ঢাকা-ওয়াশিংটন : রোহিঙ্গা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা

আগের সংবাদ

একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি : শিক্ষার্থী পায়নি ২০০ প্রতিষ্ঠান

পরের সংবাদ

যাত্রাবিরতি ঢাকা-বেইজিং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আভাস! মধ্যরাতে মোমেন-গ্যাং আধাঘণ্টার বৈঠক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিদের সিরিজ ঢাকা সফরের মধ্যেই সোমবার মধ্যরাতে ঢাকায় ৫২ মিনিটের জন্য যাত্রাবিরতি দিয়ে আফ্রিকা গেলেন চীনের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং। ওই যাত্রাবিরতির সময় বাংলাদেশ ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। আফ্রিকা সফরে যাওয়ার সময় বিমানের জ্বালানি নেয়ার কারণে তাকে এই যাত্রাবিরতি করতে হয়েছে বলে ঢাকার পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে। যদিও আফ্রিকা যেতে হলে বাংলাদেশ হয়ে না গেলেও চলে। অর্থাৎ এটি আসলে আফ্রিকা যাওয়ার রুট নয়। এরপর থেকেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকায় যাত্রাবিরতি নিয়ে নানা জল্পনা ছড়িয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই যাত্রাবিরতি ঢাকার সঙ্গে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি যতই সংক্ষিপ্ত বা যাত্রাবিরতি হলেও এটার বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। এজন্য মধ্যরাতে বিমানবন্দরে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। তাদের মতে, বন্ধুত্বের

বিশেষ বার্তা বিনিময়ে চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে বেইজিং ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে বসা কিন গ্যাংয়ের সফর প্রসঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সোমবার দুপুরে বেইজিংয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানান, ইথিওপিয়া, গ্যাবন, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন এবং মিসর-আফ্রিকার এই পাঁচ দেশ সফরে বেরিয়েছেন কিন গ্যাং। আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দেশ সফর হবে তার।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরকম গুরুত্বপূর্ণ সফরের মধ্যে ঢাকায় যাত্রাবিরতি আসলে চীনের কাছে বাংলাদেশেরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাকেই বোঝায়। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, এই যাত্রাবিরতি আলাদা করে বার্তা দেয় বিষয়টি সেরকম না হলেও একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, অন্য পথ দিয়ে না গিয়ে তিনি কেন বাংলাদেশ হয়েই আফ্রিকা যাচ্ছেন। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আছে যেগুলো তারা গুরুত্ব সহকারে দেখে এটা তারই একটা প্রকাশ। বাংলাদেশকে চীন গুরুত্ব দেয় বলেই একদিনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে তারা। এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন সাবেক এই কূটনীতিক। এই যাত্রাবিরতি নিয়ে অন্য কোনো পরিস্থিতি বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জড়িয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে যেমন বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জায়গা, সেরকমই চীনের কাছে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বটা অনেক বেশি। যেটা বাংলাদেশে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। চীনের বাংলাদেশের প্রতি যে গুরুত্ব আছে তা বারবার বিভিন্নভাবেই বোঝাচ্ছে দেশটি। বিভিন্ন সফর এবং সম্পর্কগুলার মাধ্যমে এটা বোঝা যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যেসব জায়গায় দরকার সেগুলোতে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করছে। তার ভাষায়, চীন বাংলাদেশের ‘নিড’ বা প্রয়োজনগুলোর দিকে খেয়াল রাখছে। সেজন্য তিনি মনে করেন, এই যাত্রাবিরতির একটা কৌশলগত গুরুত্ব আছে এবং এই বার্তাটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং বাকি বিশ্বকেও ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে।
আফ্রিকা যাওয়ার পথে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাত ২টার দিকে বিমানবন্দরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন গ্যাংকে স্বাগত জানান। গতকাল মঙ্গলবার সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে চলছে ও এর উন্নয়ন অভাবনীয় এবং চীন এর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চায়। চীনের মন্ত্রী জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যোগান ব্যাহত হচ্ছে, আর্থিক লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে এবং নতুন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে ঢাকা সফরে এসেছিলেন। গত ৩০ ডিসেম্বর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ লাভের পর এটিই তার প্রথম বিদেশ সফর। এবারের সফরে তিনি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে যাবেন। দায়িত্ব নেয়ার ১০ দিনের মধ্যে তিনি ঢাকা সফর করলেন, এটি আমাদের জন্য ভালো খবর উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এটি আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের বড় ইস্যু হচ্ছে রোহিঙ্গা এবং এ বিষয়ে চীনারা আমাদের সহায়তা করেছে। সেই সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি অঙ্গীকার করেছেন। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, মিয়ানমারে কিছু অসুবিধা আছে। সেজন্য এটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলেও জানান তিনি। আমরা বলেছি, যদি তাড়াতাড়ি সমাধান না হয় তাহলে তারা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকতে পারে। তারা রাষ্ট্রহীন মানুষ, তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। সেজন্য তারা উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে যেতে পারে। তাতে এই পুরো অঞ্চলের শান্তি বিঘিœত হবে। সেজন্য আপনারা বিশেষ উদ্যোগ নেন। যেন এই সমস্যাটার তাড়াতাড়ি সমাধান হয়। অন্তত প্রক্রিয়া যেন শুরু হয়। তিনি তাতে হ্যাঁ বলেছেন। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রায় ১৪০০ কোটি ডলার। কিন্তু এরমধ্যে চীনের রপ্তানি ১৩০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল চীন। কিন্তু এটির এখনও গেজেট না হওয়ার কারণে আমাদের ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা পাচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আলোচনার পরে চীনের মন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি তিনি করবেন। বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পে চীন যে কাজ করছে সেটি যেন আরো ত্বরান্বিত হয়, সেটির জন্য আলোচনা করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, আমাদের আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। সুখের বিষয় যে, চীন আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কে সম্পৃক্ত থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। একইসঙ্গে এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারসাম্যের কূটনীতির কারণে অনেকে এখন আমাদের দিকে নজর দিচ্ছেন। বিশ্বের ৩৫তম দেশে পরিণত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক সুযোগ বাংলাদেশে আছে। কেউ এগুলো হাতছাড়া করতে চান না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা আমাদের জন্য সুখবর যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ এখন ঢাকায় আছেন। তবে এটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তাদের সমস্যা থাকতে পারে, সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবো। কী কারণে তাদের সমস্যা সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা না। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়-আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ-চীন জোট নতুন কিছু নয়। যে পথটি বাংলাদেশকে চীনের সাথে সংযুক্ত করেছে তাকে সিল্ক রোড বলা হয়, যা ইতিহাসে সিল্ক রোড নামে বিখ্যাত। যেহেতু চীন এবং বাংলাদেশ উভয়ই উপকূলীয় দেশ, তাই প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রপথে তাদের মধ্যে আদান-প্রদান চমৎকার ছিল। চীন ও বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তারপর থেকে, চীন কয়লা ভিত্তিক অনেকগুলো বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং বাস্তবায়ন করেছে। সোমবার মধ্যরাতের বৈঠকে বাংলাদেশ চীনকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা একটি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি বজায় রাখে এবং বেইজিংকে ঢাকার সমর্থনের আশ্বাস দিয়ে সকল দেশের সঙ্গে একযোগে চলাফেরা করে। আমরা এক-চীন নীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি বজায় রাখি। এটি আমাদের নীতি। আমরা সময়ে সময়ে (চীনের প্রতি) আমাদের সমর্থন প্রসারিত করব।
২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের পর তৎকালীন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় বিরতি নেন। এ সময় তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করেন। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের মতে, চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং অক্টোবর ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হয়। চীনের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিলিয়ন ডলার মূল্যের ২৭টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, যা তাদের সম্পর্ককে উন্নত করেছে। এরআগে ২০১৫ সালে, চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা বেইজিংয়ের সহযোগিতাকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ দুই পক্ষ বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং অবকাঠামো প্রকল্পে সহযোগিতা স¤প্রসারণে সম্মত হয়েছে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরো জোরদার করেছে।
এদিকে, কোভিড-১৯ এর ছোবলের পর চীন সবকিছু পুনরায় চালু হওয়ায় উদ্যোক্তা এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এতে বাংলাদেশের জন্য আরো রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সহায়তা করবে। বিশ্ববাজারে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদাও তৈরি হবে। এছাড়াও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়াসে চীন বাংলাদেশে তার বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়