যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী চেতনার শেকড় সন্ধানে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ছাত্রাবস্থা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কড়া মুসলিম লীগ সমর্থক এবং পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ তরুণ কর্মী। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে ওই বছরই তিনি কলকাতা গিয়ে ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে নির্বাচিত হন তৎকালীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সদস্য। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিয়ে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর এবং গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এর আগে ১৯৩৮ সালে মুসলিম লীগের ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে যোগদান করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। (টুঙ্গিপাড়ার খোকা যেভাবে জাতির পিতা, পৃ-১৬-১৭)।
রাজনীতির শুরুর দিকের কয়েক বছরের সাংগঠনিক ইতিহাস বিবেচনা করে যে কেউ তাৎক্ষণিক মনে করতে পারেন যে, শেখ মুজিব হয়তো মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার পরিমণ্ডলেই বড় হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি তথা বিপ্লবী তৎপরতা চালানোর মতো চিন্তা-চেতনা তার মনোজগতে ঠাঁই পেল কোন উৎস থেকে? তার ভেতর এমন বিপ্লবী চেতনার বীজ বপন করল কে বা কারা? এর উৎস সন্ধান করতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হয়।
আমরা পরবর্তী ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পারি যে, তিনি গোপালগঞ্জে মিশনারি স্কুলে পড়ালেখা করা অবস্থা থেকেই যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশে ও যাদের সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছিলেন এবং যাদের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন সে পরিবেশ ও শিক্ষকদের কাছ থেকেই অসাম্প্রদায়িক ও বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার প্রাথমিক দীক্ষা লাভ করেছিলেন। সেই চেতনাকে বুকে লালন করেই তিনি পরবর্তী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার রাজনীতির পথ-পরিক্রমার ছক এঁকেছিলেন।
শেখ মুজিব গরিব-অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা পেয়েছিলেন মূলত গোপালগঞ্জে পড়ার সময় গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে। তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান কাজী আবদুল হামিদ নামে একজন এমএসসি শিক্ষক রেখেছিলেন তাকে পড়াবার জন্য। সেই শিক্ষক গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার মাধ্যমে গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল ওঠাতেন সব মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রোববার মুজিব তার সঙ্গীদের সঙ্গে থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল উঠিয়ে আনতেন এবং শিক্ষক সাহেব এই চাল বিক্রির অর্থ দিয়ে গরিব ছেলেদের বই কেনা, পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচের ব্যবস্থা করতেন। ঘুরে ঘুরে কারও জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। শেখ মুজিবকেই অনেক কাজ করতে হতো সেই শিক্ষকের সঙ্গে। হঠাৎ য²া রোগে আক্রান্ত হয়ে শিক্ষক মহোদয় মারা গেলে মুজিব এই সেবা সমিতির ভার নেন এবং অনেক দিন পরিচালনা করেন। (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৯-১০) বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) লিখেছেন, ‘হামিদ মাস্টার ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এবং বহু বছর জেল খেটেছেন। পরবর্তী সময়ে আব্বা যখন জেলে থাকতেন কিংবা পুলিশ যখন তাকে গ্রেপ্তার করতে আসত, আমার দাদি মাঝে মাঝেই সেই মাস্টার সাহেবের নাম নিতেন আর কাঁদতেন। (শেখ হাসিনা : শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃষ্ঠা-২৯) আমরা ধারণা করতে পারি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক পাঠ তিনি সেই শিক্ষকের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। এছাড়া শেখ মুজিব কিশোরকালে বিপ্লবী চেতনায় গড়ে ওঠা ব্রতচারী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। সেখানকার প্রশিক্ষণকালে তার মনে সংগ্রামী চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তিনি মাদারিপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়কালে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতির মাধ্যমেই এর শুরু।
এ প্রসঙ্গে লেখক হাবিব আহমদ দত্ত চৌধুরী ‘গুরু সদয়ে উদ্ভাসিত মুজিব’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছেন : ‘গুরুসদয়ে উদ্ভাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কথাটা হাল-আমলের রাজনীতিবিদ বা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই আনকোরা ধরনের তাতে সন্দেহ নেই। অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবনেতিহাসের এ অধ্যায়টি ইতিহাসের মানদণ্ডে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলার নৃত্য, বাংলার সাহিত্য, বাংলার লোকসংগীত, লোকশিল্প, লোককথা, ছড়া, বাঙালির জাতীয় খেলা, বাংলার মেয়েদের আলপনা প্রভৃতি গণশিল্প-সংস্কৃতি বাঙালির জীবনে পুনঃপ্রবর্তন করে জাতীয় জাগরণ ঘটানোই হচ্ছে ব্রতচারী আন্দোলনের মূল কাজ এবং অতঃপর জাতীয় মুক্তি বা স্বরাজ লাভ। এই দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলার ব্রতচারীদের জন্য গুরুসদয় দত্ত দুটি সেøাগানও সৃষ্টি করলেন। প্রথমটি হলো ‘আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমি বাংলার সেবা করবো’ এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘জয় সোনার বাংলা’। অপরদিকে তিনি স্বজাতিকে শাশ্বত বাঙালি হওয়ার আহ্বান জানালেন তার অবিস্মরণীয় ‘বাঙালি হ’ শীর্ষক গানে।
ব্রতচারী আন্দোলনে শামিল হলেন বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম ও মতের জনগণ। বিশেষ করে বাঙলার হিন্দু-মুসলমানের মিলনমেলায় পরিণত হলো এই আন্দোলন। গুরুজির ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ফলে এই আন্দোলন সর্বজনীন আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করল। প্রথমদিকে ব্রতচারী আন্দোলন ইংরেজদের বিরোধিতা এবং ছোট মাথার কিছু অবাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তির সমালোচনার মুখে পড়ল। গুরুজি অতীব সুবুদ্ধির সঙ্গে ইংরেজ গভর্নর ঝরৎ ঔড়যহ অহফবৎংড়হ-কে এ আন্দোলনের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে বশীভূত করলেন। এদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, নেতাজির অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, দুর্ধর্ষ রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ মহামানবগণ গুরুজির ব্রতচারী আন্দোলনকে স্বাগত জানালেন এবং এর প্রচার ও প্রসারে সর্বাত্মক সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও এই আন্দোলনের একান্ত সমর্থক ছিলেন। কিন্তু জীবনের বেশির ভাগ সময় কারান্তরালে থাকায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় এ আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারেননি।
শেখ মুজিব ১৯৩১ সালে ভর্তি হলেন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে। এই সময়কালে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতির মাধ্যমেই এর শুরু, এটা পূর্বেই বলা হয়েছে। এ সময়কালে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত বিপ্লবী নায়ক মাস্টারদার নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী রক্তাক্ত বিদ্রোহ ঘটে এবং সমগ্র উপমহাদেশে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক ডামাডোল। মাস্টারদার বিপ্লবী অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিল স্বৈরাচারী ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার। শেখ মুজিব বাল্য বয়স থেকেই ছিলেন অত্যন্ত স্বদেশ-সচেতন এবং দেশের হালহকিকত অনুধাবনের ক্ষমতা তার আর দশজন সহপাঠীর চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রতচারী আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং তা সমগ্র বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ঝপড়ঁঃরহম-এর পাশাপাশি ‘ব্রতচারী শিক্ষণ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলেও এই ব্রতচারী-চর্চা চালু হয়ে যায়। কিশোর বঙ্গবন্ধু ব্রতচারীভুক্তি গ্রহণ করলেন এবং আস্তে আস্তে শিখে নিতে লাগলেন গুরুসদয় দত্তের আবিষ্কৃত যুদ্ধনৃত্য: রায়বেঁশে, ঢালী ও কাঠিনাচ। এই নৃত্যগুলো প্রশিক্ষণের সঙ্গে এগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্যও ব্যাখ্যা করা হতো শিক্ষণার্থীদের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর কিশোর মনকে দারুণভাবে নাড়া দিল এই ব্রতচারীচর্চা। এদিকে ১৯৩৩ সালে বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হলেন বেরিবেরি রোগে এবং এই রোগ থেকেই তার চোখে গেøাকুমা নামের একটা রোগ দেখা দিল। বছর তিনেকের জন্য মুজিবের লেখাপড়া স্থগিত হয়ে পড়ে।
১৯৩৫-৩৬ সালের দিকে শেখ মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান ভগ্নহƒদয়ে মাদারীপুর থেকে গোপালগঞ্জে বদলি হয়ে এলেন। বন্ধু-বান্ধবদের পরামর্শক্রমে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে পুত্রের চোখে অস্ত্রোপচার করালেন। ফিরে এসে তাকে পঞ্চম শ্রেণিতে (ঋরভঃয ঈষধংং) ভর্তি করালেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে। প্রধান শিক্ষকের নাম গিরিশ বাবু। তিনি গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং স্কুলে ব্রতচারী প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি স্বয়ং। উল্লেখ্য, ইসলামিয়া হাইস্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় যখন ব্রতচারী চর্চায় শেখ মুজিবের হাতেখড়ি হয় তখন থেকেই ব্রতচারীনৃত্য ও ব্রতচারী সঙ্গীতগুলোর প্রতি তার আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী ও স্কুলের ছেলেদের নিয়ে স্কুলের বাইরেও তিনি একটি ব্রতচারী দল গঠন করলেন এবং ব্রতচারী চর্চা, ভলিবল খেলা ও ফুটবল খেলা নিয়েই বেশির ভাগই সময় মেতে থাকতেন। ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি ১৯ বছরের একজন পরিপূর্ণ যুবক ও দক্ষ ব্রতচারী। খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে দাঁড়ালো ব্রতচারীনৃত্য। তিনি বেশ কটি ব্রতচারী সঙ্গীত শিখেছিলেন। তন্মধ্যে : ‘বাঙালি হ’, ‘আমরা বাঙালি’, ‘জয় সোনার বাংলা’, এবং ‘বাংলাদেশ’ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর জীবনীকারগণ লিখেছেন- ‘শরীরের গড়ন হ্যাংলা ও ছিপছিপে আর লম্বা হওয়ার কারণে ভলিবল খেলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী, তবে সবচেয়ে প্রিয় ছিল গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারীনৃত্য। এখান থেকেই তার বাঙালি চরিত্রের উšে§ষ। অর্থাৎ পল্লীবাংলার দুর্গত মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিকদের দুরবস্থার উন্নয়ন চিন্তা, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা আর ধর্মনিরপেক্ষ সাম্যবাদী মানসিকতা তিনি ব্রতচারী আন্দোলন থেকেই লাভ করেছিলেন।’ (স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায়-বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য ৪৭-৭১, পৃ-৪৪-৪৫)
এখানে একটা বিষয় গুরুত্বসহকারে উল্লেখ্য যে, ১৯৩৯ সালে গুরুসদয় দত্ত সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে শাশ্বত সোনার বাংলার একটি মানচিত্র প্রণয়ন করেন এবং বাংলাদেশ নামে একটি অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে শেরে বাংলা, শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ বাঙালি নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে আলোচনা করেন। নেতারা গুরুসদয়ের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। বলাবাহুল্য যে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবটি ছিল মূলত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের একটি কৌশলী উদ্যোগ যা জিন্নাহর তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের প্যাঁচে পড়ে পাকিস্তান প্রস্তাবে পরিণত হয়। পুনরায় ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তিকালে সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসুর উত্থাপিত স্বাধীন যুক্তবাংলার দাবিও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের কবলে পড়ে ব্যর্থ হয়ে যায়। … ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানেও গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের প্রভাব ছিল পুরোমাত্রায়। ব্রতচারী আন্দোলনের স্বদেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা হƒদয়ে লালন করে শেখ মুজিব জড়িয়ে পড়লেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে। কলকাতায় গিয়ে নেতাজি সুভাষ বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনের কথা এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজির স্বদেশ ত্যাগের রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনার পর যুবক মুজিবের হƒদয় নতুনভাবে শিহরিত হয়ে উঠল। তিনি নেতাজির উডবার্ন পার্কের বাসায়ও যাতায়াত করতেন এবং নেতাজির অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় ঘটে। ১৯৪৪ সালে মুজিব যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখন নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবসে কলকাতার বেকার হোস্টেলের অদূরে পুলিশের গুলিবর্ষণে
আব্দুস সালাম নামে জনৈক সুভাষ-প্রেমিকের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় নেতাজির কর্মকাণ্ডের প্রতি মুজিব আরও বেশি আকৃষ্ট হলেন। নেতাজির সংগ্রামী জীবন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্ব গাথা মুজিবের প্রতিবাদী হƒদয়কে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। তখন থেকেই তিনি অনুধাবন করলেন যে, প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রতচারী আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ব্রতচারী করা এবং নেতাজীর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। তার শৈশব থেকে খেলাধুলা, গান, ব্রতচারী ও সভা সমাবেশের প্রতি ছিল ভীষণ আকর্ষণ। দৈনিক আজাদ, আনন্দবাজার, বসুমতি, মোহাম্মদী, সওগাত ইত্যাদি সংবাদপত্র নিয়মিত পড়তেন। সমাজসেবামূলক কাজেও নিয়োজিত রেখেছিলেন নিজেকে। দুষ্টুমিতেও পিছিয়ে ছিলেন না মোটেও। রোগভোগের কারণে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়েছিলেন কয়েক বছর।
তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৩৪ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোটকালে তিনি খুবই দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবল, ভলিবল, হকি খেলতেন। তিনি গান গাইতেন এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতেন। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন এবং নেতাজী সুভাষ বসুর ভক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি লিখেছেন, ‘তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশি আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশিরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার ওপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশি আন্দোলনের লোকদের সঙ্গেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও, আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পরে শুনেছি।’
ওপরের তথ্যের আলোকেই বলা যায়, কিশোর বয়সেই শেখ মুজিব তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। হাবিব আহমদ দত্ত চৌধুরীর কথায় ‘সাম্রাজ্যবাদী মোগলদের বিরুদ্ধে বীর বাঙালি সেনাপতি ঈশা খাঁর যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নেতাজির সশস্ত্র সংগ্রাম এবং বিপ্লবী নায়ক সূর্যসেনের সশস্ত্র বিপ্লব থেকে তিনি (শেখ মুজিব) বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করেছিলেন। অপরদিকে দুর্ধর্ষ রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে থেকে শিখেছিলেন সাংগঠনিক দক্ষতা ও নির্বাচনী কলাকৌশল আর পার্লামেন্টারি রাজনীতির সুচতুর পদক্ষেপগুলো। আর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন বক্তৃতার দেহাতি ভাষা। এসব গুণাবলীর সমন্বয়ে পাকিস্তানি শাসকচক্রের কবল থেকে মাতৃভূমি পূর্ববাংলার মুক্তির জন্য ২১৪ বছরের প্রান্তে তিনিই গড়ে উঠেছিলেন যোগ্যতম নেতৃত্বরূপে।’

মুহাম্মদ শামসুল হক
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক : ইতিহাসের খসড়া

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়