ঝালনাথ খানাল : পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থে হুকুমজারি করছে

আগের সংবাদ

কে পাচ্ছেন ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার

পরের সংবাদ

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার ৬২০টি। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৩৪ হাজার ৭৯৯টি বিদ্যালয়ে শুধু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। তবে ৩৭ হাজার ৬৭২ জন শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কর্মরত আছেন। তবে ভৌত অবকাঠামোগত বিষয়টি বিবেচনা করলে দেখা যায়, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনগুলোর যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান সরকার কানেক্টিং রোড করে দিচ্ছেন। এর ফলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করাটা সহজ হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকটা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, প্রায় শিক্ষকই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। প্রতিটি শিক্ষকই পিটিআই কোর্স সম্পন্ন। প্রতিটি উপজেলাকে ক্লাস্টার জোনে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রতিটি ক্লাস্টারে দক্ষ প্রশিক্ষকের মাধ্যমে ক্লাস্টারের আওতাধীন বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কারিকুলাম এবং সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদানের বিষয়টি ক্লাস্টার অনুসারে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের তুলনায় শতগুণ সমৃদ্ধ। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এত সমৃদ্ধ হওয়ার পরও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গ্রাম ও শহরের মানুষ নিজেদের ছেলে-মেয়েদের পড়াতে চায় না। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন গড়ে উঠেছে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কিন্ডারগার্টেন নামে বাণিজ্যিক কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার কিন্ডারগার্টেনগুলোর ভৌত অবকাঠামো নেই বললেই চলে। টিনের বেড়া ও টিনের ছাপড়া দিয়ে একেকটি ঘর তৈরি করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বানানো হয়েছে। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনগুলোতে খেলার মাঠ নেই। মোট অঙ্কের টিউশন ফি আদায় করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলত এই বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী ধরনের শিক্ষা দেয়া হয় তা কি কেউ মনিটরিং করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে? এদের কি সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে বা সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে কি এই বেসরকারি বাণিজ্যিকভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে? টিউশন ফি এই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছামাফিক নির্ধারণ করে থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা নীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার শিরোনামে বলা হয়েছে অনান্য গ্রহণযোগ্য উপায়ের সাহায্যে ছবি, রং মডেল, গল্প ছড়া কবিতার মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু করা। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যমটি বাংলা কথাটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও বলা হয়েছে দেশজ আবহ এর মাধ্যমে শিক্ষণ পদ্ধতির কথা। মূল বিষয়টি হচ্ছে এ দেশের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের প্রভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতিটি পরিচালিত হবে। অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের ভাষা হবে বাংলা এবং প্রযোজ্য বিশেষ অঞ্চলে বাংলাদেশি অদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা। এই শিক্ষা নীতির সঙ্গে দেশে চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষা নীতিতে বলা আছে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পরবর্তী হবে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানাধীন গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে রয়েছে তিনটি- শ্রেণি প্লে, কেজি ও নার্সারি। এই বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারিভাবে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যকৃত বইয়ের বাইরে নিজেদের ইচ্ছামাফিক পাঠ্যপুস্তক এবং সিলেবাস তৈরি করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা এবং সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে উর্দু, আরবি ভাষা শেখানো হয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ এবং পদ্ধতি সর্বক্ষেত্রে এক অভিন্ন হওয়া প্রয়োজন। তাহলে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কী পড়ানো হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার এনায়েতপুর এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেন। যা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত। টিনের বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করা হয়েছে। এই এলাকাটিতে শীত ও গরম উভয়ই বেশি। শীতের দিনে টিন ঠাণ্ডা হয়ে যায় আর গরমের দিন তা বেশি গরম হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘরগুলো কি শিশুদের পাঠদানের উপযোগী কক্ষ? দ্বিতীয় বিষয়টি আরো মারাত্মক তা হলো, ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে নছিমন টাইপের গাড়ি বানানো হয়েছে, এই গাড়িতে করে শিশুদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে আনা-নেয়া করা হয়। এই চিত্রটি শুধু গোমস্তাপুরে নেয়ামতপুরে না, এরকম দেখা যায় নেয়ামতপুরের শিবপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহনে শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাতায়াতের গাড়ি বানানোর বিষয়টি বিআরটিএর দেখা দরকার। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে পাড়া মহল্লাভিত্তিক শিশু জরিপ করা হয়। তাদের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার উপযোগী শিক্ষার্থী নির্ধারণ করাও হয়ে থাকে। দেশে গ্রাম ও শহরে জনসংখ্যা অনুপাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরকার প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মানসম্মত পাঠদানের এবং শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার গ্রহণ উপযোগী করে দক্ষ করা হয়। তারপরও কেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন? বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যোগ্যতার বিষয়টিও প্রশ্নসাপেক্ষ। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কী কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তা কি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তদারকি করে? এবং এই প্রশিক্ষণ কতটা শিশুদের শিক্ষা প্রদানের মতো উপযোগী তা কি সরকার কর্তৃক মনিটরিং হয়? তাছাড়া বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেসব বই পড়ানো হচ্ছে তা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির জন্য কতটা উপযোগী। প্রাথমিক শিক্ষাটা প্রতিটি শিশুকে তার পরিবেশ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাতৃভাষায় পড়ানো উচিত। দেশের কিন্ডারগার্টেন, আরবি, উর্দু এবং ইংরেজি ভার্সন পড়ানো প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কি দেশের শিক্ষানীতি অনুযায়ী উপযোগী? দেশের শিক্ষানীতিটা প্রাথমিক পর্যায়ে এক ও অভিন্ন হওয়া দরকার। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এই কিন্ডারগার্টেনে পড়–য়াদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামাকাওয়াস্তে শিক্ষার্থী দেখিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হয়। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই এই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন। দেশে কতগুলো বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বাংলা নিউজ ২৪-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য মতে, এই জেলায় কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬৪১টি, যদিও বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী এক হাজারের অধিক হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার হিসাবটিকে গড়ে ধরে নিলে সারাদেশে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হবে প্রায় ৬৪ হাজার। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমান্তরালভাবে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তাহলে কি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গুণগত মান খুবই খারাপ।
যদি তাই না হয় তাহলে কেন সমসংখ্যক বেসরকারিভাবে বাণিজ্যিকভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়–য়াদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। আরেকটি বিষয়ও দেখা যায় তা হলো, অভিভাবকরা একজন শিক্ষার্থীকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাম লিখিয়ে রেখে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠান। এই বিষয়গুলো চুলচেরা বিশ্লেষণের ও তদারকির প্রয়োজন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। সরকারের বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ জনগণেরই অর্থ। অপরদিকে সমসংখ্যক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যয় প্রায় সমানই হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়টাও আসে জনগণের কাছ থেকে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে। বাস্তব প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে যে, জনগণের অর্থে সরকারি-বেসরকারিসহ সব প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে জনগণের অর্থ দুদিকে ব্যয় হচ্ছে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে কি? দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাটা হলো মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি স্তর। সুতরাং এই ভিত্তিমূল এক ও অভিন্ন ধারায় গড়ে তুলতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে না। তাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হোক প্রাথমিক শিক্ষার মূল কেন্দ্র।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়