‘রেজা বাহিনী’ থেকে রেহাই চান হোটেল ব্যবসায়ী

আগের সংবাদ

২৭ দফাই হবে ভোটের ইশতেহার : বিএনপির ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ ঘষামাজার কাজ চলছে > নেয়া হবে সব স্তরের মানুষের মত

পরের সংবাদ

ফাঁসির রায় জেনেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে ছিলেন প্রায় ৫৫ বছর। এর মধ্যে ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে ভাষার লড়াইসহ বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিবাদ-সংগ্রাম করতে গিয়ে ১৩ বছরই কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি প্রথমবার গ্রেপ্তার হন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিল করতে গিয়ে। সর্বশেষ গ্রেপ্তার হন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সামরিক আইনে এক প্রহসনের বিচারে তাঁকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছিল। বাঙালি জাতির দৃঢ় প্রত্যয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপ, নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। তার আগে বঙ্গবন্ধুকে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার টোপ দেয়া হলেও বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি তিনি।
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বাঙালিদের প্রাণের দাবি ছয় দফা তথা স্বাধিকার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া খান-ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা ভেঙে যায়। ইতোমধ্যে সামরিক সরকার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা-চট্টগ্রামসহ প্রধান শহরগুলোতে গোপনে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে। সন্ধ্যা থেকে খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীদের আত্মগোপনে গিয়ে শত্রæর মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে ধরা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি আত্মগোপনে গেলে তাঁকে না পেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে ব্যাপক নিরীহ মানুষকে হত্যা করবে। এদিকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুলিশ, বিডিআরসহ নিরস্ত্র জনতার ওপর গণহত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসসহ একাধিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর রাত প্রায় দেড়টার দিকে সেনাবাহিনী তাঁর বাসভবন আক্রমণ করে তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার খবরটি মানুষ প্রথমদিকে জানতে পারেনি। ইয়াহিয়া-ভুট্টো ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান চলে যান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচি গিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে শাস্তি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও জানার কৌতূহল জাগে বঙ্গবন্ধু কোথায়, কী অবস্থায় আছে জানার জন্য। ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর যে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়, তার সঙ্গে বলা হচ্ছিল তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেই আছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে অনেকের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসে। অনেক বিদেশি সাংবাদিকও ধারণা করছিলেন সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন করেছেন। এভাবে নানা রকম গুজব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে এক সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা অবস্থার একটি ছবি করাচির পত্রিকায় ছাপা হলে বিশ্বব্যাপী জানাজানি হয় বাঙালির নেতাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর থেকে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়, চলতে থাকে প্রতিবাদ, উঠতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি। ইয়াহিয়া খান বারবার বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির হুঙ্কার দিচ্ছিলেন। প্রথম দিকে সাংবিধানিক আদালতে তাঁর বিচার হবে বলে প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করলেও পরে তা ভঙ্গ করে বিচার শুরু করেন সামরিক আদালতে। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে ২২ মে করাচিতে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব মহাঅপরাধ করেছেন। সাংবিধানিক আদালতে তার বিচার হবে। তবে বিচার হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।’ এ সময় ফারল্যান্ড ইয়াহিয়াকে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিবের প্রতি ব্যাপক মাত্রায় আন্তর্জাতিক সমর্থন রয়েছে। কাজেই তাঁকে দণ্ড দেয়ার মতো বিষয়ে পাকিস্তানের উচিত হবে বিশ্ব জনমতকে গুরুত্ব দেয়া।’ ১১ আগস্ট লায়ালপুর কারাগার-সংলগ্ন একটি বাড়িতে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার শুরু হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রহসনের বিচার প্রত্যাখ্যান করেন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা আইনজীবীর সহযোগিতা নিতে অস্বীকার করেন।
১৩ অক্টোবর ১৯৭১, নিউইয়র্কের হেরাল্ড ট্রিবিউন জানায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে ট্রাইব্যুনালের সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। গোপন এ বিচারের রায় পাকিস্তানের সব কূটনৈতিক মিশনকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক ট্রাইব্যুনালের ওই রায় কার্যকর না করার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রায় কার্যকর না করে তাঁর মুক্তির ব্যাপারে চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ জানান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জোর দাবি ওঠে। তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ দেন বহু রাষ্ট্রনেতা।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তরে হামলা চালালে ভারতও এ যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানে শামিল হয়। ওই দিনই বঙ্গবন্ধুকে ফয়সালাবাদ কারাগার থেকে মিয়ানওয়ালি কারাগারে সরিয়ে নেয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার পর যৌথ বাহিনীর অভিযান তীব্র হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযোদ্ধা-জনতার একটাই দাবি উঠল- বঙ্গবন্ধুকে যে কোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে দাবি ওঠে। তারপরও ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে মিয়ানওয়ালি কারাগারে গুজব ছড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু গোপন স্থানেই ছিলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে রায় কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো তাতে সায় দেননি। বরং ভুট্টো তখনো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন চাল চালতে চেয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক গ্যাভিং ইয়াংকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিনি (ভুট্টো) বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রথম সুযোগেই তাকে প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে বলেন। কিন্তু তার (ভুট্টোর) সে প্রয়াস সফল হয়নি। পাকিস্তানের ভেতর থেকেও ততদিনে মুজিবের মুক্তির দাবি উঠেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছিল, বাংলাদেশে আটক (পরে ভারতে স্থানান্তরিত) ১ লাখ ৩ হাজার পাকিস্তানিকে ফেরত আনতে হলে মুজিবকে ছেড়ে দিতে হবে।’ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভুট্টো ইসলামাবাদ গিয়ে একটি ভাড়া করা পাকিস্তানি বিমানে করে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পাঠিয়ে দেন। রাত ৩টায় বিমানটি ইসলামাবাদ ছেড়ে যাওয়ার ১০ ঘণ্টা পর সাংবাদিকেরা এ খবর জেনেছিলেন। ততক্ষণে বাঙালির নেতা লন্ডন পৌঁছে যান। লন্ডনের ক্ল্যারিজ হোটেলের বলরুমে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন বঙ্গবন্ধু। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকা অবস্থায় দেশের মানুষের জন্য তাঁর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, জেলে কী অবস্থায় ছিলেন, তাঁর প্রতি কারা কর্মকর্তাদের ব্যবহার ইত্যাদির চিত্র ফুটে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ বা স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করলে মুক্তির আগে ভুট্টোর প্রস্তাব অনুযায়ী তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। প্রহসনের বিচারে তাঁর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পরও তিনি এমন কোনো বার্তা দেননি যে, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে রাজি। তিনি ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যেভাবে শত্রæর মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা থেকেও সরে আসেননি বা বাতিল করেননি। বরং তিনি তাঁর ফাঁসির রায় এবং তাঁর জন্য কবর খোঁড়ার দৃশ্য দেখেও তা উপেক্ষা করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে হত্যা করো আমার তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু আমার লাশটা আমার বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘আত্মগোপন না করে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের একটি। তিনি সংবিধান ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিশ্ব জনমত তাঁর পাশে থাকে।’ অবশেষে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে তাঁর ভালোবাসার মানুষদের কাছে জাতির পিতা হয়ে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিনটি ছিল ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল।

মুহাম্মদ শামসুল হক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়