তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী : কয়লা বিদ্যুৎ চালু হলে থাকবে না ঘাটতি

আগের সংবাদ

মিঠামইনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সুধী সমাবেশে বক্তৃতা : নৌকায় ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

মূল্যস্ফীতি-ডলার সংকটই চ্যালেঞ্জ > ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর : আমদানিনির্ভর সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : বিশ্ব অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এক বছর পার করেছে। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন অর্থনীতিকে চাঙা করার নানা উদ্যোগ নেয়- তখনই শুরু হয় এই যুদ্ধ। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় দেশে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতির এ পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে পুরোপুরি দায়ী করা যাবে না। এজন্য অভ্যন্তরীণ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রেও আরো বিচক্ষণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে চলমান বাণিজ্য সংকোচনের কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যায়। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ও রাশিয়া যেসব খাদ্যপণ্য বড় আকারে রপ্তানি করে তার মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, গম, সূর্যমুখী তেল এবং বার্লি। যুদ্ধের কারণে এসব খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহে ঘাটতি হয়। ফলে দাম অনেক বেড়ে যায়। গম সংকটের কারণে আটা-ময়দার পাশাপাশি বেকারি পণ্যের দামও হু হু করে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা সহসা কাটছে না। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে জটিলতা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ঘাটতি বেড়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তা, সরকারের বাড়তি ব্যাংক ঋণ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগাম টেনে ধরা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া, পুঁজিবাজারের নি¤œগতি এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় অর্থনীতি স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এতে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

দেশে বেড়েছে আয়-ব্যয়ের বৈষম্য।
অর্থনীতির ওপরে চাপ কমাতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় সরকার। ঋণ পেতে আইএমএফের দেয়া শর্ত পূরণ করতে গিয়ে এরই মধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। আবার দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। শিল্প খাতে এখনো গ্যাস সংকট চলছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অনেক দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে। তবে অর্থনীতির স্বার্থে সরকারকে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সরকারের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের তুলনায় খারাপ। এ অবস্থা বদলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
তবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের সংকট মোকাবিলায় আমরা প্রথমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য আমদানির চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আবার রপ্তানি, আমদানি ও রেমিট্যান্সের জন্য ডলারের আলাদা দাম নির্ধারণ করা হলেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও এ পর্যন্ত কত টাকা সাশ্রয় হয়েছে, তা জানা নেই। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে এর প্রভাব দেখছি না। যেমন চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে শুধু বিদেশি সহায়তার অর্থ কমানো হয়েছে। এটি উল্টো কাজ হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব নেই। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব থেকে যাবে।
যুদ্ধের প্রভাবে নাস্তানাবুদ হয় ভোজ্যতেলের বাজারও। বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ইউক্রেন ও রাশিয়া সরবরাহ করে। বাংলাদেশে সূর্যমুখী তেল তেমন আমদানি না হলেও যুদ্ধ অন্য সব ভোজ্যতেলের বাজারও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে মূলত পাম এবং সয়াবিন তেল ব্যবহার হয়। যুদ্ধের ফলে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে পাম তেল এবং সয়াবিন তেলের চাহিদা ও দাম দুটোই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল এবং এসব সারের একটি বড় অংশ আমদানি করা হয় রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। বাংলাদেশ পটাশ সারের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ১২ লাখ টনের বেশি সার আমদানি করে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ায় দেশটি থেকে সার আমদানি করা যাচ্ছে না। যার ফলে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে আমিষের একটি বড় চাহিদা পূরণ হয় ফার্মের মুরগি থেকে। মুরগির দামও এখন নাগালের বাইরে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়াকে দুষছেন। দেশের পোল্ট্রি ফিডের সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬% ভুট্টা সরবরাহ করে। এর মধ্যে বাংলাদেশও চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে ইউক্রেন থেকেই। যুদ্ধের কারণে যেহেতু ইউক্রেন থেকে ভুট্টা সরবরাহ করা যাচ্ছে না সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মুরগি ও ডিমের দামে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম উচ্চহারে বাড়তে থাকে। কারণ রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ। করোনা মহামারি চলাকালে আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারের নিচে যুদ্ধ শুরুর পর তা ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকে। এর ফলে বাংলাদেশেও সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশে বাড়ানো হয়। নতুন দর কার্যকর করা হলে গণপরিবহনের ভাড়াও বেড়ে যায়। তেলের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে, অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশে দেখা দেয় ডলার সংকট। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের অর্ধেকের বেশি বা ৬৪ শতাংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতিতে একটি মন্দাভাব চলে আসায় ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে বাংলাদেশে নতুন অর্ডারের হারও কমেছে। তাছাড়া চিকিৎসা বা শিক্ষার জন্যও দেশের বাইরে যেতে পোহাতে হচ্ছে নানা ঝামেলা।
যুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রভাব খুব সহসাই কাটছে না। প্রধানমন্ত্রী তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হাতে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী দরকার না হলে নতুন প্রকল্পে হাত না দেয়ার নির্দেশও দেন তিনি। আগামী জুনে ঘোষণা হবে নতুন বাজেট। তাছাড়া চলতি বছরই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন বাজেট ও নির্বাচনকে সামনে রেখে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়াই এখন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বিশ্বের অন্য দেশের মতোই বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কঠিন অবস্থার মুখোমুখি রয়েছে। কারণ, পণ্যমূল্য বাড়ার ফলে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ডলারের দাম বাড়ায় এতে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। হঠাৎ টাকার পতন বেশি হওয়ায় সমস্যাটা বেড়েছে। অন্য দেশগুলো আস্তে আস্তে নিজস্ব মুদ্রার মান কমিয়েছে। বাংলাদেশ তা না করে নিয়ন্ত্রণ করে ধরে রেখেছে। ধীরে ধীরে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে হঠাৎ করে সংকট বাড়ত না। অর্থাৎ আমাদের ম্যানেজমেন্টের সমস্যার জন্য হচ্ছে। অনেক দিন ধরে আমাদের পলিসিগত কোনো পরিবর্তন না হওয়াতে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তৈরি সংকটের বেশিরভাগই কমে এসেছে। গ্যাসের দাম, তেলের দামও কমে গেছে। খাদ্যপণ্যের দামও প্রায় আগের অবস্থানে চলে এসেছে। সমস্যা হচ্ছে আমাদের। আমরা কারেন্সি ২৫ শতাংশ ডেফ্রিসিয়েট করেছি। সুতরাং এটা আমাদের দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য আমদানি করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ডলার নেই। আমদানি নির্ভর দেশ হিসেবে পণ্য আমদানি করতে বাধাগ্রস্ত হলে দাম তো বাড়বেই।
তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান অনিশ্চয়তা সহসাই কাটছে না। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে জটিলতা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ঘাটতি বেড়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তা, সরকারের ব্যাংকঋণ বৃদ্ধি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগাম টেনে ধরা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, শিল্প খাতে পুঁজিপ্রবাহ হ্রাস, পুঁজিবাজারের নি¤œগতি এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় অর্থনীতি স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এসব প্রবণতা মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলায় সাধারণ মানুষের আয়-ব্যয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে বড় রকমের পার্থক্য।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়