ কম : বরাদ্দ, অবকাঠামো সীমিত > প্রণোদনা স্বল্পতা > প্রাইভেট প্র্যাকটিসে মনোযোগ বেশি

পরের সংবাদ

বেইজিংয়ে সৌদি-ইরান চুক্তি : মধ্যপ্রাচ্যে তৎপর চীন ওয়াশিংটনে অস্বস্তি

প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : আঞ্চলিক দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়া দুটি বৈরী প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ যখন শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যায়, তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সেটিকে স্বাগত জানানোটাই রেওয়াজ। ইরান এবং সৌদি আরব যখন ৭ বছর পর গত শুক্রবার তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে রাজি হলো, তখন বাকি বিশ্ব তাই করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতারা বিবৃতি দিয়ে এই সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ব্যতিক্রম ছিল দুটি দেশের প্রতিক্রিয়া- যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দ্ব›েদ্ব দুটি দেশই ইরানকে চরম বৈরী হিসেবে দেখে, ইরানও এই দুটি দেশকে তাদের দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য এক নম্বর হুমকি বলে বিবেচনা করে।
বেইজিংয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রতিদ্ব›দ্বী দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪ দিনের আলোচনার পর শুক্রবার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন চুক্তির ঘোষণা

আসে। চুক্তির আগে এ নিয়ে আলোচনার কোনো খবর প্রকাশ্যে আসেনি বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‘সতর্ক ভাষায়’ স্বাগত জানালেও এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন এটি টিকবে কিনা। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, ‘ইরান তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করবে কিনা, সেটা দেখতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া যাই হোক, বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, চীনের মধ্যস্থতায় ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতা ওয়াশিংটনে মারাত্মক অস্বস্তি তৈরি করেছে।
ইসরায়েল অবশ্য প্রকাশ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো জানায়নি। কিন্তু ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, তেহরান এবং রিয়াদের মধ্যে এই সমঝোতা তাদের মোটেই খুশি করেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং সৌদি আরবের দ্ব›েদ্বর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে ইরান-সৌদি দ্ব›দ্ব মারাত্মকভাবে সহায়ক হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলও এই দ্ব›েদ্বর সুযোগ নিয়ে ‘শত্রæর শত্রæ আমাদের মিত্র’ নীতি অনুসরণ করে ইরানের বৈরী কিছু উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
স্বাভাবিকভাবেই ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে যদি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেটি উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন বিন্যাস তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল- দুটি দেশই মনে করে এই নতুন পরিস্থিতি কোনোভাবেই তাদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।
ওয়াশিংটন কেন অস্বস্তিতে : বেইজিং থেকে ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতার খবর যখন প্রথম এলো, সেটি ওয়াশিংটনে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং শঙ্কা তৈরি করে। এর মূল কারণ অবশ্য ইরান-সৌদি আরব সমঝোতা নয়, তাদের অস্বস্তি এবং শঙ্কার মূল কারণ এই সমঝোতায় চীনের ভূমিকা পালন।
মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে সব ধরনের সংঘাতে রেফারির ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাদের সেই প্রভাব বলয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যেভাবে চীন ঢুকে পড়ছে- সেটি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য সাংঘাতিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে গত কিছুদিন ধরে মারাত্মক টানাপড়েন দেখা যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে চীনের এই ভূমিকাকে বিশ্বজুড়ে মার্কিন একাধিপত্যের প্রতি আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে বর্ণনা করছেন কেউ কেউ।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো জেফরি ফেল্টম্যানের ভাষায়, বেইজিংয়ের এই ভূমিকাকে ‘বাইডেন প্রশাসনের মুখে চপেটাঘাত’ এবং চীন যে এক উদীয়মান শক্তি- সেভাবেই দেখা হবে।
পরমাণু আলোচনা : এমন এক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি হলো, যখন তেহরানের পারমাণবিক বোমা অর্জন আটকাতে ২০১৫ সালে তাদের সঙ্গে হওয়া ৬ বিশ্বশক্তির চুক্তি পুনরুজ্জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বছরের ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির গতি বাড়িয়েছে।
ইরানজুড়ে সা¤প্রতিক বিক্ষোভে কর্তৃপক্ষের সহিংস দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তেহরানের ওপর কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের এই প্রচেষ্টা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ব্রায়ান কাতুলিস বলছেন, সুন্নি ও শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্স্থাপনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে থমকে থাকা আলোচনা নতুন করে শুরুর ‘সম্ভাব্য একটি পথ করে দিতে পারে’, কেননা এবার তারা রিয়াদকেও সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে ধরতে পারবে। তিনি বলেন, সৌদি আরব ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যদি দুই দেশের মধ্যে নতুন চুক্তিটিকে অর্থবহ ও প্রভাবশালী করতে হয়, তাহলে রিয়াদকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে তার উদ্বেগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে। না হলে এই চুক্তি কেবলই নামকাওয়াস্তে থেকে যাবে।
শুক্রবারের চুক্তি ইয়েমেনে শান্তি টেকসই করার সম্ভাবনাও বাড়াচ্ছে; ২০১৪ সাল থেকে দেশটিতে চলে আসা সংঘাতকে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত বছরের এপ্রিলে ইয়েমেনের বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, অক্টোবরে চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদ বাড়াতে পক্ষগুলোর মধ্যে আর কোনো নতুন চুক্তি না হলেও এখন সেখানে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত রয়েছে।
ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত গেরাল্ড ফিয়েরেস্টেইন বলছেন, কিছু না পেয়ে রিয়াদ এই চুক্তির পথে যেত না, হতে পারে সেটা ইয়েমেনে বা অন্য কোথাও, যা দেখা শক্ত।
চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা : বহু বছর ধরেই চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম ঘোষিত স্তম্ভ ছিল ‘অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো’। কিন্তু সা¤প্রতিক বছরগুলোতে চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে যে নতুন ঝোঁক, তাতে এই নীতির ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘাতে তাদের সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করতে দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসনের একজন শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ড্যানিয়েল রাসেল বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, ওয়াশিংটনের জন্য সেটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন, যে সংঘাতে চীন কোনো পক্ষ নয়, সেখানে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে এভাবে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা খুবই ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে কি এ রকমই আমরা দেখব? চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন মস্কো সফর করবেন, তখন সেখানে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার যে চেষ্টা চীন করবে, এটা কি তার পূর্বাভাস?
চীনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে অনেকে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল ম্যাককল তো চীনকে ‘শান্তির মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে মানতেই নারাজ। তার ভাষায়, ‘চীন কোনো দায়িত্বশীল শক্তি নয় এবং একজন নিরপেক্ষ এবং ন্যায্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না।’
এ ধরনের মধ্যস্থতায় চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে কোনো কোনো বিশ্লেষক বিশ্ব বলয়ে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেন, ‘কোনো লুকোছাপা না করে বেইজিং যে বার্তাটা এখানে পাঠাতে চাইছে তা হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিপরীতে চীন এক উদীয়মান এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থিত হতে চাইছে।’
যেভাবে সম্পর্কের অবনতি : ২০১৬ সাল থেকে তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ রয়েছে। ওই বছর সৌদি আরব এক দিনে ৮১ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, যাদের বেশির ভাগ ছিলেন শিয়া মুসলিম। শিয়া স¤প্রদায়ের প্রভাবশালী এক ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা। ওই ঘটনার জেরে ইরান ও সৌদি আরব কূটনৈতিক সম্পর্কে ইতি টানে।
এছাড়া ৮ বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইয়েমেন যুদ্ধে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে ইরান ও সৌদি আরব। ইয়েমেন সরকারের পক্ষে রয়েছে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। তাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন ইরানসমর্থিত হুতি যোদ্ধারা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়