যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

মাদকাসক্তি এবং তরুণ সমাজের নৈতিক অবক্ষয়

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মাদকাসক্তির আরেক নাম নেশা। নেশা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য দূরে সরিয়ে রাখতে পারে অথবা দুঃখ-যন্ত্রণার জ¦ালা থেকে মুক্তি দিয়ে সাময়িক আনন্দে মন ভরে তুলতে পারে। কিন্তু এ সাময়িক আনন্দ পেতে যেয়ে যে সর্বনাশ ঘটে যায়, তা আসক্তরা বুঝতে পারে না এবং বোঝার কোনো সুযোগও থাকে না। পরিশেষে তিলে তিলে দুঃখ ও যন্ত্রণার দাবানলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে মৃত্যুর নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। নেশা এমন একটি আকর্ষণ, এর প্রতি কেউ একবার আসক্ত হয়ে পড়লে তা থেকে বের হয়ে আসা বা নিস্তার পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বা মাদকাসক্তি প্রতিটি মানুষকে করেছে ভীত ও সন্দিগ্ধ। প্রতিটি পরিবার মাদকদ্রব্যের আগ্রাসন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত ও পরিচিত মাদকদ্রব্যের মধ্যে মদ, গাঁজা, আফিম, চরস, হেরোইন, পেথিডিন, হাসিস, ফেনসিডিল, টিডিজেসিক, ঘুমের ওষুধ ইত্যাদির ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এরপর যোগ হয় ইয়াবা ও আইস। বর্তমানে এই সিরিয়ালে নতুন করে যোগ হয়েছে আরো ভয়ংকর আলোচিত মাদকদ্রব্য এলএসডি। ক্রমাগত যে হারে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এ ব্যাপারে তৎপর ও জোরালো ব্যবস্থা না নিলে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে না তুললে তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ অচিরেই পরিণত হবে নির্লিপ্ত, অবসাদগ্রস্ত, মানসিক ভারসাম্যহীন মতিভ্রমে।
বিভিন্ন বয়সি মানুষের মধ্যে মাদকদ্রব্য গ্রহণের প্রবণতা দেখা গেলেও মূলত উঠতি এবং তরুণ বয়সিদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। তরুণ সমাজের মধ্যে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে জীবনবিনাশী মাদকদ্রব্য। জরিপে দেখা গেছে, ১৯-২৮ বছর বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি আসক্ত হচ্ছে। তথ্যানুযায়ী জানা যায়, আমাদের দেশে ১৯৭৮ সালের পর থেকে মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকাসক্তি বা নেশা করার পেছনে একক কোনো কারণ নিশ্চিত করা সহজ নয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে বেকারত্ব, হতাশা, আর্থিক অভাব ইত্যাদি সামাজিক যন্ত্রণাই হচ্ছে মাদকাসক্তির প্রধান ও অন্যতম কারণ। এছাড়াও আছে মাদকদ্রব্যের প্রতি কৌতূহল, বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব, কৈশোর ও যৌবনের বেপরোয়া মনোভাব, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, কুফলতা সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি। মাদকদ্রব্যের বিষাক্ত থাবায় সমাজ, জীবন, জাতি এমনকি মূল্যবোধও আজ ধ্বংসের পথে।
মাদকাসক্ত ব্যক্তি সমাজের অভিশাপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি প্রধানত মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে অসুস্থ বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। মানসিক অসুস্থতার দিকগুলো হচ্ছে উত্তেজনা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, বদমেজাজ, দুর্বলতা, হতাশা বৃদ্ধি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, শারীরিক অসুস্থতার দিকগুলো হচ্ছে কর্মক্ষমতার অবনতি, ¯œায়বিক দুর্বলতা, অনিদ্রা, রক্তদূষণ, ক্ষুধামন্দা, পেটে ব্যথা, বমিভাব ইত্যাদি। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যায় এবং য²া, এইডস, হেপাটাইটিস প্রভৃতি রোগে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তৃতীয়ত, সামাজিক অবনতি যেমন পারিবারিক অশান্তি, অপরাধমূলক আচরণ, অসামাজিক কার্যকলাপের প্রবণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। পরিশেষে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দিকগুলো হচ্ছে নিজে সর্বস্বান্ত হওয়া, পরিবার-পরিজনকে অভাবে ফেলা, ঋণের বোঝা ভারি করা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ইতাদি। এক কথায় বলা যায়, পরিবারের সবকিছু সর্বস্বান্ত করে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরিশেষে নির্মম করুণ পরিণতি এবং মৃত্যুকে বরণ করাই হচ্ছে একজন মাদকাসক্তের বাস্তব পরিণতি।
মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে কিছু না কিছু লক্ষণ মাদকাসক্তের মধ্যে প্রকাশ পাবেই। বাবা-মা যেহেতু সন্তানকে সবসময় খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পান, তাই তার পক্ষেই কেবল বোঝা সম্ভব সন্তান মাদকাসক্ত হয়েছে কিনা।
প্রাথমিক অবস্থাতে মাদকাসক্তের লক্ষণ ও নমুনা শনাক্ত করতে পারলে সহজেই তাকে ¯েœহ-ভালোবাসা ও পরিচর্যা দিয়ে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে। সহজ কিছু লক্ষণ হলো- মন খুব অস্থির থাকবে এবং মেজাজ কখনো খুব ভালো আবার কখনো খুব খারাপ থাকবে; গুছিয়ে কথা বলতে পারবে না, মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমতে থাকবে; রাতে ঠিকমতো ঘুমাবে না, দিনে বসে বসে ঝিমাবে; আচরণে পরিবর্তন আসবে এবং শরীর ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যাবে; দিনের একটি বিশেষ সময়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠবে; জিহ্বা অপেক্ষাকৃত শুকনো থাকবে, কখনো চুপ আবার কখনো বেশি কথা বলবে; খাবার গ্রহণের প্রতি অনীহা আনবে, ফলে ক্ষুধা কমতে থাকতে থাকবে; আড্ডায় বেশি সময় নষ্ট করবে এবং বিনা কারণে টাকার অতিরিক্ত চাহিদা বাড়বে।
মাদকাসক্তি এবং অপরাধ দুটিই পাশাপাশি চলে থাকে। মাদকাসক্তরা সেসব অপরাধ কর্মেই লিপ্ত থাকে, যেগুলোতে অল্প প্রচেষ্টায় ও পরিশ্রমে অধিক অর্থ আদায় করা যায়। একজন মাদকাসক্তের কারণেই সমাজে খুন, হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই প্রভৃতি ঘৃণতম ও নৃশংস ঘটনা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ফলে দেশ ও জাতির স্বাভাবিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। বাংলাদেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতার প্রেক্ষিতে সরকার প্রথম ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০’ প্রচলন করেন এবং এজন্য দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডও গঠিত হয়েছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর ২৬ জুন আমাদের দেশেও পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস’। অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সভা, সেমিনার, স্লোগান। প্রচেষ্টা চালানো হয় মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাদকাসক্তি রোধ করার। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এসব কর্মসূচি ও পদক্ষেপ তেমন আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
অথচ মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। তাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বা মাদকাসক্তি রোধে জনগণকেও দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রতিটি বাবা-মাকে তার সন্তানের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে তার সন্তান বন্ধু-বান্ধবের প্রভাবে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিপথগামী বা মাদকজাতীয় দ্রব্যে আসক্ত হয়ে না পড়ে। আর যদি আসক্ত হয়েই পড়ে, তখন তাদের উচিত অবহেলা না করে বা উত্তেজিত না হয়ে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে সুস্থ পথে ফিরিয়ে আনা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
মাদকাসক্তি মানব সভ্যতার একটি ভয়ংকর, জটিল ও জীবন হননকারী সামাজিক ব্যাধি। মাদকাসক্তির হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে সহজেই ধ্বংস হবে তরুণ সমাজ, বিনষ্ট হবে আধুনিক সভ্যতা। প্রশ্ন হচ্ছে, মাদকদ্রব্যের বিষাক্ত ছোবল থেকে তরুণ সমাজকে বের করে আনা সত্যিই কি কোনো কঠিন কাজ? অনেকটা সময় চলে গেছে। অনেকগুলো জীবন এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ আমরা নির্মূল করতে পারিনি মাদকদ্রব্য, আটকাতে পারিনি এর সহজলভ্যতা। অপেক্ষার প্রহরে বসে না থেকে আমরা কিন্তু যে কোনো কঠিন ও অসাধ্য কাজ সহজেই সমাধান করতে পারি! শুধু এজন্য দরকার সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা এবং কাজটির বাস্তবায়নে সঠিক ও বাস্তব পদক্ষেপ। আরো জোরালো দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রকে সাহায্য করার দায় রয়েছে মাদকদ্রব্য সেবনকারীর বাবা-মা আর বন্ধু-বান্ধবদের। পাশাপাশি মাদকদ্রব্য আমদানি, বিক্রি এবং এর সহজলভ্যতার দিকেও প্রশাসনকে কঠিন দৃষ্টি রাখতে হবে। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি প্রদান করতে হবে তাদের, যারা মাদকদ্রব্যের আমদানি ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। খুব সহজেই যেন কোনো মাদকদ্রব্য সবার নাগালের মধ্যে না আসতে পারে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। জীবন ঘাতক মাদকদ্রব্যের ছোবল থেকে যেভাবেই হোক তরুণ সমাজকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।

প্রদীপ সাহা
কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়