যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্প ও টেলিভিশন মিডিয়া

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্প সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জেনে নেয়া দরকার ইতিহাস কী। আমরা সবাই জানি, ইতিহাস মানুষের অতীত কর্মকাণ্ডের বিবরণের সমাহার, যার প্রমাণাদি বর্তমান। আর বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্পের বৃহদাংশজুড়ে রয়েছে বাংলার লোকশিল্পের উপাদান। ঐতিহাসিকরা যেসব উপাদানের প্রমাণাদি ব্যবহার করে সত্য আবিষ্কার করেছেন, সেসব শিল্পই হচ্ছে লোকশিল্প। টেলিভিশন হচ্ছে একটি মাধ্যম বা মিডিয়া। এই টেলিভিশন মিডিয়া নানাভাবে এ দেশে তথা এই উপমহাদেশসহ পৃথিবীর সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়ে খুলে দিয়েছে নতুন দিগন্ত। টেলিভিশন মিডিয়া যে শুধু বিনোদনমাধ্যম, তা বলা যাবে না। এই মাধ্যম শিক্ষা, বিজ্ঞান, উদ্ভাবনী, মানুষের সামাজিক অবস্থা, খেলাধুলা- এমনকি রন্ধন শিল্পকেও করেছে বিকশিত। বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্পের কথা বলতে হলে বাংলার ঐতিহাসিক আদিবাসী জীবনযাত্রা থেকে শুরু করতে হবে। তাদের আচার-আচরণ, উৎসব, তাদের ব্যবহারিক জীবনের জিনিসপত্র, উৎপত্তিস্থল, সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। যেমন- আলপনা, দেয়ালচিত্র, কালীঘাটেরপট, মুখমুখোশ, পাটশিল্প, চটশিল্প, ধাতুশিল্প, তা¤্রশিল্প, লৌহশিল্প, দারুশিল্প, কারুশিল্প ইত্যাদি। যা কিনা আমাদের প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্পকে ধারণ করে। বাংলার লোকশিল্পের একটি অংশ হচ্ছে আলপনা।
আলপনায় ব্যবহার করা হতো সামান্য রং। সেই বানানো রঙের বাটি থেকে আঙুল ডুবিয়ে নিমেষেই সৃষ্টি করা হতো অসামান্য নকশা শোভিত চিত্রপট। ঘরের দেয়াল, চৌকাঠ আর দৈনন্দিন গৃহস্থালির নানা সরঞ্জাম যেমন- কুলা, ডালা, সরা, পিঁড়ি, হল ক্যানভাসে এসব নকশা করা হতো। এসব চিত্রকর্মের সৃষ্টির প্রেরণা আসে প্রকৃতির নানা উপকরণ থেকে। যেমন- সূর্য, চাঁদ, নদী, ফুল, পাতা আর সুন্দর সাজানো সংসারের স্বপ্ন থেকে। মানব জীবনের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। যুগ যুগ ধরে প্রবাহমান এই ইতিহাসের সন্ধান মেলে তার সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে। আলপনা এমনই এক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী লোকশিল্প। ঐতিহ্যিক শিল্প হচ্ছে সম্পূর্ণ স্ত্রী-আচারকেন্দ্রিক পার্বণ, পূজা অনুষ্ঠান প্রভৃতির সঙ্গে মাঙ্গলিক উপাচার যুক্ত। সারা বছরের পুরো সময়টা ধরেই বাংলার বধূ অর্থাৎ মেয়েরা সংসারের সমৃদ্ধি কামনায় আয়োজন করত নানা ধরনের ব্রত অনুষ্ঠান। আলপনা এসব পূজা-পার্বণ বা ব্রতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যের মতো ব্রতকেন্দ্রিক আলপনার বিষয়টিও লক্ষ করার মতো। শাস্ত্রীয় ব্রতই হোক বা অশাস্ত্রীয় মেয়েলি ব্রতই হোক। ব্রতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলপনা ছাড়াও বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকা হতো বরের এবং কনের বাড়ির উঠানে। এসব আলপনায় মধ্যখানে পদ্ম ফুলের মোটিফ এঁকে তার চারপাশে অন্য সব মোটিফ আঁকা হতো। এছাড়া বিয়ে বাড়িতে বরের পিঁড়িতেও যে আলপনা আঁকা হতো তার মাঝখানেও পদ্মফুল একে তার পাশ দিয়ে অন্য কোনো ফুলের মোটিফ চারধারে আঁকা হতো শঙ্খলতা খুন্তিলতার মাধ্যমে। এই শিল্পকলায় নারীসমাজ তার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টির আনন্দ উজাড় করে দিত। দৈনন্দিন প্রয়োজন থেকেই আলপনা শিল্পকলার সৃষ্টি, তাই শুধু সৌন্দযসৃষ্টির জন্য দেয়া আলপনার সঙ্গে নান্দনিক পার্থক্য তো থাকবেই। ঐতিহ্যিক শিল্পের পরিচয় দিতে বাংলার লোকশিল্পের পর্যালোচনাই যথেষ্ট উৎসের সন্ধান দেয়।
ঐতিহ্যিক শিল্প নিয়ে লিখতে হলে লোকশিল্পকে নানাভাবে বিচার-বিবেচনা ও অনুসন্ধান করে তার পর্যালোচনার পর তা প্রচার উপযোগী করে আগামী প্রজন্মকে জানানো বিশেষভাবে প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শিল্পটি টেলিভিশন মাধ্যমে গত ৫৮ বছরে উপমহাদেশে তেমন কৃতিত্বের ছাপ রাখতে পারেনি, তবে একবারে ফেলে দেয়ার মতো অবস্থাতেও নেই। আমাদের দেশে টেলিভিশন মাধ্যমের পদচারণা বেশ শক্ত, আমরা জানি, ইতোমধ্যেই ৪০টির বেশি চ্যানেল ঐতিহ্যিক শিল্পের প্রচার নানাভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
এ দেশের ঐতিহ্যিক শিল্প সাহিত্যের ভাণ্ডারবিশাল, তার আরেকটি অংশ হলো পটচিত্র বা কালীঘাটের পট। কালীঘাটের পটের ইতিহাস বহুপ্রাচীন। সমাজের বিভিন্ন পরিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছে এই শিল্প ও শিল্পীদের কথা, তাই লিপিবদ্ধ আছে সুপ্রাচীনকালের সংস্কৃত সাহিত্যে। এসব ঐতিহ্যিক শিল্পের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি মিডিয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ টেলিভিশনের মাধ্যমে। যদি এই মিডিয়ার প্রসার না ঘটত, তাহলে কোনোভাবেই আমরা হয়তো অতি সহজে এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প সম্পর্কে জানতে পারতাম না। সে কারণেই ঐতিহ্যিক শিল্প ও টেলিভিশন মিডিয়া একে অপরের পরিপূরক।
পুরাণে বর্ণিত কাহিনীতে, স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচী ও বিশ্বকর্মার সন্তান এই চিত্রকরেরা একসময় মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকর, সূত্রধর, স্বর্ণকার, তন্তুবায় ও কাংসকার প্রভৃতি বিশ্বকর্মার অন্যান্য সন্তানদের মতোই সামাজিকভাবে সমমর্যাদা ভোগ করলেও পরবর্তীকালে ঐতিহ্যবিরোধী চিত্র অঙ্কনের অপরাধে সমাজচ্যুত হন। পটুয়াদের মূল জীবিকা ছিল দেব-দেবীর কাহিনী, বিশেষত মঙ্গলকাব্যের কাহিনীর পট এঁকে, বিশ্লেষণধর্মী গান বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শুনিয়ে, পটচিত্র দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে তাদের কাছ থেকে পয়সা রোজগার করতেন। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এই পটুয়ারা ধর্মপ্রচারের কাজেই লিপ্ত ছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুসলমান শাসকরাও পটুয়াদের তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এই সময় মুসলিম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যেসব পট অঙ্কিত হতো, তা অনেকটাই হিন্দুধর্মের পটের মতোই ‘মঙ্গল পট’ ধর্মী। যে পটুয়ারা এই কাজে প্রথম দিকে এসেছিলেন তারা ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মিশ্র জীবিকার মানুষ। প্রথম দিকে মাটির তৈরি দেব-দেবীর মুখাবয়ব পটে অঙ্কন করে, তাদের সামনে অঙ্কিত পটগুলো দেখিয়ে নিরাকার দেবতাকে উপস্থিত করেছিল সাকার মূর্তিতে। পট আঁকার পাশাপাশি পুতুল তৈরি, কৃষিকাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, সাপখেলা দেখানো প্রভৃতি কাজে তারা ছিলেন দক্ষ। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ঘরানার মানুষ একত্রিত হওয়ায় তাদের শিল্পে ঘটেছিল নানাবিধ আদানপ্রদান। এভাবে গ্রাম্য পটুয়ারা তাদের জীবিকার পথ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম দিয়েছিলেন এক নতুন যুগের-কালীঘাট পটের যুগ।
পটচিত্র বাংলার চিরন্তন লোকশিল্পের অন্যতম ধারা। বাংলা ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যেও এই শিল্প ধারার সন্ধান পাওয়া যায়। এসব তথ্যাদি আমরা মিডিয়ার বদৌলতেই জেনেছি। পটশিল্প সাধারণত বিনোদন ও লোকশিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হলেও পটশিল্পীরা তা থেকে আয়-রোজগার করত। এই শিল্পকর্ম যারা করতেন, তাদের বলা হতো পট্টিদার বা পট্টিকার। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পটচিত্রকে অন্যতম প্রাচীন চিত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যযুগের একাধিক গ্রন্থে পটুয়া বা চিত্র রচনার নানা তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পরাশরস্মৃতি, রূপগোস্বামীর ‘বিদগ্ধ-মাধব’ নাটক প্রভৃতি। আরো বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থের প্রেক্ষাপটে পট সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, নিঃসন্দেহে বোঝা যায় এই শিল্প ধারার প্রাচীনত্ব। পটশিল্পকলার উৎস সন্ধানের ক্ষেত্রে অবশ্যই আদিবাসী সমাজের কোল গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার মধ্যে যাদব পাটকারদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জড়ানো পটের প্রাচীনত্ব জড়িয়ে আছে অঁংঃৎরপ কোল বা খেরোয়াল ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে।
সমাজ বিবর্তনের ধারায় আদিবাসীদের এই ঐতিহ্যিক শিল্পধারাটি পরিশীলিত হয়ে উচ্চতর সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। পটুয়ারা তাদের তৈরি গানের কথার ওপর নির্ভর করে মূর্তি তৈরি করতেন। চরিত্র অনুযায়ী অবয়বে রং ব্যবহার হতো। এছাড়া যেসব মোটিফ তৈরি করা হতো, সেই শিল্পকর্মে শিল্পী তার নিজের ইচ্ছা মতো রং ব্যবহার করতেন। এসব লোকশিল্পকর্মের শিল্পী ও শিল্পকর্ম হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বেশি করে টেলিভিশন মিডিয়ার পর্দায় তুলে ধরতে হবে। টেলিভিশন মিডিয়া এখন মানুষের আস্থার জায়গা। এই মিডিয়ার পক্ষেই সম্ভব দেশ তথা পৃথিবীর সম্ভাবনাকে আরো নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিতে অজানা তথ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করতে। লোকশিল্পের আরেকটি অংশপুঁথি। প্রাচীন পুঁথির দুটি দিক আছে।
একটি অন্তরঙ্গ বিচার এবং অপরটি বহিরঙ্গ বিচার। অন্তরঙ্গ বিচারে প্রধানত গুরুত্ব পায় কাব্য বিষয়, গঠনশৈলী, রস বিচার, ভাষা বিচার, উৎস, কবি পরিচয়, লিপিকর পরিচয়, গ্রন্থ রচনার কারণ, লিপি কাল নির্ণয়, নামকরণ বিচার- এসব বিষয়। পুঁথির বহিরঙ্গ বিচারে প্রাধান্য পায় পুঁথির উপকরণাদি। পুঁথির উপকরণের ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- পত্র লিখনাধার, কালি, লেখনী। মূলত এই তিনটি উপাদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুঁথির আনুষঙ্গিক বহিরঙ্গ উপাদান রূপে কয়েকটি উপাদান আছে, বিশেষ করে পুঁথিকে দীর্ঘজীবী করে রাখতে।
সেগুলো হলো গ্রন্থপাটা, গ্রন্থপ্রচ্ছদ, গ্রন্থসূত্র বা লেতি। এই আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থপাটা। যার অর্থ আবরণ। এগুলোর নির্দিষ্ট কোনো মাপ নেই। পুঁথির আকার অনুযায়ী হতো। এই পাটা সাধারণত কাঠের হতো। বর্তমানে যাকে আমরা বইয়ের মলাট বলে থাকি। সেই পাটার উপর শিল্পকলার ছাপ ছিল। আর আমরা এখন আরও সহজে এককথায় প্রচ্ছদ বলি। এই শিল্পটি আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে, পুঁথি শিল্পটি এখন জাদুঘরে গøাসবন্দি অবস্থায় রয়েছে। শিল্পী আব্দুল লতিফ কিছু পুঁথি লিখেছিলেন। সেই পুঁথিগুলো বইয়ের মলাটে আটকা পড়ে আছে। হাতে লেখা পুঁথিকে পুঁথি রূপে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। যদিও টেলিভিশন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের অনেক না জানা তথ্য জানতে পারি। সেই ধারায় এবার তামা শিল্পের কথা বলা যায়।
তা¤্রশিল্প অর্থাৎ তামা মানুষের ব্যবহারের প্রথম ধাতু। প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার বছর ধরে মানুষ বিভিন্ন কাজে তামাকে নানাভাবে ব্যবহার করে আসছে। তামা নরম, টেকসই, তড়িৎ ও তাপ পরিবহন ক্ষমতার জন্য নির্ভরযোগ্য ধাতু। তাই মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে তামার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে যতগুলো প্রাচীন নিদর্শন ও অভিলেখ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে তামার পাতের উপর লেখা অর্থাৎ তা¤্রশাসন অন্যতম। সেই দিক বিবেচনায় তামা বা তা¤্র সবচেয়ে প্রাচীন। আজ পর্যন্ত তামার বাসন, থালা, গøাস, বোল, বাটি জিনিসপত্র বাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে শুধু অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য। শুধু ব্যবহারিক তৈজসপত্রের কথা উল্লেখ করলে ভুল হবে, টেলিভিশন দর্শকদের সামনে পর্দায় ঐতিহ্যিক স্থাপত্য শিল্প নিদর্শনগুলো তুলে ধরা হয়। যেমন সোনারগাঁও, লালবাগের কেল্লা, পাহাড়পুর, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, ঈশা খাঁর কেল্লা, পানামনগর। এসব ঐতিহ্যিক স্থাপত্য শিল্পকে তুলে ধরার জন্য ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’র মতো আরো অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করে টেলিভিশন। ঐতিহ্যিক শিল্প সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে বলতে হলে শিল্পধারার প্রতিটি দিকের শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তাহলেই ঐতিহ্যিক শিল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টিকে থাকবে। আর তারই ধারাবাহিকতায় আরো একটি অংশ হচ্ছে দেয়ালচিত্র। সৃষ্টিকাল থেকেই মানুষের মৌলিক চাহিদারূপে খাদ্যের পরেই স্থান ছিল বাসস্থানের। বৃক্ষ কিংবা গুহাকে বাসস্থানরূপে গ্রহণ করেছিল আদিম মানুষ।
যে মানুষটি গুহাগাত্রে প্রথম হরিণের ছবি এঁকেছিল, সেই ছবি আঁকার অন্তরালে ছিল অনুকরণমূলক জাদুবিশ্বাস। কেননা মানুষ বিশ্বাস করত, এই ছবিই তাকে প্রতিদিন শিকার কাজে সাফল্য এনে দেবে। সাধারণত মাটির বাড়ির দেয়ালগায়ে, প্রাচীরে ফ্রেসকো, রিলিফ সমন্বিত যে চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, টেরাকোটা তাই দেয়ালচিত্র। এর ব্যবহার দেখা যায় আদিবাসী জনসমাজে। আদিবাসী সমাজ বিশেষ করে সাঁওতাল গোষ্ঠীর বসতবাড়িতে এই দেয়ালচিত্র বেশির ভাগ দেখা যেত। অন্যান্য আদিবাসীর তুলনায় সাঁওতালদের ঘর সাজাবার প্রবণতা অনেক বেশি। শুধু ঘর সাজানোর কথাই বলি কেন, তৈজসপত্র থেকে শুরু করে পোশাক, পরিচ্ছদ- সবকিছুই ঝকঝকে পরিপাটি করে সাজানো থাকত। এই রুচিবোধের অন্তরালে লুকিয়ে ছিল বিশ্বাস ও সংস্কার। কীভাবে তাকে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, সাঁওতাল রমণী সেই বিষয়ে সদা সচেষ্ট।
অন্যভাবে বলা যায়, সাঁওতাল পুরুষরা জীবিকার প্রয়োজনে শিকারে চলে গেলে অবসর সময়ে উৎকণ্ঠিত নারীগণ শিকারকার্যে সাফল্য ও বিপদমুক্তির জন্য ঘরের দেয়ালে পশুপাখির ছবি আঁকত। এভাবেই দেয়ালচিত্রের ধারা এগুতে থাকে। তাদের বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। যদিও এখন আর জাদু বিশ্বাস করে দেয়ালচিত্র সৃষ্টি করা হয় না, কিন্তু পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত অনেক রিলিফ কাজ দেখে আকৃষ্ট হয়ে, মানুষ তাদের অফিস-আদালতে, ঘরের দেয়ালে নানা ধরনের টাইলস, মাটি, রঙের সাহায্যে বড় বড় দেয়ালচিত্র তৈরি করছেন শিল্পী ও কারিগরের সহযোগিতায়। টেলিভিশন ভবন, ভূমি ভবন, পররাষ্ট্র ভবন, আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট, স্বাধীনতা স্তম্ভ এই রকম আরও অনেক স্থানে টেরাকো দেখা যায়। এভাবেই আধুনিক যুগের ঐতিহ্যিক শিল্প শত শত বছর ধরে টিকে আছে।
ঐতিহ্যিক শিল্পের আরেকটি অংশ হচ্ছে মুখোশ। মুখোশের ইতিহাস একেবারে সভ্যতার আদিম স্তরে। মুখোশ ব্যবহার মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গেই জড়িত ছিল। মুখোশ ব্যবহারের ইতিহাস যদিও অতি প্রাচীন, তবে সেখানে বীরত্ব প্রকাশের চেয়ে ভয়কে জয় করার প্রবণতাই ছিল বেশি। কখনো কখনো শিকার করা জীবের খোলস ধারণ করে শিকারের বীরত্ব প্রকাশিত হয়েছে। শিকারকে বোকা বানিয়েছে, তাদের শিকার করে নিজ আহারের ব্যবস্থা করেছে। কৃষিজীবী মানুষও তাদের জমির ফসল রক্ষা করার জন্য কাকতাড়ুয়ার নকল মুন্ডি তৈরি করেছে এবং পশুপাখিকে ভয় দেখিয়ে নিজ ফসল ঘরে তুলেছে। মুখোশ তৈরিতে শিল্পীর দুটি হাতের আঙুলের কাজেই বেশি। অতীতে মুখোশ তৈরিতে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন খুবই কম ছিল। এখনকার আধুনিক যুগে বেশির ভাগ মুখোশ তৈরি হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। মুখোশশিল্পীরা মুখোশকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করে একটি ছৌনাচের মুখোশ, অপরটি গৃহসজ্জার মুখোশ। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠানে, নৃত্য-অভিনয়ে ব্যবহৃত মুখোশগুলোকে ধপঃরড়হ ড়ৎরবহঃবফ সঁংশ বলা হতো। এ ক্ষেত্রে চবৎভড়ৎসবৎ এর ভূমিকা বিশেষভাবে নজর কাড়ে। মঞ্চমুখোশ, ছলন মুখোশ, ঘাড় মুখোশ। এক্ষেত্রে ‘ছলন’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের মুখোশের দ্বারা ছলনা করা হয় বলে এই মুখোশকে ছলন মুখোশ নামে সবার সঙ্গে পরিচিত। এছাড়া আরো অনেক মুখোশ আছে- বাবু মুখোশ-কার্তিক, গণেশ মুখোশ, কৃষ্ণ মুখোশ, শিব মুখোশ, নারায়ণ মুখোশ, বীর মুখোশ- রাবন মহিসাসুর মুখোশ, তারকাসুর মুখোশ, নিশুম্ভমুখোশ, মেয়ে মুখোশ, নারীদের মুখোশ-দুর্গা মুখোশ, ল²ী মুখোশ, সরস্বতী মুখোশ, সীতা মুখোশ, ভূত মুখোশ, পশু মুখোশ-বাঘ মুখোশ, সিংহ মুখোশ, বালি মুখোশ, পাখি মুখোশ-ময়ূর মুখোশ, বক মুখোশ, জটায়ু মুখোশ প্রভৃতি। গৃহসজ্জায় মুখোশের পেছনে জাদু বিশ্বাসও একেবারে মিথ্যা নয়। কিন্তু মুখোশ এখন পহেলা বৈশাখসহ নানা ধরনের উৎসব, র‌্যালি বা শোভাযাত্রার প্রধান উপকরণ। মুখোশ ছাড়া উৎসব যেন অপরিপূর্ণ। মুখোশকে পরিচিত করতে টেলিভিশন মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। যে কোনো শিল্প ধারাকে দর্শকদের কাছে পরিচিত করতে টেলিভিশনের বিকল্প নেই।
ঐতিহ্যিক শিল্পের ধারাবাহিকতায় আবির্ভাব ঘটে ডোকরা শিল্পের। বহুপ্রাচীন কাল থেকে বিকশিত হওয়া ডোকরা শিল্প একটি ঐতিহ্যিক লোকশিল্প। বাংলায় এই প্রচলিত ধাতুশিল্পকে ‘ডোকরা’ শিল্প বলা হয়ে থাকে। মোমছাঁচ গলানো পিতল দিয়ে ঢালাই পদ্ধতিতে নির্মিত প্রাচীন ঐতিহ্যিক লোকশিল্প। ডোকরা শিল্পের পদ্ধতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের পদ্ধতির অনেকটা মিল আছে। ‘নবপলীয় যুগের মৃৎশিল্প থেকে তা¤্রপ্রস্তর যুগের ধাতুশিল্পে উত্তরণকালে এই শিল্পরীতি বিকশিত হয়।
বহুপ্রাচীন ভ্রাম্যমাণ যাযাবর গোষ্ঠী বহু ধরনের অনার্য-আর্য জীবিকায় জড়িত থেকে এ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন বহু বছর ধরে। এই গোষ্ঠী কাজ করেছে ধাতুশিল্পের, কখনো কখনো দেখিয়েছে বিভিন্ন শারীরিক কৌশল প্রদর্শনের খেলা। সেই সঙ্গে মানুষকে আনন্দ দিয়েছে বানর নাচার খেলা দেখিয়ে। লোকশিল্পতত্ত্ববিদ প্রভাস সেনের ভাষায়, জাগতিকভাবে ডোকরা শিল্পীরা তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত।
সমাজতত্ত্ববিদ বিনয় ঘোষ ডোকরা ধাতুশিল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতারকালেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধাতুশিল্পের সমান্তরাল বিকাশ ঘটেছিল। প্রাক্-আর্যগোষ্ঠীর কোনো কোনো সম্প্রদায় জাতিবর্ণভিত্তিক সমাজ বিন্যাসে নি¤œতর সামাজিক সোপানে স্থান পেয়েছিল। এই হিন্দুপর্বেই এভাবে সমাজের অবতলে স্থান পাওয়া লোকায়ত ধাতুশিল্পীদের একাংশের নাম হয় ডোকরা কামার।
এই ধাতু শিল্পীরা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর এবং বর্ধমান জেলায় বসবাস করত। ডোকরা শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যেসব কাঁচামাল বিশেষভাবে ব্যবহার করত, ঝুরো মাটি ও আঠালো মাটি, ধুনো মোম, পিতল, সরষের তেল, রং দস্তা, সিসে। এই তৈরিতে কিছু যন্ত্র ও তৈজসের মধ্যে পিতল গলাবার পাত্র, ছেনি, হাতুড়ি, উখো, সাঁড়াশি, ব্রাশ, সরু শিক বা কাঠি, হাপর। এছাড়া এককথায় বলতে গেলে জল, মাটি ও আগুনের সাহায্যে এই শিল্প প্রস্তুত হতো। দেব-দেবীর মূর্তি ও ধর্মীয় আচারসংক্রান্ত শিল্পবস্তু-রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা, গণেশ, কার্তিকসহ নানা মূর্তি ধাতুশিল্পীরা তৈরিতে দক্ষ ছিল। লোকশিল্প বাঁচিয়ে রাখা এবং সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেয়ার অন্যতম পদ্ধতি হলো বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে তার প্রচারের ব্যবস্থা করা। শুধু যে তামা পিতল তা কিন্তু নয়, আরো অনেক ধাতু এই লোকশিল্পর সঙ্গে জড়িত। তার মধ্যে সেরপাই শিল্প আরেক একটি, আলোচনার আগে সেরপাই জিনিসটা কী সে বিষয়ে জেনে নেওয়া উচিত। গ্রামবাংলায় চাল মাপার জন্য পাই-কুনকের ব্যবহার ছিল। পাই আসলে পরিমাপের একক ছিল। পাত্রগুলোকে দেখতে বড় আকারের পেটমোটা একদিক কাটা ডিমের মতো। অনেকটা উটপাখির ডিমের সাইজের। মুখের খোলা অংশটি তুলনামূলকভাবে ছোট। যদিও এই সেরপাই দেখতে যেমনই হোক না কেন, তার ব্যবহার ছিল অনেক বেশি। সেরপাই হচ্ছে পরিমাপের একক, সবচেয়ে বড় ছিল সের। আর ছোট একক ছিল ছটাক। চার ছটাকে হতো এক পো বা পোয়া। চার পোয়ায় হতো এক পাই। দু’পাইতে হতো এক সের। আবার চল্লিশ সেরে হতো এক মণ। পরিমাপের দুটি একক সের এবং পাই নিয়ে একত্রে সেরপাই। সেরপাই এর পাত্রগুলো বীরভূমের লোকশিল্পীরা কাঠ খোদাই করে তৈরি করতেন। এর ওপর ভেষজ কালো রং করে পিতলের নকশা-অলংকৃত পাত এগুলোর গায়ে লাগিয়ে দিতেন। পরিমাপের পাত্র পাই-কুনকে সেরপাই রূপান্তরিত হলো সেরপাই শিল্পে। এই শিল্পকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ কারিগরি দক্ষতা ও নান্দনিক বোধের দ্বারা সৃষ্ট এই শিল্প অতুলনীয়। সেরপাই শিল্প কেবল পিতলের অলংকরণের জন্য শিল্পখ্যাতি অর্জন করছে ভাবলে ভুল হবে। সার্থক শিল্প সৃষ্টি আসলে নতুন নতুন সৃজনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ হয়। সৃজনের এই দক্ষতা দেখিয়েছেন সেরপাই শিল্পীরা। সেরপাই শিল্পীরা কেবল চাল পরিমাপের পাত্রে তাদের শিল্পকর্মকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। এর বাইরে তারা তৈরি করলেন ল²ীর ঝাঁপি, সিঁদুর কৌটা, ফুলদানি, গয়নার বাক্স। এর সঙ্গে সাম্প্রতিককালে যুক্ত হলো অ্যাশট্রে, পেনস্ট্যান্ড ইত্যাদি। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজ সৃষ্টিকে পরিবর্তিত এবং বিকশিত করার সক্ষমতা সেরপাইকে যথার্থ ঐতিহ্যিক লোকশিল্পের মর্যাদা প্রদান করেছে। এই ধারাকে প্রয়োজন অনুযায়ী ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়ার জন্য মানুষ তার অভিজ্ঞতা ও শ্রমের সাহায্যে প্রকৃতিলব্ধ জিনিসকে ব্যবহারের উপযোগী করার যে চেষ্টা, সেই চেষ্টা থেকেই বেতশিল্পের উৎপত্তি। বেতশিল্পের উৎপত্তি সম্পূর্ণতই লোকশিল্প হিসেবে। আর লোকশিল্পের উৎপত্তি প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য। প্রয়োজনের প্রাথমিক দিকটা মিটে যাওয়ার পর হাতের কাজে আরও সূ²তা ও শৌখিনতা এসেছে, ব্যবহারও বেড়েছে।
বেতের তৈরি সোফা, কাঠাধামা, পালি, সের, কুনকে ইত্যাদি। হাতে তৈরি এসব লোকজ ঐতিহ্যিক শিল্প যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে সমাদৃত। এই বেতশিল্পের পরই পাটজাত দ্রব্যকেই পাটশিল্প বলা যেতে পারে। তবে এই শিল্পকে আরও দক্ষ ও নিপুণ কারিগরের দ্বারা উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে আধুনিকরূপে ও বর্তমানে বাজারের চাহিদাকে লক্ষ রেখে তেরি করা হচ্ছে ব্যাগ, থলি, বস্তা ইত্যাদি। এছাড়া পাটকাঠি কাগজ শিল্পেও জ¦ালানিরূপে ব্যবহৃত হয়। বিছানার কম্বল তৈরি করতেও যেমন পাট লাগে তেমনি লিনোনিয়াম তৈরির ক্ষেত্রে পাটের প্রয়োগ হয়। দীর্ঘকাল থেকে বিত্তবান গৃহের মেঝে আবৃত থেকেছে কার্পেটে। অফিস কক্ষও কার্পেটে মণ্ডিত হয়ে অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। এখন কিন্তু মধ্যবিত্ত এমনকি নি¤œবিত্ত পরিবারেও অন্ততপক্ষে বসার গৃহটিকে সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবেও কার্পেট আচ্ছাদিত দেখা যায়। এগুলো আকর্ষণীয় এবং নয়নলোভন।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে বাঁশ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নিত্যব্যবহার্য বস্তু হিসেবে জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে গেছে। শুধু বাঁশ ব্যবহার করেই বাসযোগ্য উন্নতমানের গৃহনির্মাণ এখন সম্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে খুঁটি, পাইর, তির, বেড়া, চালের কাঠামো, ছাউনি, বাঁধবার বেত এসবই বাঁশ দিয়ে তৈরি। বাঁশকে লম্বালম্বি ছেঁচার পর চিরে দা দিয়ে খুঁটে করা হয় তরজা। এই তরজা দিয়ে ঘরের বেড়া ও ছাউনির কাজ হয়। তরজার বেড়ার মধ্যেও নিজের শিল্পীসত্তার ছাপ রেখে দেন কোনো কেনো কারিগর। নিপুণ বাঁশশিল্পীর হাতে তৈরি তরজার বেড়া পাটির মতো মুড়ে নেওয়া যায়। বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি সরঞ্জাম অজ¯্র। ধুচুনি, চালুনি, টুকরি, ঝুড়ি, ডালা, কুলো, ডোল, গোলা, টোকা, তাঁতের সরঞ্জাম, দোলনা, হাতল, চ্যাঙারি, মশালের তৈলাধার, আঁকশি, সাঁকো, বসবার শোয়ার বা জিনিসপত্র রাখার মাচা, বাড়ির সীমানার বেড়া- এ তালিকা অন্তহীন। আবার বাঁশের করুল বা কচি বাঁশের সদ্য উদগত নরম কাণ্ড উপজাতি মানুষের প্রিয়তম খাদ্য। বর্তমানে বৃহত্তর জনসমাজেও এর কদর শুরু হয়েছে। বাঁশের করুল এর সঙ্গে শুকনো মাছ এবং নানাবিধ সবজি মিশিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তেলমশলা ছাড়া রান্না করা খাদ্য ‘গোদক’ এর জনপ্রিয়তা অপরিসীম। এছাড়া লোকনাম, লোকবাহন, লোকখাদ্য, লোক আচার, লোকচিকিৎসা, লোকছড়া, লোকপ্রবাদ, লোকধাঁধা, লোকবিশ্বাস, লোকপুরাণ, লোকসংগীত ইত্যাদি অজস্র ক্ষেত্রে বাঁশের ব্যবহার ও উল্লেখ রয়েছে।
ঐতিহ্যিক লোকশিল্পের জগতে রয়েছে বৈচিত্র্যেভরা বাঁশের নানাবিধ সৃষ্টি অর্থাৎ এই বাঁশের ব্যবহার। বর্তমানে আলোচনায় মূলত বাঁশ এবং ঐতিহ্যিক লোকশিল্পের প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। লোকায়ত জীবন প্রতিনিয়ত বাঁশের নীরব সেবা গ্রহণ করছে। তাই লোকসংস্কৃতির বিশাল দুনিয়ায় অজস্রভাবে এসেছে বাঁশের অনুসঙ্গ। লোকক্রীড়া, লোকনৃত্য, লোক পরিমাপক ও নির্দেশক, লোকব্রত, লোকনিষেধ, আর বাঁশের বাঁশির চমৎকারিত্বের শেষ নেই। কুশলী বাদকের হাতের বাঁশি যথার্থই জাদু জানে, অপরূপ সুরলহরী মুহূর্তে শ্রোতাদের নিয়ে যায় এক কল্পলোকে। এর প্রমাণ দেখা যায় টেলিভিশনের পর্দায়। লোকগায়করা বাঁশের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং বংশী তত্ত্ব নিয়ে গানও বেঁধেছেন। এটিতে যেমন ঐতিহ্যসূত্রে সংশ্লিষ্ট কারিগর নান্দনিক পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তেমনি জাতিগোষ্ঠীর নান্দনিক সৌন্দর্যেরও প্রকাশ ঘটে। আমাদের দেশে লোকসমাজের জীবনযাত্রায় প্রতিদিনের প্রয়োজনে বাঁশের বহুমাত্রিক ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। একটা সময় ছিল যখন কিনা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বাঁশঝাড় থাকার রেওয়াজ ছিল। সমাজের চাহিদা ও উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাঁশ কারিগররা বাঁশের নানা ধরনের শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে থাকেন। তারা সেসব শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রেরণা ও নির্মাণ কৌশল আয়ত্ত করেন বংশপরম্পরায় প্রবহমান ঐতিহ্য থেকে। যা তাদের পেশার তাগিদ হলেও একপ্রকার নেশাও বটে। কেননা এসব লোকজ শিল্পকর্মে জড়িয়ে রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংশ্লিষ্ট লোকজীবনেরই নানা অনুষঙ্গ।
মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যেহেতু জন্মজন্মান্তরব্যাপী, তাই মাটিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্ট শৈল্পিক কর্মকুশলতা কুমার সম্প্রদায়ের মজ্জাগত ব্যাপার। ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’ই তাদের নান্দনিকতার প্রকাশ মাধ্যম, জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, মৃৎশিল্পকে জনতামুখী লোকসংস্কৃতি বা ফোকলরিজম (ঋড়ষশষড়ৎরংস) অন্তর্ভুক্ত। মৃৎশিল্পীরা সাধারণত শিক্ষিত নন। এই শিল্পের উৎকর্ষসাধনে কেবল দক্ষশিল্পীর হাতের স্পর্শ যথেষ্ট। তবে মৃৎশিল্প নির্মাণের কেন্দ্র হিসেবে বাঁকুড়া, কৃষ্ণনগর আজও অন্যতম। বাঁকুড়া মৃৎশিল্প ধারায় প্রাচীন। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া এবং মুর্শিদাবাদের কাটালিয়া টেরাকোটার কাজের জন্য বিখ্যাত। রং ছাড়াও পাঁচমুড়ার জিনিস সবার কাছে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। অন্যদিকে কাটালিয়া ঝুড়ির জ্যামিতিক নকশাওয়ালা অভ্র রঙের পুতুল জগৎবিখ্যাত। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা অত্যন্ত সযতেœ ও দক্ষতার সঙ্গে মৃৎশিল্প নির্মাণ করে । মানব সমাজের ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তনের ধারার সঙ্গে মৃৎশিল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বিশ্ববরেণ্য নৃতত্ত্ববিদ লুই হেনরি মর্গান ‘মৃৎশিল্পের আবিষ্কারকে বন্য অবস্থা থেকে বর্বর অবস্থায় মাবনজাতির উত্তরণের সূচনা বলে চিহ্নিত করেছেন। আজকের যুগে মৃৎশিল্পের যে ঐতিহ্য তা শতসহ¯্র বছর আগেও বিদ্যমান ছিল। এ শিল্পের সূচনা করে প্রস্তরযুগের আদিম মানুষ। তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আস্ত্র হিসেবে পাথরের পরিবর্তে মাটির ঢেলা ব্যবহার করত। আদিমকাল থেকে মিসর, সুমেরু, ব্যাবিলন, মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি মানবসৃষ্ট আদিম সভ্যতা সমগ্র মানব ইতিহাসের ধারায় ক্রমশ উত্তরিত হয়েছে। তাই ব্যাপ্তি ও গুরুত্বে মৃৎশিল্পের সঙ্গে অন্য কোনো শিল্পের তুলনাই চলে না। এছাড়া চীন, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, বিহার নামক বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে মৃৎশিল্পের নানা ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের পান্ডুরাজার ঢিবিতে খননকার্যের সময় চমৎকার মৃৎশিল্পের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। টেরাকোটা ও হস্তনির্মিত মৃৎশিল্পগুলো বিভিন্ন রঙের হয়। যেমন- লাল, ধূসর, লালের ওপর কালো ছোপ ইত্যাদি। মৃৎশিল্পীরা পশ্চিমবঙ্গে কুম্ভকার (‘কুম্ভ’ মানে পাত্র এবং ‘কার’ কথার অর্থ নির্মাণকারী) নামে পরিচিত। পারিবারিক শিল্পকলা হিসেবে এই শিল্প খুবই প্রয়োজনীয়, যেখানে পুরুষ, স্ত্রী এবং শিশুরা সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু না কিছু এই শিল্পে ভূমিকা থাকে। চাকার কাজ খুব শ্রমসাধ্য বলে এ কাজ পুরুষরা করেন। চাকার কাজ শেষ হলে অবশিষ্ট কাজগুলো স্ত্রীলোকেরা করে থাকে।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এবং বাংলা বিভক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আগত শিল্পীরা সরা, ঘট ইত্যাদির মতো বহুবর্ণবিশিষ্ট মৃৎশিল্প নির্মাণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁরা নিজেরাই কাজের জন্য পরিশ্রম করে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যথা- কাদামাটি, কয়লা, কাঠ ইত্যাদি জ¦ালানি সংগ্রহ করেন। মৃৎশিল্প সবার কাছে একটি প্রাচীন হস্তশিল্প, যা সম্ভবত বয়নশিল্পের থেকেও প্রাচীন।
তবে পোড়ামাটির মন্দির অলংকরণ শিল্পটি বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব সম্পদ। পাথরের অপ্রতুলতার জন্য বাঙালি মন্দির নির্মাতাদের সহজলভ্য মাটির ওপরই বরাবর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু সেই সামান্য উপকরণের ওপর নির্ভর করে তারা যে অসামান্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তার তুলনা বিরল। পাথরে খচিত স্থাপত্য ভাস্কর্যই পরবর্তীকালে শিল্পের পরিপূরক বা পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু পোড়ামাটির মন্দির অলংকরণের ক্ষেত্রে বাঙালি মৃৎশিল্পীরা যে উৎকৃষ্ট শিল্পবোধের পরিচয় দিতে পেরেছেন, তার বৃত্তান্ত বঙ্গ-সংস্কৃতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবার মতো।
এছাড়া পুতুল তৈরির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ক্ষুদ্রায়তন মূর্তিকেই আমরা সবাই সাধারণত পুতুল বলে থাকি। পুতুলগড়ার ইতিহাসের সঙ্গে জাদুবিশ্বাস ও টোটেম বিশ্বাস জড়িত। ভারতীয় উপমহাদেশে পুতুল তৈরির ইতিহাস সুপ্রাচীন। অবিভক্ত ভারতে মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও চানহুদারো (ঈযধহযঁফধৎড় ) এর পুতুলগুলোকে পৃথিবীর এ যাবৎ পাওয়া প্রাচীনতম পুতুলগুলোর মধ্যে অন্যতম ধারণা করা হয়। মহেঞ্জোদারোর মাথা নাড়ানো বৃষ, শুকর, মুম্বাইয়ের প্রিন্স অব ওয়েলশ মিউজিয়ামে সুরক্ষিত আছে। আবার মিসরের পেডলি ডল (চধফফষব উড়ষষ ) মুখ নাড়ানো বিড়াল, গ্রিসের মাটির খেলনা বা সওয়ারসহ ঘোড়া, রথ, পুতুলের নানা নিদর্শন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি, সাভার, রামগড় ইত্যাদি জায়গায় পোড়ামাটির পুতুল মৃৎশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গের বেড়াচাঁপা, হরিনারায়ণপুর অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে প্রচুর পোড়ামাটির পুতুল পাওয়া গেছে। এগুলো শিশুদের খেলনা বা ঘর সাজানোর দ্রব্যাদিরূপে ব্যবহৃত হলেও ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত ছিল না।
বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিচার করলে সমস্ত পুতুলকে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি প্রতীকধর্মী অপরটি বাস্তবধর্মী। মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়ায় প্রতীকধর্মী পুতুলের নিদর্শন পাওয়া যায়। এসব পুতুল তৈরি করতে কোনো ছাঁচ ব্যবহার করা হয় না। কেবল হাতে টিপে তৈরি করা হয়। পুতুলগুলোর অঙ্গ, হাত, পা, নাক, চোখ কোনোটাই স্বাভাবিক নয়। চোখ বা সাজ ভূষণের জন্য আলাদা করে মাটির টুকরো জুড়ে দেয়া হয়। পা অনেক সময় থাকে না। পুতুলগুলোর মধ্যে একটা আদিম ভাব স্পষ্ট। এই পুতুলগুলোকে আমরা বাস্তবধর্মী বলতে পারি। ‘মা-ছেলে’ টাইপ প্রতীকধর্মী পুতুলের যথার্থ নিদর্শন, যা মিসরের মমির অনুকরণে গড়া পোড়ামাটির ষষ্ঠীঠাকরুণ নামে পরিচিত। পুতুলগুলোতে কোনো সূ² কাজ নেই, এমনকি রংও করা হয় না।
মন্দির স্থাপত্য বাংলার মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ঐতিহ্যিক লোকশিল্পের উদাহরণ। সংস্কৃতিরই এক অন্যতম অঙ্গ। সংস্কৃতির বিকাশ হয় শান্ত পরিবেশে যখন মানুষের জীবনে নিশ্চিত হয়ে ঘরবাঁধার অবকাশ আসে। রাজাদের বা জমিদারদের এই নিশ্চয়তা ছিল বলেই তারা মন্দির স্থাপনে মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন। মন্দির শব্দটি ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। মন্দির বলতে আমরা হিন্দুধর্মের দেবতাদের আরাধনার প্রধান স্থান বুঝি। যেমন মসজিদ বলতে মুসলমান ধর্মের আরাধনার স্থান, গির্জা বলতে খ্রিস্টান ধর্মের আরাধনার স্থান বোঝায়। বর্তমানে মন্দির বলতে দেব আরাধনার স্থান বোঝালেও মন্দির শব্দটির আদি অর্থ ছিল বাসগৃহ বা বাড়ি। মন্দির শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মন্দ ধাতু থেকে।
বাংলার মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ধারাকে যুগ অনুযায়ী তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ। হিন্দুযুগের শুরুতে যে বিশেষ ধারাগুলো প্রচলিত ছিল, তার অধিকাংশ নিদর্শনই হারিয়ে গেছে। সে সময়ে রেখ বা শিখর দেউল’, ‘ভদ্র বা পীড়া দেউল’, ‘স্তুপ শীর্ষ ভদ্র’ ও ‘শিখর শীর্ষ ভদ্র’ এই চার রকমের মন্দির তৈরি হতো। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মেদিনীপুর জেলায়। ‘রেখ বা শিখর দেউলে’র ক্ষেত্রে মন্দিরের গর্ভগৃহের চাল ক্রমশ ছোটো হয়ে উপরে উঠে যায়, এভাবে উপরে উঠে গিয়ে শিখরের সৃষ্টি করে। শিখর শীর্ষ ভদ্র বা পীড়া দেউলে একটি শিখর মন্দিরের মস্তকভাগকে অলংকৃত করে। ‘মন্দিরের গায়ে ভাস্কর্য’-কে টেরাকোটা ভাস্কর্য, টেরাকোটা অলংকরণ বা টেরাকোটা সজ্জা নামে অভিহিত হতো। এর উল্লেখযোগ্য একটি দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরের প্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরটি খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল।

শিল্পের ক্রমাবনতি :
আধুনিক যুগের নতুন নতুন যন্ত্র ও অত্যাধুনিক পযুক্তি ব্যবহারের ফলে গ্রাম্য প্রাচীন ঐতিহ্যিক শিল্পগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই উপমহাদেশে প্রায় প্রতিটি জায়গাতে ধাতুশিল্প যার একসময় গুরুত্ব ছিল, এই শিল্প ও শিল্পে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের প্রয়োজনীয়তাকে মানুষ স্বীকার করত কিন্তু তা এখন প্রায় শেষের পথে। যদিও শুধু একটিমাত্র কারণ থেকে এই শিল্পের অবনতি ঘটেনি বরং বলা যেতে পারে এই ধাতুশিল্প ধ্বংস হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ আছে। বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতির ফলে নতুন নতুন জিনিসের দিকে মানুষের ঝোঁক এবং তার ব্যবহার এনামেল, অ্যালুমিনিয়াম, স্টেনলেস স্টিল, নিকৃষ্টমানের স্টিলসহ কমদামি ধাতুর ব্যবহার। হালকা ও সস্তা প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, উত্তরোত্তর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। প্রবীণ গুণবান কারিগরের অভাব। মহাজনের শোষণে শিল্পীদের অনীহা। সঠিক পরিমাণে ধাতব কাঁচামালের অভাব। আমদানি-রপ্তানিতে আইনি জটিলতা। ‘শুধু শিল্প নয় বরং শিল্পে নিযুক্ত কারিগর তথা শিল্পী, সহশিল্পী পিটাইদার (ধাতু পেটানো), পালিশদার বা মাঝিয়ে (ফাইল ঘষা), বোঝাইদার (মাথায় করে মাল বওয়া) এসব শিল্পীরা কাজ করেন তারাও হারিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের সমাজ থেকে। শুধু তাই নয়, উৎকৃষ্ট উৎপাদনের জন্য শিল্পীরা পুরস্কৃত হতেন, তাদের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। তবে আজ আর সেই দিন নেই। রয়ে যাচ্ছে তাদের নিষ্ঠার নিপুণ সৃষ্টি। আমরা শিল্পীর তৈরি শিল্পকে দাম দিয়ে কিনি কিন্তু তার মধ্যে তাদের কতটা শিল্পের ছোঁয়া বা শিল্পের কল্পনা থাকে তা জানতেও পারি না বা জানার চেষ্টাও করি না। টেলিভিশন পারে সেই পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে, পরিচয় করিয়ে দিতে পারে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে, কারণ স্যাটেলাইট সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সহজ করেছে সারা পৃথিবীকে জানার। সে বিশেষ কারণে, আধুনিক ডিজিটাল যুগে কেউ আর টেলিভিশনের সামনে বসতে চান না। টেলিভিশনগুলো এই সত্যকে মেনে নিয়ে টেলিভিশনে নির্মিত সব এতিহ্যিক অনুষ্ঠানসহ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোকে স্যাটেলাইটে সরাসরি সম্প্রচার করছে।
ঐতিহ্যিক শিল্পকে মানুষের কাছে পরিচয় করানোর উপায় টেলিভিশন বা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা করা। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বিশেষভাবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে, রেল স্টেশনে, এয়ারপোর্ট, লঞ্চঘাটসহ দেশের সব জায়গায় ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঐতিহ্যিক শিল্পের নিদর্শনগুলোকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা। যাতে করে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নিজ ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে। বাংলার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হলে মিডিয়ার বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় লাইব্রেরি, সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরলে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যিক শিল্পকে সবার কাছে পরিচিত করা সম্ভব। বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্প নিয়ে বিশেষ আলোচনা ও প্রামাণ্যচিত্র বেশি করে প্রচার করতে হবে। যাতে দর্শক বুঝতে পারে বাংলায় আমাদের গর্ব করার মতো অনেক ঐতিহ্য এখনো রয়েছে। শুধু ঐতিহ্যকে সুপরিচিত করার জন্য বিশেষ করে সাহিত্য, কাব্য, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি এসব দিকগুলোকেও বিশেষভাবে ফোকাস করা যেতে পারে। ঐতিহ্যিক শিল্পের অন্যতম অংশ লোকসাহিত্য, যা পালা গানেও রূপান্তরিত করে প্রচার করা যেতে পারে। টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রচারিত অনুষ্ঠান বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জসহ সব শ্রমজীবী মানুষ দেখেন এবং তারা আনন্দ উপভোগ করেন। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ঐতিহ্যিক শিল্প টেলিভিশন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।

ড. মীর আহসানুল আলম
পরিচালক ডিজাইন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, রামপুরা, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়