দুদকের মামলা : ব্যাংক কর্মকর্তার ১৬ ও স্ত্রীর চার বছর কারাদণ্ড

আগের সংবাদ

রাজধানীর সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গন : উৎসবমুখর বিজয় দিবস উদযাপন

পরের সংবাদ

স্বাধীনতার মূল্য

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

হারুন হাবীব : বাংলাদেশ রাষ্ট্র যখন স্বাধীনতার ৫১তম বার্ষিকী উদযাপন করছে, তখন ইতিহাসের ঘটনাবলির দিকে তাকানো খুবই জরুরি কাজ; সেই ইতিহাসের দিকে তাকানো, যে ইতিহাস আমাদের নতুন নাগরিকেরা দেখেননি, শুধুই শুনেছেন কিংবা বই পড়ে জেনেছেন। এই জানা নিজেকে জানা, ইতিহাসের সত্যকে জানা এবং সেই সত্যেরই মুখোমুখি হওয়া; যার মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের দুটি সুস্পষ্ট অধ্যায় আছে; প্রথমটি সার্বিক অর্থে রাজনৈতিক এবং দ্বিতীয়টি সামরিক। রাজনৈতিক ধারাটির প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলা, অধিকার সচেতন করা- যা তিনি সম্পন্ন করেছিলেন অভাবিত সাফল্যে। দ্বিতীয় ধারাটিরও নৈতিক বা আদর্শিক নেতৃত্ব দান করেন জাতির পিতা, যিনি গণহত্যারত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্রভাবে দেশের আপামর মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের মাঠে নামতে প্রলুব্ধ করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগের ডাক দেন।
বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার পথে অগ্রসরমান গৌরবোজ্জ্বল ১৯৭১ সালের সামরিক অধ্যায়টিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, যা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। সেই জনযুদ্ধ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, বয়স নির্বিশেষে জাতিকে একাত্ব করে এক অসামান্য জাতীয় রণক্ষেত্রে নামিয়েছে। সে যুদ্ধ ছিল জাতীয় জীবনের অপরিসীম গৌরবের, যেখানে বাঙালি যুবতারুণ্যের আত্মত্যাগী বীরত্বের কাছে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী পরাস্ত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।
কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল সেই ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে স্বকরুণ আরেক কষ্টের ইতিহাস- যার স্মৃতিচারণও আবশ্যিক বৈকি।
বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর বৃহৎ ও নৃশংস গণহত্যাগুলোর একটি। এমন কোনো গ্রাম নেই, এমন কোনো পরিবার নেই, যা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচরদের নির্বিচার নৃশংসতার শিকার হয়নি। এগুলো কোনো কল্পকাহিনী নয়, এগুলো সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অমোচনীয় ইতিহাস।
১৯৭১ সালের ৯ মাসে বাংলাদেশের শহর, গ্রাম, গঞ্জ, বন্দরে যে গণহত্যা ও নির্বিচার নারী ধর্ষণ ঘটেছে, তাকে এ যাবৎ নিজস্ব রাষ্ট্র কৌশলের আলোকে প্রভাবশালী বিশ্ব মোড়লেরা এড়িয়ে গেছে। এমনকি সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডেও ‘গণহত্যা’, তাকেও জাতিসংঘ পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ বাঙালি গণহত্যা ও নির্বিচার নারী ধর্ষণের প্রামাণিক দলিল শুধু বাংলাদেশে নয়, বহুবিধ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্ব গণমাধ্যমে আজো সংরক্ষিত আছে।
গণহত্যা কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়; কোনো জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বা কোনো ধর্ম, বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত যে হত্যাযজ্ঞ বা নির্বিচার আক্রমণ- সেটিই গণহত্যা। জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’ এই সংজ্ঞা স্বীকৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের গণহত্যাটি পরিচালিত হয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিন ধরে। এই সময়ে পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালিকে খুন করা হয়েছে, গণহারে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে; ঘরবাড়িতে আগুন দেয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে এসব বর্বরতায় সহযোগী হয়েছিল বাঙালি ও অবাঙালি মিলিয়ে গড়ে তোলা রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যরা। সেই বর্বরতার স্মৃতিচিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে, আছে পাঁচশর ওপর বধ্যভূমি, অসংখ্য গণকবর ও গণনির্যাতনকেন্দ্র।
সেদিনকার ¯œায়ুযুদ্ধের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাঙালি গণহত্যার বিষয়টি যতটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যক্রম তা হয়নি। কিন্তু ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং ব্যক্তি ও সংস্থার গবেষণায় এর ব্যাপকতা স্ববিস্তারে গ্রন্থিত আছে। জাতিসংঘ বাঙালি গণহত্যা বন্ধে সে সময় কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তারপরও সেদিনকার মহাসচিব ইউ থান্ট ৩ জুন ১৯৭১ সালে মন্তব্য প্রণিধান যোগ্য : The happenings in East Pakistan constitute one of the most tragic episodes in human history. Of course, it is for future historians to gather facts and make their own evaluations, but it has been a very terrible blot on a page of human history.
নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি দেশের নিয়মিত সরকারি বাহিনীর এই বর্বরতা ছিল মূলত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির বাস্তবায়ন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল পশুশক্তির ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ন্যায্য অধিকার দমন করা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার কেবল নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করার পথ বেছে নেয়নি, একই সঙ্গে তারা সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য, পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্রজনতাকে নিধন করার পরিকল্পনা করেছিল। ফলে এই অতর্কিত সামরিক অভিযানে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়; ফলে ভারতের মাটিতে ১ কোটি মানুষের মর্মন্তুদ শরণার্থী জীবনের সূচনা ঘটে।
২৫ মার্চের অভিযান শুরুর আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ দেশ থেকে প্রতিটি বিদেশি সাংবাদিককে জোর করে বের করে দেয়। স্থানীয় প্রচার মাধ্যমের ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে দুজন বিদেশি সাংবাদিক লুকিয়ে থাকেন, তাদেরই একজন সাইমন ড্রিং। ৩১ মার্চ তিনি লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এ তার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
প্রতিবেদনটি বাংলায় এ রকম- ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা মহানগরী মুহুর্মুহু তোপধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে। সর্বত্র বোমা-বারুদের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টিক্কা খান বর্বর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নির্মমভাবে গণবিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান কার্যালয় পিলখানা সেনা অভিযানে বিধ্বস্ত হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেনাবাহিনী নির্বিচারে ভারী আর. আর. গান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ব্যবহার করে। ইকবাল হলকে তারা প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সেখানে প্রথম ধাক্কাতেই ২০০ ছাত্র নিহত হয়। একদিকে হলগুলোর দিকে উপর্যুপরি শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে, অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। দুদিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলোর জানালা-দরজায় মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পথেঘাটে মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। জগন্নাথ হলেও বর্বরোচিত আক্রমণ চালানো হয়। কয়েকশ ছাত্র, যারা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিহত ও আহত হয়। সৈন্যরা মৃতদেহগুলো গর্ত খুঁড়ে গণকবর দেয়। এরপর ট্যাংক চালিয়ে মাটি সমান করে। রিপোর্টের একটি অংশ এ রকম- ‘আল্লাহ ও পাকিস্তানের ঐক্যের নামে’ ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত, সন্ত্রস্ত নগরী’।
এই নির্বিচার গণহত্যার ব্যাপকভিত্তিক প্রথম বর্ণনা দেন এন্থনি মাসকারানহাস লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় ১৩ জুন, ১৯৭১। মাসকারানহাস সে সময় কর্মরত ছিলেন করাচির একটি পত্রিকায়। কেবল দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক মহলের হিসাবেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ‘তিন মিলিয়ন’ বা ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যার জোরালো সমর্থন ও দলিল সারা বিশ্বেই সংরক্ষিত আছে। বহুবিধ গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনী ও ১৯৩৫ সালের নানজিং বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ। এই গণহত্যা সম্পর্কে অন্যতম প্রধান পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘ঢ়ধরহঃ ঃযব মৎববহ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ৎবফ’ অর্থাৎ বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দাও।
এই নির্বিচার গণহত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে মানবতাবাদী বিশ্ব সরব হয়ে ওঠে। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবি শংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। প্রায় সারা বিশ্বেই সরব হয়ে ওঠেন মানবতাবাদীরা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অ্যাঁদরে মালরো বাংলাদেশের পক্ষে ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’ গঠনের ঘোষণা দেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালাবার অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে; এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাজ্ঞকে ংবষবপঃরাব মবহড়পরফব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকায় দায়িত্বরত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাড, পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে জরুরি কূটনৈতিক বার্তা পাঠান। এসব বার্তায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক বর্বরতার বিস্তারিত বিবরণ আছে।
জাতিসংঘ এরই মধ্যে কয়েকটি বহুলালোচিত গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি দিয়েছে আর্মেনীয় গণহত্যা, যেখানে নিহত হয়েছে ১৫ লাখ; দিয়েছে রুয়ান্ডায় তুটসি গণহত্যা, যেখানে নিহত ৮ লাখ; দিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিদের হাতে ইহুদি গণহত্যা, যেখানে নিহত ৬০ লাখ। এমনকি বিশ্ব সংস্থা স্বীকৃতি দিয়েছে হাল আমলের বসনিয়ার ও কম্বোডিয়ার গণহত্যার। কিন্তু জাতিসংঘ বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ ১৯৭১ সালে মাত্র ৯ মাসে এবং যে দ্রুততায় বাংলাদেশের মাটিতে মানুষ হত্যা করা হয়েছে- তা বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য নজির। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কয়েকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে ৬০০০ মানুষ খুন করা হয়েছে মাত্র ২৬০ দিনে। কম্বোডিয়ার এই হার ছিল ১২০০। একমাত্র চুকনগরেই ২০ মে ১৯৭১ সালে একদিনে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শত শত শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে।
কিন্তু হালে পরিস্থিতির কিছুটা হেরফের হয়েছে বলে মনে করার কারণ ঘটেছে। গণহত্যা সম্পর্কিত প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট’ এই প্রথমবারের মতো বাঙালি গণহত্যার বিচারের দাবি তুলেছে, জাতিসংঘকে বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে জোরালো দাবি উপস্থাপন করেছে। এরপর এগিয়ে এসেছে ‘জেনোসাইড ওয়াচ’, যা বিশ্বের গণহত্যা অধ্যয়ন ও নিরোধের লক্ষ্যে একটি নন্দিত বিশ্ব প্রতিষ্ঠান। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ বা ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ’ এর সাম্প্রতিক একটি প্রস্তাবও বাঙালি গণহত্যার বিশ্ব স্বীকৃতি দাবির প্রতি আরেক দফা অগ্রগতি। প্রস্তাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে এবং গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আমেরিকার এই দুই আইনপ্রণেতা কংগ্রেসম্যান রো খান্না এবং কংগ্রেসম্যান স্টিভ চ্যাবট।
দৃশ্যতই দিন যত যাচ্ছে, ততই ইতিহাস অবমুক্ত হচ্ছে। ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি থাকে, যা দিয়ে সে নিজের সত্যকে রক্ষা করতে সক্ষম। অতএব জাতিসংঘের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষা করতে বিশ্ব সংস্থাকে কালবিলম্ব না করে বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
মনে রাখা উচিত, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধের স্বীকৃতি বা তার বিচার চাওয়ার মধ্যে কোনো প্রতিহিংসা নেই, কোনো প্রতিশোধ কামনা নেই; আছে কেবলই সুবিচার কামনা এবং এমন ভয়াবহ অপরাধ যেন আর কোথাও না ঘটে, আছে তার নিশ্চয়তা বিধানের প্রত্যয়। অন্যথায় এই ভয়ংকর অপরাধ বারবার ঘটবে, যেমনি অতিসম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর ঘটেছে।
আমরা যারা ১৯৭১ এর প্রত্যক্ষদর্শী, তারা জানি, কী সীমাহীন নৃশংসতা ও কী বর্বরতায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে; কী বর্বরতায় প্রায় চার লাখ নারীকে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে! কিন্তু মানব সভ্যতার দুর্ভাগ্য, সেই ঘাতক বাহিনীর নেতৃত্ব দানকারীরা নির্বিঘেœ তাদের দেশে ফিরে গেছে! পাকিস্তান যদিও স্বীকার করেছিল, তারা তাদের সেনাবাহিনীর অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করবে, কিন্তু সে প্রতিশ্রæতি তারা রাখেনি। এমনকি পাকিস্তান আজো পর্যন্ত ১৯৭১ এর নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেনি। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনীর হাতে এ রকম ভয়ংকর অপরাধের কারণে চীন ও কোরিয়ার মানুষের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে জাপান, ডাচ সরকার ক্ষমা চেয়েছে ইন্দোনেশিয়ার কাছে।
হারুন হাবীব: মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়