যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা ও প্রতিরোধযুদ্ধে চট্টগ্রাম : ইতিহাসের কয়েকটি অমলিন পাতা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়ার পর স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল পাক সামরিক জান্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের আগাম ইঙ্গিত দেন।
বস্তুত মার্চ মাসের শুরু থেকেই চট্টগ্রামে অবস্থানরত তৎকালীন ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগাযোগ শুরু হয়। বিভিন্ন বৈঠকে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলার ব্যাপারে বিভিন্ন কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রামের ছাত্র, শ্রমিক, জনতা যেভাবে ফুঁসে উঠেছিল তাতে আকাশ বাতাশ ও পরিবেশ বারুধগন্ধি রূপ নেয়। এভাবে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর পাক সামরিক বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি চলে আসে সীতাকুণ্ড ওয়্যারলেস চেম্বারে। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সংবলিত এই বার্তায় বলা হয় :
‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রæদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।
আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রæকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এই সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন।’ — শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার সময় জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসার ৮০৭৮৫ টেলিফোন নাম্বারে ঢাকা থেকে একটি কল আসে। তার স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর ফোন রিসিভ করে মেসেজটি লিখে নেন।
এই মেসেজ পাওয়ার পর জহুর আহমদ চৌধুরী তার স্ত্রীর কাছ থেকে মেসেজের ব্যাপারে অবগত হন এবং তখনই তিনি বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেন। মেসেজের ব্যাপারে সবাইকে অবহিত করেন এবং বিভিন্ন নির্দেশ দেন। ডা. নুরুন্নাহার জহুর- জহুর আহমদ চৌধুরীর নির্দেশ মতো এই মেসেজ ছলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠান এবং বাইরের দুনিয়ায় প্রচার করতে অনুরোধ করেন।
ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুর রাত ৩টার দিকে ছলিমপুর কোস্টাল স্টেশনের সহকারী প্রকৌশলী একেএসএমএ হাকিমের উদ্দেশে ওয়্যারলেস স্টেশনে ৯৩২০০ নম্বরে টেলিফোন করেন। কিন্তু হাকিম তখন উপস্থিত না থাকায় সেখানকার রেডিও টেলিফোন টেকনিশিয়ান জালাল আহমেদ ফোন ধরেন। ডা. নুরুন্নাহার জহুর নিজের পরিচয় ব্যক্ত করে জালাল আহমেদকে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানিয়ে এটি লিখে নিতে বলেন এবং হাকিম সাহেব আসলে তার সঙ্গে পুনরায় টেলিফোনে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানায়।
ইতোমধ্যে সহকারী প্রকৌশলী হাকিম সাহেব অফিসে আসেন এবং টেকনেশিয়ান জালালের কাছ থেকে খবর পেয়ে ডা. নুরুন্নাহার জহুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে সেটি তার সহকর্মীদের সহায়তায় বহির্বিশ্বে প্রেরণের সিদ্ধান্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ওইদিনই বার্তাটি ছলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ওয়্যারলেস যোগে নিকটস্থ কলকাতা বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে সরাসরি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং সমুদ্রগামী অন্যান্য বিদেশি জাহাজে প্রেরণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, এটা নিশ্চিত হয়ে রাতেই নেতৃবৃন্দ চলে যান আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসা চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউসে। এমএ হান্নান ও এমএ মান্নান যান বিনোদা ভবনস্থ আওয়ামী লীগের অফিসে। সেখানে উপস্থিত কর্মীদের মাধ্যমে করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণার বাংলা অনুবাদ। বাংলা অনুবাদসহ সাইক্লোস্টাইল কপি। শুরু হয় মাইকিং। ঘোষণার সঙ্গে সর্বত্র কপি বিলি। ডা. নুরুন্নাহার জহুরও একাধিক কপি করে পাঠান এদিক সেদিক। এভাবে রাত গেল।
পরদিন সকালে আবারও নেতাকর্মীরা জড়ো হয় আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন জুপিটার হাউসে। সেখানে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাটি রেডিওর মাধ্যমে জনগণকে জানানো প্রয়োজন। এ সময় এমএ হান্নান, এমএ মান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. এমএ মান্নান, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, মীর্জা আবু মনসুর, রাখাল চন্দ্র বণিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে স্থির হয় যে, জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও এমআর সিদ্দিকীসহ চট্টগ্রামের তৎকালীন এমপিদের মধ্যে যারা শহরে আছেন তারা একযোগে রেডিও স্টেশনে যাবেন এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন।
সেখান থেকে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনের দিকে যাওয়ার প্রাক্কালে কয়েকজন আসেন আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। তাদের সঙ্গে মিলিত হন মিরসরাই থেকে আসা ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন। তিনিসহ মীর্জা আবু মনসুরও রওনা দেন আগ্রাবাদ বেতারকেন্দ্রে। তখন বেলা প্রায় ১২টা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
বঙ্গবন্ধু বন্দি হওয়ার পূর্বেই চট্টগ্রামে যে স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী প্রেরণ করেন। তা স্বাধীনতার দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ডে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বাণীটি নিম্নরূপ-
উঊঈখঅজঅঞওঙঘ ঙঋ ওঘউঊচঊঘউঊঘঈঊ
ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সবংংধমব, ভৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং রহফবঢ়বহফবহঃ. ও পধষষ ঁঢ়ড়হ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয যিবৎবাবৎ ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ রিঃয যিধঃবাবৎ ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ রিঃয যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব ধৎসবু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ঃড় ঃযব ষধংঃ. ণড়ঁৎ ভরমযঃ সঁংঃ মড় ড়হ ঁহঃরষ ঃযব ষধংঃ ংড়ষফরবৎ ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ধৎসু রং বীঢ়বষরবফ ভৎড়স ঃযব ংড়রষ ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ভরহধষ ারপঃড়ৎু রং ধপযরবাবফ.

ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ
(বাংলা অনুবাদ) ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এই আমার শেষ কথা। যে যেখানে থাকুন না কেন সকলের প্রতি আমার আবেদন রইল, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর মোকাবিলা করুন এবং বাংলার মাটি থেকে দখলদার বাহিনীকে সমূলে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়ে যান।’
[গবংংধমব বসনড়ফরহম উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব ংবহঃ নু ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁমরনঁৎ জধযসধহ ঃড় ঈযরঃঃধমড়হম ংযড়ৎঃষু ধভঃবৎ সরফহরমযঃ ড়ভ ২৫ঃয গধৎপয, ১৯৭১ ভড়ৎ ঃৎধহংসরংংড়হ ঃযৎড়ঁমযড়ঁঃ ইধহমষধফবংয ড়াবৎ ঃযব বী- ঊচজ ঃৎধহংসরঃঃবৎ.]

ঢাকায় পাকবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন
২৫ মার্চ রাতে একে একে সবাই বিদায় নিলেন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়ি থেকে। কিন্তু তিনি কোথাও গেলেন না। কোম্পানি কমান্ডার মেজর বেলাল এক প্লাটুন কমান্ডো নিয়ে রাত দেড়টায় বিদ্যুৎ গতিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল। ৫০ জন কমান্ডো বাড়ির চার ফুট উঁচু পাঁচিলের ওপর উঠে বাড়ি লক্ষ্য করে স্টেনগানের এক পশলা গুলিবর্ষণ করল। এরপর বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করল ও বঙ্গবন্ধুুকে বেরিয়ে আসতে বলল। দোতলায় উঠে কমান্ডোরা বঙ্গবন্ধুর বেড রুমের দরজা ও জানালার দিকে গুলি ছুড়তে লাগল।
বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসে সৈন্যদের গুলি থামাতে বললেন। সৈন্যরা খোলা বেয়নেট হাতে বঙ্গবন্ধুকে চার্জ করার জন্য চারদিক থেকে এগিয়ে এলো। মুহূর্তেই এক অফিসার বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে হকুম দিল, ‘ওকে হত্যা করোনা’। এরপর টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে চলল তারা বঙ্গবন্ধুকে। পেছন থেকে কিল-ঘুসি থেকে শুরু করে বন্দুকের কুঁদোর বাড়ি। অফিসার তার হাত ধরে রাখা সত্ত্বে¡ও সৈন্যরা তাকে নিচে নামানোর জন্য টানতে লাগল।
বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বললেন, আমাকে টানাটানি করো না। দাঁড়াও আমি আমার পাইপ ও তামাক নিয়ে আসি। না হয় আমার স্ত্রীকে ওসব নিয়ে আসতে দাও। পাইপ আমাকে সঙ্গে নিতেই হবে।
এর পর বঙ্গবন্ধু ঘরে এলেন। বেগম মুজিব তখন দুই ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, শিশু রাসেল ঘুমাচ্ছে বিছানায়। বেগম মুজিব তখন তাকে পাইপ আর একটি ছোট্ট স্যুটকেস গুছিয়ে দিলেন। সৈন্যদের হাতে বন্দি হয়ে মুজিব রওয়ানা দিলেন। দেখলেন আশপাশে আগুন জ্বলছে। ওখান থেকে তাকে সামরিক জিপে করে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়, রাতে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হলো আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে, পরদিন ফ্লাগস্টাফ হাউসে তাকে হস্তান্তর করা হয়। তিন দিন পর বিমানযোগে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে।

ছাব্বিশ মার্চের চট্টগ্রাম
২৬ মার্চ সকাল ৮টায় বেতার ঘোষণায় শোনা গেল, পূর্ব পাকিস্তানকে টিক্কা খানের অনুগ্রহের ওপর ছেড়ে দিয়ে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছে গেছেন। সকাল সাড়ে ৮টায় ভুট্টোও বিপুলসংখ্যক সৈন্যের কড়া প্রহরায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে ঢাকা বিমানবন্দরের দিকে যাত্রা করেন। জনমানবশূন্য রাজপথে কেবলমাত্র ট্যাঙ্ক এবং সৈন্যরা চলাচল করতে থাকে এবং কাউকে দেখামাত্রই তারা গুলি চালাতে থাকে।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেসব বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়। ২৬ মার্চের সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। বিদেশি সাংবাদিকদের বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাত সাড়ে ৮টায় সেনাবাহিনীর গাড়ি এসে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে থামে। সকালে পিআইএর বোয়িংযোগে তাদের সবাইকেই ত্যাগ করতে হলো পূর্ব পাকিস্তান।
এদিকে চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের দপ্তরে টেলিফোনে খবর এলো যে, পাকিস্তানি সেনারা নৌ-ঘাঁটি থেকে অগ্রসর হয়ে হালিশহরের ইপিআর প্রতিরক্ষা ব্যুহের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ইপিআর ট্রুপস এই আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রæদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পাকিস্তানিরা হালিশহরে কোনো বাধা আশা করেনি। তাদের অগ্রবর্তী দলটি হালিশহরের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখীন হতেই ইপিআর বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে গুলি চালাল। পাকিস্তানিরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বহুসংখ্যক হতাহত হলো। অবশেষে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো।
এই সময় ক্যাপ্টেন রফিক অপর এক টেলিফোনে জানতে পারলেন, ৮০ থেকে ১০০টি যানের বিরাট একটি কনভয় কুমিল্লা থেকে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল সফির নেতৃত্বে চট্টগ্রামের দিকে আসছে। সংবাদ পাওয়ার পরপরই ক্যাপ্টেন রফিক পাকিস্তানি কলামটিকে অ্যাম্বুশ করার জন্য একজন জেসিওর নেতৃত্বে হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাঠালেন কুমিরায়। হালকা মেশিনগান এবং ভারী মেশিনগান ছাড়াও কোম্পানিটির সঙ্গে ছিল ৩ ইঞ্চি মটার ও রকেট লঞ্চার। ইপিআর সৈন্যরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে কুমিরায় রাস্তার পূর্বপাশের একটি উঁচু জায়গায় অ্যাম্বুশ করে বসেছিল।
পাকিস্তানি কনভয়টি কুমিরায় পৌঁছে ধরেই নিয়েছিলেন যে, আর মাত্র মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই চট্টগ্রামের পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন এবং তারপরই নামতে পারবেন বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি জীবনের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। ইপিআর সৈন্যদের অ্যাম্বুশে তিনি এবং তার প্রায় অর্ধেক সৈন্য দিশেহারা হয়ে পড়ল।
এই অ্যাম্বুশে গুলির শিকার হয়েছিলেন ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল শাহনুর খানসহ ৭০ জন পাকসেনা। আহত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা ছিল প্রচুর। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল সফি জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণপণে ছুটেছিলেন পাহাড়ের দিকে। এক ঘণ্টারও বেশি সময় এই গুলি বিনিময় চলল। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ইপিআরের ৫ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। কুমিরায় শত্রæর বিরুদ্ধে ইপিআর সেনাদের এই অ্যাম্বুশ ছিল স্বাধীনতা ইতিহাসের প্রথম সরাসরি আক্রমণ।
২৬ মার্চ ভোর নাগাদ কাপ্তাই থেকে ক্যাপ্টেন হারুন বাহিনী নিয়ে শহরের পাঁচ মাইলের মধ্যে এসে পড়লেন। তার সৈন্যরা উচ্চকণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ সেøাগান দিতে দিতে আসছিল।
কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে এসেই থামতে হলো তাদেরকে। কয়েকজন সৈন্যকে শহর ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে যেতে দেখে কিছুক্ষণের জন্য ক্যাপ্টেন হারুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন ‘শত্রæরা কি তাহলে পুরোপুরি শহর দখল করে ফেলেছে।’ এই ভাবনা তাকে কিছুটা হতবুদ্ধি করে দেয়। পরে দেখা গেল যে এরা বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং মেজর জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল লোক। তারা সবাই পটিয়ার দিকে যাচ্ছিল। শহরে ঢোকার আগে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি কালুরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের দেখা পেলেন। মেজর জিয়া তাকে কালুরঘাট এলাকাতেই থাকতে বললেন।
ফলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে শহরের যুদ্ধে যোগ দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হলো না। কক্সবাজার ইপিআর কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মফিজ। তিনি দুটি ইপিআর কোম্পানি নিয়ে শহরে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য কক্সবাজার ত্যাগ করেছিলেন।
তাকেও কালুরঘাট এলাকায় থামিয়ে সেখানেই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। ফলে তিনিও ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগ দিতে পারেননি। তিনি পরে ক্যাপ্টেন রফিককে বলেছিলেন, এটা আমার ত্রæটি ছিল না। মেজর জিয়া আমাকে কালুরঘাটে থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাকে আপনার নির্দেশের কথা জানালে তিনি আমাকে জানান শহরে কেউ নেই। অবশ্য পরে দেখা গেল আপনি তখনো শহরে যুদ্ধ করে চলেছেন।
ক্যাপ্টেন রফিক তখনো শহর ছাড়েনি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনাদের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিল। কুমিরায় প্রধান সড়ক বরাবর প্রচণ্ড লড়াইয়ের দরুন রামগড়ের ইপিআর সৈন্যরা আসতে পারছিল না। শহরে যে ক’জন সৈন্য ছিল শুধু তাদের সম্বল করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া ক্যাপ্টেন রফিকের আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। নৌবাহিনীর সদর দপ্তর এবং পোর্ট মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
সকাল ৯টা নাগাদ অনেক উঁচু দিয়ে শহরে হেলিকপ্টার ঘোরাঘুরি শুরু করল। বিরাটাকায় সি-১৩০ বিমানগুলো ঢাকা থেকে সৈন্য আনতে থাকল।
এমনই অবস্থায় ক্যাপ্টেন রফিক ও তার বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের প্রচেষ্টা ছিল, ক্যান্টনমেন্ট ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে শত্রæদের বের হতে না দেয়া। কিন্তু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়া এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব সৈন্য নিয়ে শহর ছেড়ে মেজর জিয়া বোয়ালখালীর দিকে পালিয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের বেরোনো সহজতর হয়ে উঠেছিল। ঘটলও তাই, ট্যাঙ্কের ছত্রছায়ায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ল। নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে পাকসেনারা তখনো আটক অবস্থায়। সমগ্র আগ্রাবাদ রোডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ছিল ইপিআর সৈন্যদের দখলে। ইপিআর হালিশহরের কাছে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল বলে শত্রæ পক্ষের একটি লোকের পক্ষেও চলাচল করা সম্ভব ছিল না।
২৬ মার্চ সকালে ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সার এবং আওয়ামী লীগের আরো কয়েকজন রেলওয়ে হিলে ক্যাপ্টেন রফিক ও তার সৈন্যদের জন্য সকালের নাস্তা ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গেলেন। ওই সময় ক্যাপ্টেন রফিক টেলিফোনে এম এ হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী এবং এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনা করলেন। তাদের তিনি এ কথাও বললেন যে, চট্টগ্রাম শহরে আমরা যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি এ কথা রেডিওতে প্রচার করা দরকার। সেই অনুসারে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ একটি খসড়া ঘোষণা তৈরি করে দিলেন এবং সেটি চূড়ান্তভাবে তৈরি করে দিলেন ডা. জাফর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঙালিদের জীবন বাঁচানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদনই ছিল ঘোষণাপত্রটির মূল বক্তব্য।
বাঙালির হাতে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করার জন্যও ঘোষণায় আহ্বান জানানো হয়। এই ঘোষণাটি কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র ২৬ মার্চ দুপুর প্রায় আড়াইটায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে’ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এমএ হান্নান পাঠ করে শোনান।
এদিকে চট্টগ্রামে পাকিস্তানিদের সাহায্যার্থে বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য ২৬ এবং ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। বিমানবন্দর থেকে পাকসেনারা আগ্রাবাদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের অপর একটি গ্রুপ হালিশহর ইপিআর সদর দপ্তরের দিকে অগ্রসর হয়। হালিশহরে ছিল ক্যাপ্টেন রফিকের শক্তিশালী ইপিআর বাহিনী।
অপরদিকে কুমিরায় ইপিআর বাহিনীর হাতে আক্রান্ত ব্রিগেডিয়ার শফি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটি কলামকে সেনানিবাসে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। অপর কলামকে উপকূল রেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে বাঁধের ওপর অবস্থান গ্রহণকারী ইপিআর সৈন্যদের ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিলেন।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। মাঝেমধ্যেই উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় চলছিল। সংঘর্ষ এলাকা থেকে জনসাধারণ ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকলেও এলাকার তরুণরা ইপিআর সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে খাবার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে থাকে।
উপকূল বরাবর শত্রæ সেনাদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়েই ইপিআর বাহিনী আরেকটি অ্যাম্বুশের আয়োজন করে। পাকিস্তানিরা সেই অ্যাম্বুশে পড়ে যায়। এখানেও শত্রæ সৈন্যদের অনেকে হতাহত হয়। ভীত পাকিস্তানিরা তাদের মৃত সঙ্গীদের ফেলেই নানা দিকে দৌড়াতে থাকে। অনেকেই পথ ভুলে গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়লে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেই প্রাণ হারায়।
ইতোমধ্যে ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর কোম্পানির গোলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। অপরদিকে হালিশহর সদর দপ্তরেও গোলাবারুদ আর তেমন ছিল না। এই পরিস্থিতিতে তিনি কুমিরার কোম্পানিকে পেছনে সরে শহরের উপকণ্ঠে হালিশহর সদর দপ্তরের কাছে নতুন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে বললেন।
এদিকে রাঙামাটি থেকে আগত ইপিআর সেনারা ক্যান্টনমেন্টের অদূরে বাধাগ্রস্ত হন এবং রামগড় এলাকার অপর দুটি ইপিআর কোম্পানিও মূল সড়ক পথ ধরে অগ্রসর হতে পারছিল না। এ সময় ক্যাপ্টেন রফিকের সামনে দুটি বিকল্প পথই খোলা ছিল। হয় ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার দখল করা অথবা গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা। অন্যসব সম্ভাবনা ব্যর্থ হলে চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে শেষেরটিই বিবেচনা করা যায় বলে তিনি মনে করলেন।
তিনি প্রথম পন্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তখনই রামগড়ের একটি কোম্পানিকে মাঠের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ক্যান্টনমেন্টের পেছনে অবস্থানকারী ইপিআর সেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলেন। অপর কোম্পানিকে শুভপুর সেতু এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে বললেন, যাতে সড়ক পথে কুমিল্লা থেকে নতুন কোনো পাক সৈন্য চট্টগ্রামে আসতে না পারে।
২৬ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে নৌবাহিনীর যোগাযোগ ঘাঁটিতে পাকসৈন্যদের আনাগোনা লক্ষ করলেন। রেলওয়ে পাহাড়ের ক্যাপ্টেন রফিকের ট্যাকটিক্যাল হেড কোয়ার্টার থেকে পাশের একটা মসজিদে পাকসেনাদের আনাগোনা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এই সময়ে হালকা মেশিনগান নিয়ে অবস্থানকারী একজন ইপিআর সিপাই যে মুহূর্তে ট্রেঞ্চ থেকে মাথা তুলল অমনি একটি বুলেট তাকে আঘাত করল।
গুলিটি আসে মসজিদের দিক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রæরা ক্যাপ্টেন রফিকের রেলওয়ে সদর দপ্তরের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে ব্যাপকভাবে গুলি চালাতে শুরু করে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকেও নৌবাহিনীর ভারী কামানগুলো গোলাবর্ষণ শুরু করল। কামানের গোলা রেলওয়ে সদর দপ্তরের চতুর্দিকে পড়তে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রæদের একটি দল, টাইগারপাস ঘাঁটি থেকে আক্রমণ চালায়। অবশ্য এই আক্রমণ সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিহত করেন ইপিআর সৈন্যরা। কিছুক্ষণ পর অপর দিক থেকেও হামলা হতে থাকে।
অনুরূপভাবে হালিশহর ইপিআর ঘাঁটিতেও কয়েক দফা হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই শত্রæ সৈন্যরা হটতে বাধ্য হলো। গুলির শব্দে গোলার বিস্ফোরণে সমস্ত শহর কেঁপে কেঁপে উঠছিল বারবার।
এই সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন রফিকের অবস্থানের কাছেই চলে আসে ট্যাঙ্ক। রেলওয়ে হিলের সদর দপ্তর শত্রæ দ্বারা ঘেরাও আসন্ন হয়ে উঠল। অথচ ইপিআরদের ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না, তাদের গোলাবারুদও প্রায় শেষ।
এই অবস্থায় রেলওয়ে হিলের অবস্থান ত্যাগ করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দিল। তখন চারদিকেই শত্রæ সেনা। ক্রমাগত ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কামানগুলো আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখে। এই সংকটময় অবস্থায় ক্যাপ্টেন রফিক তার সৈন্যদের কোতোয়ালি থানার দিকে যেতে নির্দেশ দেন এবং সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের পেছনে সবাইকে একত্র হতে বললেন। গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় যখন সবাই স্থান ত্যাগ করে চলে যায় তারপরই ক্যাপ্টেন রফিক ঘাঁটি ত্যাগ করার জন্য পা বাড়ান।
কদমতলী রেলক্রসিংয়ের কাছে নৌ-সেনাদের দুটি ট্রাক এ সময় অন্ধকারের মধ্যে অবস্থান করছিল। রাস্তা পার হতে গিয়েই তিনি গাড়ির হেড লাইটের আলোতে পড়ে যায়। সামনে প্রাচীর দেখে সেদিকেই দৌড়াচ্ছেন। পেছনে নৌ-সেনাদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের শব্দ। একটি গুলি তার ডান হাতে ধরা স্টেনগানের লাগলে প্রচণ্ড বেগে ওপাশে গিয়ে পড়েন। বাম উরু থেকে রক্ত ঝরছিল। সেখান থেকে তিনি কোতোয়ালি থানায় পৌঁছে দেখেন ইপিআর সৈন্যরা জড়ো হয়ে আছে। সেখান থেকে চকবাজারের কিছু সামনে শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছতেই তিনি দেখলেন একজন ইপিআর সেপাই পায়ে হেঁটে শহরের দিকে ফিরছে।
‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’ তিনি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। বিষণ্ন কণ্ঠে সে জবাব দিল, ‘আপনার কাছেই স্যার।’ ‘আপনি ক্যান্টনমেন্টের পেছনের এলাকায় গিয়ে আমাদেরকে একত্র হওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু একজন অফিসার অন্যপথ দিয়ে সৈন্যদের নিয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে চলে গেছেন।’ ক্যাপ্টেন রফিক চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন অফিসার?’
ডা. জাফর ও এম এন হান্নান থেকে তিনি জানতে পারলেন মেজর জিয়াউর রহমান ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর সেনাদের কালুরঘাট সেতুর দিকে নিয়ে গিয়েছেন। ক্যাপ্টেন রফিক আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধ করলেন তারা যেন জিয়াকে বলেন, তার ইপিআর সৈন্যদের ছেড়ে দিতে, যাতে ওরা শহরে এসে তার সঙ্গে যোগ দিতে পারে। তদনুসারে ডা. জাফর, আতাউর রহমান খান কায়সার, এম এ হান্নান এবং আরো কয়েকজন কালুরঘাটের দিকে রওয়ানা হয়ে যান।
গোমদণ্ডি স্টেশনের কাছে মেজর জিয়া, মেজর শওকত এবং অন্য কয়জন অফিসারের সাক্ষাৎ পান। তারা শহরে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য তার ইপিআর সৈন্যদের ছেড়ে দিতে বলেন। মেজর জিয়া জবাব দেন যে, তার সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের পরই তিনি ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগ দেবেন। নেতৃবৃন্দ ফিরে গিয়ে সব কথা ক্যাপ্টেন রফিককে জানালেন। কিন্তু মেজর জিয়া ও তার সঙ্গের অন্য অফিসাররা শহরের লড়াইয়ে আর যায়নি।

সাতাশ মার্চের চট্টগ্রাম
সেদিন অপরাহ্নে আবার ক্যাপ্টেন রফিক আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান, আতাউর রহমান কায়সারসহ কয়েকজন নেতাকে মেজর জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। এবার তিনি অনুরোধ জানালেন তিনি যেন এসে সংগ্রামরত সৈন্যদের পক্ষে বেতারে কিছু বলেন। তাদের অনুরোধে অনুরুদ্ধ হয়ে ঐদিন বিকালে (২৭ মার্চ) তিনি কালুরঘাটস্থ রেডিও স্টেশনে আসেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এক ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি ‘সামরিক অভ্যুত্থান’ বলে উল্লেখ করলে সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষুব্ধ হলো। সেই মুহূর্তেই মানসিক অবস্থা ও উত্তেজনায় অসাবধানতাবশত এই ভুলটি হয়ে গেল। এতে ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হলো।
এম আর সিদ্দিকী তৎক্ষণাৎ ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বললেন, ‘এই ঘোষণা আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্রকে বিপন্ন করে তুলবে। জনগণের অভ্যুত্থান না বলে একে সামরিক অভ্যুত্থান বলে পৃথিবীর মানুষ ভুল বুঝতে পারে।’ আওয়ামী লীগ নেতারা আবার মেজর জিয়ার কাছে গেলেন। এরপর মেজর জিয়া এক সংশোধিত বেতার ভাষণে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে পুনরায় ঘোষণা দেন। ঘোষণাটি নিম্নরূপ-
উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ রহফবঢ়বহফবহপব—
গধলড়ৎ তরধ, যবৎবনু ঢ়ৎড়পষধরসং, ড়হ নবযধষভ ড়ভ মৎবধঃ ষবফমবৎ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ ঃযব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয.
ও ধষংড় ফবপষধৎব, বি যধাব ধষৎবধফু ভড়ৎসবফ ধ ংড়াবৎবরমহ, ষবমধষ এড়াবৎহসবহঃ ঁহফবৎ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ যিরপয ঢ়ষবফমবং ঃড় ভঁহপঃরড়হ ধং ঢ়বৎ ষধি ধহফ ঃযব পড়হংঃরঃঁঃরড়হ. ঞযব হবি ফবসড়পৎধঃরপ এড়াবৎহসবহঃ রং পড়সসরঃঃবফ ঃড় ধ ঢ়ড়ষরপু ড়ভ হড়হ-ধষরমহসবহঃ রহ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ৎবষধঃরড়হ, রঃ রিষষ ংববশ ভৎরবহফংযরঢ় রিঃয ধষষ হধঃরড়হং ধহফ ংঃৎরাব ভড়ৎ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ঢ়বধপব. ও ধঢ়ঢ়বধষ ঃড় ধষষ এড়াবৎহসবহঃ ঃড় সড়নরষরমব ঢ়ঁনষরপ ড়ঢ়রহরড়হ রহ ঃযবরৎ ৎবংঢ়বপঃরাব পড়ঁহঃৎরবং ধমধরহংঃ ঃযব নৎঁঃধষ মবহড়পরফব রহ ইধহমষধফবংয.
ঞযব এড়াবৎহসবহঃ ঁহফবৎ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ রং ংড়াবৎরমহ ষবমধষ এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ রং বহঃরঃষবফ ঃড় ৎবপড়মহরঃরড়হ ভৎড়স ধষষ ফবসড়পৎধঃরপ হধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ.
মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের মূল কপিটি ইংরেজিতে ড্রাফট করেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা এ কে খান। মেজর জিয়া ও অপর কয়জন ঘোষক ইংরেজি ও বাংলায় একই ঘোষণা কয়েকবার পাঠ করেন। বাংলায় অনূদিত ঘোষণাটি অনুবাদ করেন বিশিষ্ট নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, শত্রæর বিমান হামলায় ধ্বংস হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ ৩০ মার্চের মধ্যে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কর্মসূচির প্রথম সূত্রপাত হয়।
এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রটি প্রহরায় ছিল ইপিআর সৈন্যরা। চট্টগ্রাম রেডিওর বাঙালি প্রকৌশলী এবং অন্য কর্মচারীরা কেন্দ্রটির সবকিছু পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম কিংবা কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ ছিলেন না। অবস্থা এমন ছিল যে, যে কেউ এই রেডিও থেকে বক্তৃতা দিতে পারতেন। এমনকি এক অতি উৎসাহী ব্যক্তি বাঙালি ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাইকে লালদীঘি ময়দানে জমায়েত হওয়ার কথা ঘোষণা করে ফেললেন। পরে অবশ্য ঘোষণাটি বাতিল করে দেয়া হয়।
আটাশ মার্চের চট্টগ্রাম
২৮ মার্চ ভোর নাগাদ শত্রæপক্ষ ক্যান্টনমেন্ট এবং নৌ-বাহিনীর ঘাটির মধ্যবর্তী প্রধান সড়কের টাইগার পাস এলাকা দখল করে নেয় এবং নগরীর কেন্দ্রস্থলে সার্কিট হাউসে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে। কুমিরায় যে শত্রæ দলটিকে ইপিআররা প্রতিহত করেছিল তারাও এসে ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। ইপিআর বাঙালি সৈন্যরা সরে এসে হালিশহরের প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যুহে অবস্থান নেয়।
উল্লেখ্য যে, অভিজ্ঞ সমরবিদদের মতে পথে ইপিআর সৈনিকদের কালুরঘাটে মেজর জিয়া কর্তৃক আটকানো না হলে পোর্ট বিমানবন্দর এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর ইপিআর বাহিনী কর্তৃক দখল করা সম্ভব হতো এবং তাহলেই সমস্ত যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যেত।

উনত্রিশ মার্চের চট্টগ্রাম
পরদিন ২৯ মার্চ। সকালে শত্রæ সেনারা আগ্রাবাদ রোড অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং একটি দলকে তারা মাদারবাড়ী ও আইস ফ্যাক্টরি সড়ক হয়ে নিউমার্কেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়। তখন কোর্ট বিল্ডিংয়ে এক প্লাটুন শক্তিসম্পন্ন ইপিআর বাহিনী ছিল।

শহীদ হলেন বশরুজ্জামান ও তার সাথীরা
শত্রæদের আরেকটি দল স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের নৌ-ভবন থেকে বেরিয়ে পিআইএ অফিসের নিকটবর্তী হয়ে ডিসি হিলের দিকে এগোতে থাকে। এই সময় চেরাগী পাহাড়ের কাছে মোমিন রোডে তাদের সামনে পড়ে যায় জিপ আরোহী একদল যুবক। পাকসেনারা গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে দীপক বড়–য়া, জাফর আহমদ ও আনোয়ারার সন্তান বশরুজ্জামান চৌধুরী (আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ছোট ভাই) নির্মমভাবে প্রাণ হারান। তারা জিপযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে অবস্থানরত ইপিআর সৈন্যদের খাবার সরবরাহ করে শহরে ফিরছিলেন। এরপর পাকবাহিনী দ্রুতগতিতে পাহাড়ের ওপর উঠে সমগ্র এলাকাটি বিনা বাধায় দখল করে নেয়। কোর্র্ট বিল্ডিংয়ে তখন ইপিআর সৈন্যরা পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষমাণ।
এইদিন বিকেলে একটি অ্যাম্বুলেন্স দ্রুতগতিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। ডাক্তার নার্সরা আহত কোনো মুক্তিযোদ্ধা মনে করে সেদিকে ছুটে যায়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই বেরিয়ে আসে একদল শত্রæ সৈন্য, হাতে তাদের উদ্যত হাতিয়ার। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তারা হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। সন্ধ্যা নাগাদ আরো একদল শত্রæ এসে অবস্থারত সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দেয়। কর্মচঞ্চল হাসপাতাল ভবন এবং পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকায় নেমে আসে এক বিষণ্ন নীরবতা।
হালিশহর এবং কোর্ট বিল্ডিং ভবনে তখনো ইপিআর বাহিনীর সুদৃঢ় ঘাঁটি। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে তখনো ইপিআর বাহিনীর ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দলগুলো শত্রæসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কুমিল্লা থেকে আগত বিশাল পাকিস্তানি বাহিনী দেওয়ানহাট ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছে গেলে আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ইপিআর সৈন্যদের হালিশহর ঘাঁটিতে সরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

ত্রিশ মার্চের চট্টগ্রাম
৩০ মার্চ। শহরে তখন কারফিউ চলছে। হালিশহরে সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ চলতে থাকে। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে কামান দেগে চলছিল। ক্রমাগত দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা ধরে পাকহানাদাররা হালিশহরের উপর গোলাবর্ষণ করে।
কামানের ছত্রছায়ায় শত্রæরা হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইপিআর সৈন্যদের দুঃসাহসী পাল্টা আক্রমণের মুখে অগ্রগতি লাভে ব্যর্থ হয়ে শত্রæরা বিমান বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ইপিআর অবস্থানের ওপর ক্রমাগত বিমান হামলা চলতে থাকে। তাদের ইচ্ছেমতো রণাঙ্গনের ওপর আঘাত হানে। ইপিআর সেনানীরাও প্রাণপণে ঘাঁটি আঁকড়ে লড়াই করতে থাকল।
লড়াই করতে করতে অনেকেই ট্রেঞ্চের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল। আহতও হলো অনেক। কিন্তু অবিরাম বোমা বর্ষণের ফলে তাদের সরে আসাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধরত বাকি সৈন্যরাও বুঝতে পারল তাদের আর বেশিক্ষণ হালিশহর রক্ষা করা সম্ভব হবে না, গোলাবারুদও প্রায় ফুরিয়ে আসছিল।
অবশেষে তারা রাইফেলের ওপর বেয়োনেট লাগিয়ে শত্রæদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলো। উল্লেখ্য যে, ২৫ এবং ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে গ্রেপ্তারকৃত প্রায় পাঁচশর মতো পাকিস্তানি সৈন্যকে ইপিআর সৈন্যরা বন্দি করে হালিশহরে একটি বিল্ডিংয়ে রেখেছিলেন। ওদের দুর্ভাগ্য, এই বিল্ডিংটিকে শত্রæ বিমান এবং পাক গোলন্দাজ বাহিনী ইপিআর সদর দপ্তর মনে করে সরাসরি আঘাত হানতে থাকে। ফলে সমগ্র ভবনটি গুঁড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। এভাবে পাকিস্তানি বন্দি সৈনিকরা তাদের নিজেদের বিমান ও কামানের গোলার আঘাতে মৃত্যুবরণ করে।
বিকেলের মধ্যে শত্রæরা হালিশহর দখল করে নিল। হাতাহাতি যুদ্ধ চলেছিল আধঘণ্টার মতো। ইপিআর সৈন্যরা পেছনে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের এক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করলেন।
হালিশহর পতনের পর শত্রæদের পুরো দৃষ্টি পড়ল কোর্ট হিলের ওপর। এটাই ছিল শহরে ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর বাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থানটির ওপর কয়েকবারই হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই ইপিআর সৈন্যরা তা প্রতিহত করে।
এরপর এলো ট্যাঙ্ক বহর। অগ্রবর্তী ট্যাঙ্কটি পাকারাস্তা বেয়ে ওপরের দিকে এগিয়ে যেতেই ইপিআর সৈন্যদের ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী শেলের আঘাতে তা অকেজো হয়ে পড়ল। ট্যাঙ্কটি থেমে পড়লে পেছনে অন্যান্য ট্যাঙ্ক এবং পদাতিক সৈন্যরা কিছুটা থমকে দাঁড়াল। ইতোমধ্যে অবশ্য শত্রæপক্ষ ইপিআরদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিল এবং বাইরের সঙ্গে যোগাযোগও প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে নতুন করে কোনো সাহায্য লাভের সম্ভাবনাও তাদের ছিল না। ২ এপ্রিল ভোরে শত্রæরা আবার হামলা শুরু করল। হামলা ছিল সুপরিকল্পিত।
মাত্র ৩০ জন ইপিআর সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল পাকিস্তানের পুরো একটি ব্যাটেলিয়ন। দুটি কোম্পানি মিলে প্রথম আঘাত হানলে তা প্রতিহত করা হয়। এরপর আরও জোরদার হামলা চলতে থাকে। দুটি সংরক্ষিত কোম্পানি এবার অন্য দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। এদিকে ইপিআর সৈন্যদের গোলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়।
একমাত্র ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্রটিও অকেজো হয়ে পড়ে। বলতে গেলে অলৌকিকভাবে সেদিন ইপিআর সৈন্যদের প্রায় সবাই সে অবস্থান ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবেই কোর্ট হিলের পতন ঘটল এবং সঙ্গে সঙ্গে অনির্দিষ্টকালের জন্য চট্টগ্রাম নগরীও পাকহানাদারদের দখলে চলে যায়।
শহরের উপকণ্ঠে বহদ্দারহাট থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র ২৬ মার্চ থেকে যে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেছিল, ৩০ মার্চ বিকালে শত্রæর বিমান আক্রমণের ফলে তাও নিশ্চুপ হয়ে যায়।
এমনই পরিস্থিতিতে শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা ততক্ষণে গ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেকে সরাসরি সীমান্তের দিকেও চলে যায়। সকলেই কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ ঠিকই ভেবেছিল যে, কোনোরূপ সাহায্য ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ আমাদের পক্ষে দেরি হবে। তারপর গড়িয়ে গেল দীর্ঘ নয়টি মাস।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পরবর্তী ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি সৈনিক, ছাত্র, শ্রমিক জনতা সম্মিলিত প্রতিরোধ যুদ্ধের সূতিকাগার। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাসের নান্দিমুখ বিপ্লব তীর্থ এই চট্টগ্রাম। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যোদ্ধা ও জনতা যে সাহসিক শৌর্য-বীর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তা ইতিহাসের একটি অমলিন অধ্যায় হিসেবে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।

জামাল উদ্দিন
সাংবাদিক, গবেষক ও প্রকাশক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়