যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

লালন থেকে বাউল জালাল খাঁ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গ জনপদের বিভিন্ন অংশেই লোকজ গানের ধারায় বাউল সাধকদের বিস্তৃতির কথা জানা যায়। এসব শিল্পী কেউ কেউ স্বল্পশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত হলেও তাদের গানের বাণীর গভীরতা যে কোনো সচেতন মানুষের অন্তরেই নাড়া দিয়ে যায়। বাংলার বাউল গানের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে সামনে আসে বাউল শিরোমণি লালন শাহ্র কথা; যিনি তার গান দিয়ে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন; যা কিংবদন্তিরও অধিক। কিন্তু লালন শাহ্ই এ জনপদের প্রথম বাউল নন; অন্তত লালনের গান থেকেই আমরা তার সাধনগুরু সিরাজ সাঁইয়ের নাম জানতে পারি। ইসলাম ও সুফিবাদের প্রভাবে আমাদের বাউলরা যে বিশেষভাবে প্রভাবিত সে কথা সহজেই বলা যায়। এদেশে সুফি সাধকদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা-দূরদর্শিতা, সততা, সৎ-সাহস, চারিত্রিক দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, ঔদার্য, পরোপকারব্রত, সহিষ্ণুতা এবং সর্বোপরি মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দানের প্রবণতা এ জনপদের সাধারণ মানুষকে তাদের প্রতি যেমন আস্থাশীল করে তোলে। সুফি সাধকদের সঙ্গে বাংলার বাউল সমাজের চিন্তার ঐক্যই বাউল আর সুফি সাধকদের পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট করেছে, তেমনি বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে সাযুজ্যের সন্ধান পেয়েই সুফিবাদীরা নিজেদেরকে তাদের কার্যক্রমে একাত্ম হতেও প্রাণিত হয়েছেন; পর্যায়ক্রমে বাংলার সাধারণ মানুষ তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে তাদের চরিত্রের প্রভাব পড়েছে। সুরপ্রবণ জাতি হিসেবে সুফি সাধকদের প্রথম প্রভাব পড়ে আমাদের লোকগানে। মানুষ যখন নিজের আনন্দ-বেদনায় গান গেয়ে ওঠে, অবচেতনেও সে তার আকাক্সক্ষার কথাটি উচ্চারণ করে তার সুরে-
এক ব্রহ্ম বিনে আর দুই ব্রহ্ম নাই।
সকলের কর্তা এক নিরঞ্জন গোঁসাই-
সেই নিরঞ্জনের নাম বিছমিল্লা কয়।
বিষ্ণু আর বিসমিল্লা কিছু ভিন্ন নয়-
উদ্ধৃত এ লোকগান সাধারণের গান, যার ধর্মতত্ত্বজ্ঞান নিয়ে যে কারো সংশয় জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাংলার বাউল সাধকদের গানে সুফিবাদী চেতনার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন তার ‘হারামণি’র ভূমিকায় বাউলদের সম্পর্কে বলেন, ‘এদের প্রধান ধর্ম হচ্ছে উদাসীনতা। এদিক দিয়ে সকল দেশের মরমীয়াবাদীদের মতো বাউলরাও উদাসীন। সুফীরা নির্জনতা-প্রিয়। বৌদ্ধ শ্রমণদের মতো বাউলরাও নিরন্তন ভ্রমণশীল; সুফীরাও ভ্রমণশীল। বাউলরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসক। এরা প্রধানত মনের মানুষ রূপেই ঈশ্বরকে সাধনা করে। আল্লাহর আসন বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ে- মুসলমান ধর্মের মধ্যে এই উক্তি লক্ষণীয়।’ বাউলদের ধর্মসাধনা ও লক্ষ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটিও স্মরণযোগ্য; তিনি বলেন, ‘দেবতা মানুষের মনের মানুষ। জ্ঞানে, কর্মে, ভাবে আমরা যে পরিমাণে সত্য হই, সেই পরিমাণেই সেই মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাই।’
লালনের গানের সূত্র ধরে বলতে পারি, জীবনদর্শন-জীবনজিজ্ঞাসা-জীবনতৃষ্ণা বা জীবনাদর্শের কথা তিনি তার গানে বলে গেছেন। লালন তার সময়ের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা; কেবল তার সময়ের নয় সর্বকালেই লালন এক অনন্য প্রতিভার নাম। এবং লালন প্রতিভার সবচেয়ে বড় দিক তার আত্মানুসন্ধান।
বাউল লালন শাহ্র জীবনকাল (১৭৭২/৭৪-১৭ অক্টোবর ১৮৯০) এমন কোন অতীতের ঘটনা নয়, কিন্তু তারপরও আমাদের কাছে তার জীবনী সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত নয়। কারণ লালনের যে সামাজিক অবস্থান, তার যে পারিবারিক পরিচয় (যদিও তা সর্বজন স্বীকৃত নয়) তাতে তার সর্বসমক্ষে পরিচিত হয় উঠবার সুযোগ নিতান্ত কম; যাপিতজীবনে লালন প্রচারালোকের বাইরেই ছিলেন, যদিও ভক্তদের কাছে লালনের গান খুবই প্রিয় ছিল; লালনের অগণন অনুসারী নিজের কণ্ঠে লালনের গান ধারণ করে মানুষের মাঝে গেয়ে বেড়াতেন; এবং এভাবেই লালনের গান রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লালনের গান শুনে কেবল মুগ্ধ নন প্রভাবিতও হয়েছিলেন; রবীন্দ্রসংগীতে বাউল আঙ্গিকের যে সুরের সাক্ষাৎ আমরা পাই, তা-ও তিনি গ্রহণ করেছিলেন প্রধানত বাউল লালন ফকিরের গান থেকে। লালন তার গানে যে কাব্যশৈলীর স্বাক্ষর রাখেন, যা তার মৃত্যুর শতবর্ষ অতিক্রান্ত হবার পর আজো মলিন হয়ে যায়নি; বরং আজো লালন বিকশিত-আলোকিত-আলোচিত হচ্ছেন প্রতিদিন।
সমাজে জাত্যাভিজাত্য আর জাতিভেদের কারণে নানান অনাচারে অতিষ্ঠ লালনকে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করতেও দেখি, যে প্রতিবাদের সঙ্গে মিশে থাকে প্রবল ঘৃণা-
জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সব দেখি তানানানা \
আসবার কালে কী জাত ছিলে…
সাধক লালনকে নিয়ে আমাদের গভীর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন; সে গবেষণা যেন লোক দেখানো কার্যক্রম না হয়ে যায়; প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে গবেষণা কাজে সহযোগিতা এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা আবশ্যক এবং আমি বিশ্বাস করি এ প্রয়োজন বাঙালির গৌরব চিহ্নিতকরণের জন্যই অত্যাবশ্যক। আমরা চাইলে লালনের অসংখ্য গানের কথা আলোচনায় আনতেই পারি; কিন্তু পরিসরের কথা বিবেচনা করে আমরা বাংলার অন্যান্য বাউল সাধকদের সঙ্গে, বিশেষ করে বাউল জালাল খাঁর সঙ্গে পরিচিত হব লালনের চেতনা মাথায় রেখেই।
প্রথমেই আসে পাগলা কানাইয়ের নাম, অতপর পাঞ্জু শাহর নাম; লোকবাংলার বাউল জগৎ বাউল শিরোমণি লালন শাহ্ ফকিরের পরই যাকে সম্মানের আসনে রাখা হয়, তিনি বাউল পাঞ্জু শাহ ফকির (১৮৫১-১৯১৪)। জানা যায় যুবক বয়সে পাঞ্জু শাহ বৃদ্ধ লালন শাহ্ ফকিরের সঙ্গে পাল্লায় গান গেয়েছেন। পাঞ্জু শাহর পর আমরা উচ্চারণ করতে পারি হাসন রাজার নাম; যার প্রকৃত নাম অহিদুর রেজা চৌধুরী বা দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী (হাসন রাজা ছিল তার ছদ্মনাম) ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৯২২-এর ৬ ডিসেম্বর (২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। তার পাশাপাশি দুদ্দু শাহ্?, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্তসহ হয়তো আরো অনেকের নামই আসে; কিন্তু দর্শনচেতনার তুল্যমূল্য বিচারে লালন শাহ্র পর যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নামটি উচ্চারিত হয়, সেটি হাসন রাজা। হাসন রাজার অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। জন্ম তারিখ বিবেচনায় হাসন রাজার পরই আসে কানা জইমতের নাম; কানা জইমত ছিলেন জন্মান্ধ শিল্পী। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর গোবিন্দপুরে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন বাউল শিল্পী কানা জইমত। কানা জইমতের পর উপেন্দ্র সরকারের নাম। প্রথমত উপেন্দ্র সরকারের যাত্রা শুরু কবিগান দিয়ে। কবিগান গাইতে গাইতে নিজের প্রতিভাগুণে উপেন্দ্র সরকার হয়ে উঠলেন তার সময়ের খ্যাতিমান বাউল শিল্পী ও গীতিকার। উপেন্দ্র সরকারের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার শাকুয়াই বন্দেরপাড়া গ্রামে এবং ১৯৬২ সালে মাত্র পঁয়ষট্টি বছরের জীবন শেষ করেন। নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার বোয়ালি গ্রামে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বাউল সাধক উকিল মুন্সির জন্ম। ভাটির অঞ্চল ছাপিয়ে উকিল মুন্সির গান লোকবাংলার ঘরে ঘরে মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছে।
জন্ম তারিখ অনুযায়ী শাহ আবদুল করিমের নাম কিছু পরে এলেও এখানে আগেই উচ্চারণ করলাম; শাহ আবদুল করিমের জন্ম ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। ভাটিবাংলার কিংবদন্তি বাউলশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত শিক্ষক ছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিম। সাধারণ মানুষ তাকে ‘বাউল সম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নেত্রকোনা জেলার বাইরচাপড়া গ্রামে বাউল রশিদ উদ্দিনের জন্ম উনিশ শতকের শেষ দশকে। বয়সে বাউল জালাল খাঁর সমসাময়িক হলেও রশিদ উদ্দিন জালাল খাঁর সম্মানের পাত্র ছিলেন। এক সঙ্গে সংগীত সাধনা করলেও রশিদ উদ্দিনের গানের বাণী বাউল জালাল খাঁকে নতুন দিগন্তের দিশা দিয়েছিল।
এবার মূল প্রসঙ্গ বাউল জালাল খাঁ; বাংলার বাউল গানের প্রথম সারির একজন সাধক কবি জালাল খাঁ। মিডিয়ার দৃষ্টি হয়তো তার দিকে সে ভাবে পড়েনি, অথবা যাদের দায়িত্ব ছিল জালালের গানকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার হয়তো তারা নিজেদের নিয়ে অধিক মগ্ন ছিলেন, যে কারণে জালাল খাঁর গান সমস্ত বঙ্গে যতটা লোকপ্রিয় হওয়া সঙ্গত ছিল ততটা হয়ে ওঠেনি; তাতে সাধক কবি জালাল খাঁর কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেনি- ক্ষতি হয়েছে আমাদের। সাধক কবি জালাল উদ্দীন খাঁর জন্ম বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসাদহাটি গ্রামে ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে। পাঁচখণ্ডে সমাপ্ত ‘জালাল গীতিকা’ ছাড়াও তিনি ‘বিশ্ব রহস্য’ শিরোনামের প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেছেন। ১৯৭২-এর ৩১ জুলাই তিনি কেন্দুয়ার সিংহেরগাঁও নিজগৃহে পরলোকযাত্রা করেন।
ইতোপূর্বে যাদের নাম উচ্চারণ করা হয়েছে, তাদের সবার গানের চারিত্র্য বিবেচনা করে যদি লালনের গানের সঙ্গে তুলনা করা যায়; তাহলে আমরা সহজেই বলতে পারি হাসন রাজার গানে কিছুটা এবং জালাল খাঁর গানে অনেকটাই লালন ঘরানার সন্ধান করা যায়।
মানবতা-মানবতত্ত্ব বিষয়ক জালাল গীতিগুলো শুনতে শুনতে আমাদের সহজেই মনে পড়ে যায় লালনের সেই গান-
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছেড়ে খ্যাপারে তুই মূল হারাবি \
বলা হয়ে থাকে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাউল গানের চরম উৎকর্ষ লাভ ঘটে। সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সফল গায়ক ও গীতিকার ছিলেন বাউল কানা জইমত, উপেন্দ্র সরকার, রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, উকিল মুন্সি প্রমুখ। লালন শাহ্র একশ বছরেরও অধিক সময় পরে জালাল খাঁর জন্ম; সঙ্গত কারণেই বাউল গানের পরম্পরায় লালন আর জালাল খাঁর মাঝে বেশ কয়েকটি প্রজন্ম বাউল গানের শ্রীবৃদ্ধি করতে সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু বাউল গানের পরম্পরায় আমরা যাদের গানের সঙ্গে পরিচিত হই; সে অর্থে কেউ লালনকে অতিক্রম করে গেছেন, তেমনটি বলা যায় না। তারপরও বাংলার বাউল আঙ্গিনায় যাদের সন্ধান আমরা পাই, তাদের অনেকের গানেই নিজস্বতার পাশাপাশি দ্যুতিময় পঙ্ক্তির সন্ধান আমরা সহজেই পেয়ে যাই। বাউল গান প্রধানত ধর্মভিত্তিক গান;
শরিয়তি-মারফতি-মুর্শিদি ইত্যাদি আঙ্গিকে দেহতত্ত্ব, ধর্মীয়তত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, আধ্যাত্মবাদ, হাদিস-কুরআন-রামায়ণ-মহাভারতসহ নানান ধর্মীয় মতাদর্শ, ধর্মীয় পুরাণ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের জীবন-কর্ম নিয়ে বাউল গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। বাউল গানের এক বড় আকর্ষণ দুই বাউলের গানের লড়াই। একজন শরিয়তের পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন মারফতের পক্ষে; একজন নারীর পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন নারীর বিপক্ষে এবং পুরুষের পক্ষে; একজন পরকাল, বেহেস্ত-দোজখ-স্বর্গ-নরকের পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন জীবন-পৃথিবী-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পক্ষে। নিজের অবস্থানের পক্ষে নানান যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করতে চেষ্টা চলবে। বাউল শিল্পীদের মধ্যে কোনো শিল্পী জনমনে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। তাদের গান আজো গীত হতে শোনা যায়।
বাংলার বাউল গানের প্রথম সারির একজন সাধক কবি জালাল খাঁ। এখানে জালাল উদ্দীন খাঁকে লেখা শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিচ্ছি-

৬০নং পাতলা খাঁ লেন
ঢাকা
১৯-৩-৪৯

জনাব কবি সাহেব,
আচ্ছালামো আলায়কুম। আপনার প্রেরিত ‘জালালগীতিকা’ পাইয়াছি। একবার দুইবার পড়িয়াছি। মুগ্ধ হইয়াছি। কোন্ অজ্ঞাতনামা গ্রামে ফুটিয়া আপন সৌরভে আপনি মাতোয়ারা হইয়া রহিয়াছেন। আপনাকে লোক-চক্ষুর অন্তরাল হইতে টানিয়া রেডিওর বুকে ছড়াইয়া দিতে চাই। গ্রামোফোনের প্লেটে বাঁধিয়া ঘর ঘর বিলাইয়া দিতে চাই। ইতিমধ্যে রেডিওতে আপনার গান গাইয়াছি। দু’চার খান রেকর্ড করিতেছি। আপনার নিম্নলিখিত উপায়ে একখানা বইসহ রেডিও অফিসে দরখাস্ত করিবেন।

ষ্টেশন ডিরেক্টর
রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা

জনাব,
মৎপ্রণীত একখানি বই পাঠাইলাম। রেডিওতে আমার লেখা গানগুলি বিভিন্ন শিল্পীদ্বারা গীত হইলে বাধিত হইব।
ইতি-
এইভাবে একখানা দরখাস্তসহ বই পাঠাইবেন। … গানগুলির সুর তো আমার জানা নই। যদি কখনো ঢাকায় আসেন, মেহেরবাণী করিয়া উপরের ঠিকানায় ঢাকা সদরঘাট ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ৬০নং পাতলা খাঁর গলিতে এই গরীবের সাথে দেখা করিবেন। এপ্রিল মাসে আসিবেন। আসিবার আগে পত্র দিবেন।
আপনার আধ্যাত্মিক গান পড়িয়া সত্যই বুঝিয়াছি আপনি উঁচুদরের সাধক কবি। দূর হইতে আপনাকে সহস্র তছলিম জানাইতেছি। দোয়া করিবেন।

গুণমুগ্ধ গায়ক
আব্বাসউদ্দীন আহমদ
আব্বাসউদ্দীনের মতো প্রতিভাবান শিল্পী জালালকে নিয়ে আগ্রহ দেখালেও জালাল বঞ্চিত হয়েছেন; জালালের গান বেতারে-চলচ্চিত্রে গীত হলেও তার নাম অনুচ্চারিত রয়েছে। তার মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পর অধ্যাপক যতীন সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘জালালগীতিকা সমগ্র’। জালাল খাঁর গানের গভীরতা এবং বাণীর প্রাচুর্য যে কোনো বিদগ্ধ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম। জালাল খাঁর বিপুল জনপ্রিয় একটি গান স্মরণ করছি, যে গানে লালনের প্রভাব দেখতে পাই-
মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজ কোরান খোঁজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে \
খোদার নাহি ছায়া কায়া স্বরূপে ধরেছে মায়া
রূপে মিশে রূপের ছায়া, ফুল কলি ছয় প্রেমের গাছে \
আরব দেশে মক্কার ঘর, মদিনায় রছুলের কবর
বয়তুল্লায় শূন্যের পাথর, মানুষে সব করিয়াছে \
মানুষে করিছে কর্ম, কত পাপ কত ধর্ম
বুঝিতে সেই নিগূঢ় মর্ম, মন-মহাজন মধ্যে আছে \
… … … … …
মানুষের ছবি আঁক, পায়ের ধূলি গায়ে মাখ
শরিয়ত সঙ্গে রাখ, তত্ত্ব-বিষয় গোপন আছে \
জালালে কয় মনরে পাজি, করলে কত বে-লেহাজি
মানুষ তোমার নায়ের মাঝি, একদিন গিয়া হবে পাছে \
একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বাউল জালাল খাঁ বিষয়ক এ রচনার সমাপ্তি টানব; “রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বছরের গল্প শুনছিলাম; কোন নিতান্ত অজ পাড়াগেঁয়ে শতবার্ষিকীর উদ্যোক্তাদের বিপন্ন করে এক কৌতূহলী মানুষ নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বাপু এই যে কবি কবি বলছ, এই কবি রবি ঠাকুরটি কে? কই আমাদের গাঁয়ের দিকে তো কোনদিন গান গাইতে আসেনি।’ অবাক হওয়ার কিছু নেই এই গল্পে, কারণ এমনকি আজকের দিনেও গ্রামের মানুষের এক বিশাল অংশের কাছে কবি মানেই কবিয়াল। মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির নায়ক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবিয়াল রমেশ শীল, গোমনি দেওয়ানদের পার্থক্য খুবই মৌলিক, একেবারে শ্রেণি অবস্থানের। গ্রামীণ সংস্কৃতির কবি তাই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত কবিয়ালরাই। বলাই বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ নন।”- পুলক চন্দ [গণকবিয়াল রমেশ শীল ও তাঁর গান’ কলিকাতা, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা-এক] বাংলার বাউল বা লোককবিদের আধুনিক সময়ের তাত্ত্বিকগণ যতই অবহেলা করুন, বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে তারাই কিন্তু প্রাণের মানুষ। নাগরিক বুদ্ধিজীবীগণ যতক্ষণ না বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়াবেগের সন্ধান করতে ব্যর্থ হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলার লোকবাউল তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারবে না! তাদের গানও নয়।

ফরিদ আহমদ দুলাল
কবি ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়