সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল : শান্তিপূর্ণ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৫ শতাংশ

আগের সংবাদ

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী : নির্বাচনের আগে দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে > উদ্ভট ধারণা প্রশ্রয় দেবেন না

পরের সংবাদ

টোটাল ফিটনেস : ইতিহাসে সুস্থতার পূর্ণতা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘ফিটনেস’ শব্দটি শুনলেই অনেকের কাছেই শারীরিক ফিটনেসের কথা মনে হয়। বর্তমানে পৃথিবীতেই জিম এবং বিচিত্র নামের ডায়েটের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সচেতন মানুষে বলছেন, ফিটনেস মানে শুধু শারীরিক ফিট থাকা নয়, কোনো মানুষ যদি একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ফিট থাকতে পারেন, তবেই তিনি টোটাল ফিটনেসের অধিকারী হবেন। প্রশ্ন আসতে পারে- এই চারটি বিষয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
একটি গাড়িতে চারটি চাকা থাকে। সব চাকার ব্যালান্স বা ভারসাম্য ঠিক থাকলেই কেবল গাড়ি ভালো করে চলতে পারবে। কোনো একটি চাকা যদি বসে যায়, তবে পুরো গাড়ির চলাই বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের দেহগাড়ির শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিক- এই চারটি চাকাকেও একইভাবে সচল রাখতে হয়। এর একটি যদি বিকল হয়ে যায়, তখন তা মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলে।
আড়াই হাজার বছর আগে চাইনিজ দার্শনিক ও সমরবিদ সান জু তার ‘আর্ট অব ওয়ার’ বইয়ে লিখে গেছেন, ‘সফল যোদ্ধা আগে মানসিকভাবে জয়ী হয়, তারপর যুদ্ধের ময়দানে যায়। আর পরাজিত যোদ্ধা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে জয়ী হওয়ার আশা করে।’ এই কথাটি শুধু যুদ্ধ নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য। মানসিক শক্তি যে অনেক সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে, তার বহু প্রমাণ আমাদের মাঝে আছে। মনের এই শক্তিই মানুষকে নতুন কিছু করার পথ দেখায়।
সান জু যে সময়ে চায়নায় যুদ্ধ করছেন, তার কিছু পরেই ভারতে আক্রমণ করেন গ্রিক বীর আলেকজান্ডার। অদম্য আলেকজান্ডার বিশ্ব জয়ের যে আকাক্সক্ষা নিয়ে বেরিয়েছিলেন, তাতে প্রথম ধাক্কা খান এখানে এসে। আলেকজান্ডারের বাহিনীকে রুখে দেয় মৌর্য শাসক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বাহিনী। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রথমবারের মতো একক সা¤্রাজ্যের চেহারা পায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাফল্যের পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন তক্ষশিলার শিক্ষক, পণ্ডিত কৌটিল্য, যিনি চানক্য নামে বেশি পরিচিত ছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কোনো রাজকীয় পরিবারের সদস্য ছিলেন না। কিন্তু চানক্য তাকে আক্ষরিক অর্থেই শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে গড়ে তোলেন। তার মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি করান আলেকজান্ডারকে পরাজিত করার এবং ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে সা¤্রাজ্য বিস্তারের। চানক্য সামরিক বাহিনীর স্বাস্থ্য রক্ষায় এমন কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা এখনো বিস্ময়ের জন্ম দেয়। বর্তমান সময়ের পুষ্টিবিজ্ঞানীরা সজনে পাতাকে সুপার ফুড হিসেবে বর্ণনা করছেন। একে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ও বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মৌর্য সেনাদের শারীরিক ফিটনেসের জন্য প্রতিদিন মোরিঙ্গা টি বা সজনে চা খাওয়ানো হতো। এর বাইরেও যুদ্ধের ময়দানে সজনে পাতা খেতে দেয়া হতো। এতে তারা বলবান হয়ে উঠতেন। যুদ্ধে আলেকজান্ডারের বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আলেকজান্ডারের আর বাংলার মূল ভূখণ্ডে ঢোকার সাধ পূরণ হয়নি। তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আলেকজান্ডারের বীরত্ব থমকে যায় সজনে পাতার কাছে! অর্থাৎ এই অঞ্চলের মানুষ তাদের ফিটনেসের বিষয়ে সব সময়ই সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
শরীরের সঙ্গে আত্মার সংযোগ ঘটিয়ে কাজ করা প্রাচীন বাংলায় শুধু নয়, পরবর্তী সময়েও বজায় থেকেছে। স্বামী বিবেকানন্দ বাঙালি তরুণদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রতচারী আন্দোলন টোটাল ফিটনেস চর্চার উদাহরণ হতে পারে। ১৯৩২ সালে তরুণদের মাঝে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ তৈরি করতে গুরু সদয় দত্ত এই আধ্যাত্মিক ও সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেন। যার মধ্যে মানসিক ও শারীরিক ফিটনেস ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ আন্দোলনের সদস্যগণ ব্রত নিতেন এভাবে,
‘ব্রত লয়ে সাধব মোরা বাংলাদেশের কাজ
তরুণতার সজীব ধারা আনবো জীবন-মাঝ
চাই আমাদের শক্ত দেহ, মুক্ত উদার মন।
রীতিমতো পালবো মোরা মোদের প্রতিপণ।’

বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ব্রতচারীর আদর্শটা আমি ধরে রেখেছি।…আমি একটা গরু আঁকলে লোকে বুঝতে পারে এটা কামরুল হাসানের আঁকা গরু। একটা মাছ আঁকলে লোকে বুঝতে পারে, এটা কামরুল হাসানের আঁকা মাছ। এর পেছনে কিন্তু ব্রতচারীর আদর্শটাই কাজ করে যাচ্ছে।’
আধ্যাত্মিকতার সংযোগ বাঙালিকে কতটা সবল করে তোলে, সে বিষয়ে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা সম্প্রতি বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ১০ অক্টোবর ২০২২ তারিখের এক প্রতিবেদনে মন্ত্র জপ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, ‘নতুন প্রজন্ম জপের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত না হলেও, এই প্রজন্মের মানুষের ঠাকুমা-দিদিমারা এক সময়ে নিয়মিত জপ করতেন। জপ যে শুধু ধর্মীয় আচার, তা মনে করেন না অনেকেই। অনেকেরই মতে, এর সঙ্গে যোগ আছে শরীরেরও। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে রীতিমতো যোগ রয়েছে এই জপের।… মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রকৃতি পোদ্দার জানিয়েছেন, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে, নেগেটিভ চিন্তা দূরে রাখতে মন্ত্র জপের তুলনা হয় না। একই সঙ্গে এই অভ্যাস বা প্রক্রিয়া ভিতর থেকে মানুষকে শান্ত করে।’
এই অঞ্চলের সাধক, সুফি, পীর, অলি, বুজুর্গগণ নিয়মিত স্বাস্থ্য সচেতনতার মধ্য দিয়ে নিজেদের ফিট রেখেছেন। সে সময় জিম ছিল না। তারা প্রকৃতির সাহায্য নিয়েই নিজেদের সুস্থ রাখতেন। যোগ-ধ্যানের ঐতিহ্য এই অঞ্চলে অন্তত পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। শুধু যোগ-ধ্যানের চর্চার মাধ্যমে হাজারো সাধক নিরোগ ও সুস্থ থেকেছেন। এখন বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করছেন, আমাদের দেহের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগ মনোদৈহিক। যা যোগ-মেডিটেশন দিয়েই দূর করা সম্ভব!
একজন মানুষের প্রকৃত সামাজিক যোগাযোগ কতটা জরুরি, সেটা বোঝা গেছে করোনাকালে। ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এখনো স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতকেই নিজের ভুবন মনে করে। অনেকেই বুঝতে পারে না, বাস্তবে বন্ধুর হাতে হাত রাখা ফেসবুকের পাঁচশ লাইকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রয়োজন বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ।
৬ জানুয়ারি দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে টোটাল ফিটনেস ডে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম শুক্রবার দিনটি পালিত হবে। দিবসটি আয়োজন করছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। দিনটি পালনের মধ্য দিয়ে সবাইকে শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে জীবনের পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়ার বাণী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে ছিলেন টোটাল ফিটনেসের প্রকৃত উদাহরণ। ছেলেবেলায় কবি শরীর খারাপ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হয়নি! তার শারীরিক ফিটনেস দীর্ঘ জীবন ধরে রাখতে এবং অক্লান্ত কাজ করতে সাহায্য করেছে। তার আধ্যাত্মিকতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে নোবেলজয়ী সাহিত্য কর্ম ‘গীতাঞ্জলি’সহ বিভিন্ন রচনায়। সামাজিকভাবে যে কোনো আয়োজনের মধ্যমণি থাকতেন কবি। পাশাপাশি নিজের জীবনের সব কষ্ট ও বেদনাকে তিনি তার অপরিসীম মানসিক শক্তি দিয়ে অতিক্রম করে গেছেন। ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ বইয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ তারিখে কবি লিখেছেন, ‘স্বাস্থ্য যেমন প্রাণের পূর্ণতা, সৌন্দর্য যেমন রূপের পূর্ণতা, সত্য যেমন জ্ঞানের পূর্ণতা, ভালোবাসা তেমনি অনুভূতির পূর্ণতা। ইংরেজিতে গুড ফিলিং বলে এ তা নয়, একে বলা যেতে পারে পারফেক্ট ফিলিং।
শুভ-ইচ্ছার পূর্ণতা হচ্ছে নৈতিক, তার ক্রিয়া ব্যবহারের উপর; ভালোবাসার পূর্ণতা আত্মিক, সে হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিস্বরূপে (ঢ়বৎংড়হধষরঃু-র) পরম প্রকাশ; শুভ-ইচ্ছা অন্ধকারে যষ্টি, প্রেম অন্ধকারে চাঁদ। মায়ের স্নেহ মায়ের শুভ-ইচ্ছা মাত্র নয়, তা তার পূর্ণতার ঐশ্বর্য। তা অন্যের মতো নয়, তা অমৃতের মতো। এই অনুভূতির পূর্ণতা একটি শক্তি। ভালোবাসার বিষয়ের মধ্যে অসীমকে বোধ করবার শক্তি; ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে অপরিমেয়কে দেখতে পাওয়া এবং স্বীকার করাই অপরিমেয়কে সীমার মন্দিরে জাগিয়ে তোলবার শক্তি।’

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান : সাংবাদিক ও গবেষক; অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি, ইউকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়