রাষ্ট্রপতির ভাষণের আলোচনায় এমপিরা : শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফের ক্ষমতায় আসার প্রত্যয়

আগের সংবাদ

বরিশালে ড্রেজিং করা বালু ফের নদীতে, খোয়া যাচ্ছে টাকা!

পরের সংবাদ

অবশেষে অবসরে গেলেন বিচারপতি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ছুটিতে বছর পার করেই অবসরে গেলেন। প্রায় এক বছর তিনি কোর্টে আসেননি, বিচারকার্জ পরিচালনা করেননি। কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসরে গেলেন। নীরবেই তিনি অবসরে গেলেন। সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারক অবসরে গেলে তাকে সপ্রিম কোর্ট বার ও অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। কিন্তু বিচারপতি ইমান আলীর ক্ষেত্রে এর কিছুই হয়নি। বিচারক হিসেবে তিনি যে সংবর্ধনায় অভিসিক্ত হয়েছিলেন, সে অনুযায়ী তার বিদায় হয়েছে নীরবে। কিন্তু কেন? বিচারপতি ইমান আলী কী কারণে বছরখানেক ছুটি কাটালেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার দপ্তরে যোগাযোগ করলে তারা সুস্পষ্ট কারণ জানাতে পারেননি। রেজিস্টার দপ্তর থেকে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায়নি। তবে ভিন্ন একটি সূত্র জানিয়েছে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিচারপতি ইমান আলী ছুটিতে ছিলেন। তবে এই ব্যক্তিগত কারণ কী, তা জানা না গেলেও বিচারাঙ্গনে কানাঘুষা ছিল অভিমান করে বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ছুটিতে চলে যান। কী এই অভিমান? কেন এই অভিমান? বিভিন্ন সূত্রে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল বিগত ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে। এই নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতায় প্রথম ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। কিন্তু প্রধান বিচারপতি হিসেবে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী নিয়োগ লাভের পরদিন থেকেই বিচারপতি ইমান আলী ছুটিতে চলে যান। এরপর থেকে তিনি আর কাজে যোগদান করেননি। তিনি আর এজলাসেও বসেননি। কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়েছেন।
প্রশ্ন হলো একজন বিচারপতি কি অভিমান করতে পারেন? সংবিধান তাকে কি এই সুযোগ দিয়েছে?
সংবিধানে কোথাও কি বলা আছে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে?
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ কিন্তু কাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হবে তা কোথাও বলা হয়নি। বরং কারা বিচারক হতে পারবেন না তা বলা হয়েছে সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে।
বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী তিনি শপথ গ্রহণ করেন। এই শপথে বলা আছে “আমি, প্রধান বিচারপতি (বা ক্ষেত্রমত সুপ্রিম কোর্টের আপিল/হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক) নিযুক্ত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।”
এই শপথবাক্য অনুযায়ী দেখা যায় একজন বিচারপতি ভীতি, অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হতে পারেন না। বিচারপতি ইমান আলী ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানেও তিনি পুনর্বার শপথ নেন এবং শপথ বাক্য পাঠ করেন।
শপথে বলা আছে তিনি অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে ওঠে বিচারকাজ পরিচালনা করবেন। তা হলে তিনি যদি অভিমান করে বসে থাকেন সেটা তার শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন হবে কিনা এ প্রশ্ন ওঠে। হাজার হাজার মামলার ভারে ন্যুব্জ অবস্থা বিচার বিভাগের। দরিদ্র রাষ্ট্রের পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের পেছনে রাষ্ট্রের প্রতি মাসে ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। বিচারকদের যে বেতন-ভাতা, গাড়ি, বাড়ি, অন্যান্য স্টাফসহ আনুষঙ্গিক নানা খরচ রয়েছে।
একজন বিচারকের পেছনে এত টাকা খরচের পরও রাষ্ট্র্রের প্রতি জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না?
আইন ও বিচারাঙ্গনের লোকজন বলছেন এটা রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি একজন বিচারকের চরম হতাশাজনক আচরণ। তিনি অভিমান করে ছুটিতে না গিয়ে পদত্যাগ করতে পারতেন। বেতন-ভাতা না নিতে পারতেন। শূন্যপদে রাষ্ট্র আরেকজনকে নিয়োগ দিতে পারত। কিন্তু তা না করে অভিমানে ছুটিতে গিয়ে হাজার হাজার মামলা ঝুলে থাকার মতো নিজেকেও ঝুলিয়ে রাখলেন। এটা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা অতিক্রম করার এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে সুপ্রিম কোর্টে। গত তিন দশকে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে সুপারসিডের অনেক উদাহরণ রয়েছে। ২০১১ সালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলে, আপিল বিভাগের দুই বিচারপতি ছুটিতে যান। তারা হলেন- বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। ছুটি শেষে তারা আবার কাজে যোগদান করেন। সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ দেয়া হলে, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া পদত্যাগ করেন।
কিন্তু এটা হবে কেন? প্রধান বিচারপতির পদটি পদোন্নতির পদ নয়। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। তিনি আপিল বিভাগ থেকে না হাইকোর্ট বিভাগ থেকে নিয়োগ পাবেন তা বলা হয়নি। বিচারাঙ্গনের বাইরে থেকেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কনভেনশন বা প্রথা হয়ে গেছে আপিল বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার। প্রধান বিচারপতির পদটি শুধু বিচারিকই নয়, এটা প্রশাসনিকও। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদ। প্রধান বিচারপতিকে বিচারিক কাজের পাশাপাশি প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করতে হয়। ফলে সরকারের অধীন না হলেও সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিই প্রধান বিচারপতি হবেন- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ যদি প্রত্যাশা করে থাকেন তাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হবে, কিন্তু সরকার তাকে নিয়োগ না দিলে তিনি অভিমান করে মাসের পর মাস ছুটি নিয়ে বসে থাকতে পারেন না। যদি বিচারক হিসেবে থাকতে না চান তা হলে পদত্যাগ করতে পারেন। সংবিধানেই এই পথ দেয়া আছে। সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে পত্র দিয়ে যে কোনো বিচারপতি পদত্যাগ করতে পারেন। যেমনটা অতীতে অনেকে করেছেন। বিচারপতি ইমান আলীও তা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে অযথাই পদ আঁকড়ে রাখেন। দেশে ৪০ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে নিম্ন আদালতে আছে ৩৫ লাখ মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখের বেশি আর আপিল বিভাগে ২২ হাজারের মতো মামলা। এ হিসাবও বছরখানেক আগের। বিচারকের অভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। অথচ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক হয়ে বিচারপতি ইমান আলী এটা অনুভব করতে পারেননি, যা খুবই দুঃখজনক।
সংবিধানে উল্লেখ আছে, বিচারপতির পদের মেয়াদ ৬৭ বছর পর্যন্ত। এ অনুযায়ী বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী অবসরে যান ৩১ ডিসেম্বর। সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারক হয়ে পুরো এক বছর ছুটি কাটিয়ে তিনি এক নজির রেখে গেলেন। এমন নজিরবিহীন ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের বিচারাঙ্গনে সম্ভব কিনা আমার জানা নেই।

শংকর মৈত্র : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়