মোজাম্মেল-প্রণয় সাক্ষাৎ : কলকাতার থিয়েটার রোডের সেই বাড়িটি চেয়েছে বাংলাদেশ

আগের সংবাদ

কাদের সঙ্গে ডায়লগ করব? মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন

পরের সংবাদ

বস্তি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অস্বস্তি : ওসিদের কঠোর বার্তা, ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : রাজধানীর বস্তি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বস্তি দিন দিন বাড়ছে। হঠাৎ করে খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদকের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ-র‌্যাব ও ডিবির চোখ পড়েছে বস্তিতে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। চলছে অভিযানও। তবুও মিলছে না স্বস্তি। বরং বস্তি ঘিরে ‘নানা সুবিধার’ নামে চাঁদাবাজি চলছেই। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে লোকবল সরবরাহের অন্যতম উৎস্যস্থল বস্তি ঘিরে আছে অনেকে হিসাব-নিকাশও। সবমিলিয়ে বস্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরাধীদের নিরাপদ ঠিকানা। যা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাথাব্যথার বড় কারণ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজী বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে বস্তিবাসীদের কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতা বস্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে বস্তির ওই অপরাধ করা

লোকগুলোকে কাজে লাগিয়ে মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি ও খুনের মতো ঘটনা ঘটায়। বস্তির আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করা প্রভাবশালী লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অপরাধ কমবে না। পাশাপশি পুলিশেরও অনেকে বিভিন্নভাবে লাভবান হতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেন। পুলিশের যেসব সদস্য এসব কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাদেরও রোধ করতে হবে। সর্বশেষ বুয়েট ছাত্র পরশের মরদেহ উদ্ধারের পর চনপাড়া বস্তির যে চিত্র উঠে এসেছে সারাদেশের বস্তির চিত্র এমনই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আইজিপির নেতৃত্বে পুলিশ হেডকোায়ার্টার্সে সম্প্রতি একটি সভা হয়েছে। সেখানে পুলিশ মহাপরিদর্শক নির্দেশ দিয়েছেন কিশোর গাংয়ে কারা যুক্ত হচ্ছে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। থানা পুলিশ এদের তালিকা তৈরি করছে। এতে নি¤œ আয়ের মানুষের মধ্য থেকে কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। এর কারণ হচ্ছে বস্তিসহ যেসব জায়গায় নি¤œ আয়ের মানুষ বসবাস করে সেখানে সঠিকভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশে ঘাটতি থাকায় এবং সামাজিকীকরণের অভাব থাকায় অপরাধে তারা ঝুঁকে যায়।
তিনি বলেন, বস্তির কিশোররা অপরাধে বেশি যুক্ত এমন তথ্যে তৈরি হচ্ছে ডাটাবেজ। তাদের ব্যাপারে প্রতিটি থানার অফিসার ইনচার্জকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বস্তির যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হলেও কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারো একই ধরনের অপরাধে তারা যুক্ত হচ্ছে। এটা অনেকটা ‘টম এন্ড জেরি’ খেলার মতো।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন এবং জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষের একটি বড় অংশ উঠে ঢাকার বস্তিতে। আর বস্তি ঘিরে গড়ে উঠেছে অপরাধ, অপরাধী ও তাদের প্রশ্রয়দাতা। বস্তির বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব হারিয়েছেন। অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর আর ঘিঞ্জি বস্তিতে ঠাঁই হলেও অভাব তাদের পিছু ছাড়ে না। জীবিকার তাগিদে বাস-ট্রাক, রিকশা ও বেবিট্যাক্সি চালানো, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকের চাকরি, রাজমিস্ত্রি, গৃহকর্মী, ছোট মুদি দোকানসহ নি¤œ আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষ থাকেন বস্তিতে। তবে, এসব কাজ করে যে সামান্য আয় হয় তার সিংহভাগ চলে যায় তথাকথিত বস্তির মালিক ও সেখানে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী সিন্ডিকেটের পকেটে। ঘরভাড়াসহ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অবৈধ বিলের নামে একেকটি বস্তি থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ‘চক্র’। বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ খুনের পর রাজধানীর উপকণ্ঠ রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি নতুন করে আলোচনায় আসে। এরপর বস্তির অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ে নতুন করে ভাবছে পুলিশ-র‌্যাব ও ডিবি। বস্তির নিয়ন্ত্রকদের অনেকে অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ ঢাকার অভিজাত এলাকায় রয়েছে তাদের একাধিক বাড়িগাড়ি।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, রাজধানীর ভাসানটেক, মিরপুরের বাউনিয়াবাদ, মহাখালীর সাততলা, মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লা বস্তি, বনানীর কে-ব্লক ২২নম্বর রোডের বস্তি, গুলশান-বনানীর পাশের কড়াইল বস্তি, তেজগাঁও রেলওয়ে, মিরপুরের ঝিলপাড় এবং মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী বস্তি নানা কারণে আলোচিত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ছোট-বড় ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ বস্তি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অধিগ্রহণ করা জমিতে গড়ে উঠলেও ৬৫ শতাংশ পরিবারকে থাকতে হয় ভাড়া দিয়ে। মাত্র ৭ শতাংশ ভাড়া ছাড়া থাকেন। বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানা জমিতে থাকে ২৭ শতাংশ পরিবার। বস্তিবাসীর মধ্যে ৮৪ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন। বাকি ১৬ শতাংশ পরিবারের সামান্য কৃষি জমি আছে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও বস্তিতেই আশ্রয় নেন। 
অধিকাংশ বস্তিবাসী অশিক্ষিত হওয়ায় তারা খুবই অসচেতন। ছোট ছোট সমস্যা কেন্দ্র করে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তাদের বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা। বিচারের নামে বড় অঙ্কের জরিমানা আদায় করা হচ্ছে দরিদ্র বস্তিবাসীর কাছ থেকে। ঢাকার প্রায় তিন হাজারের বেশি বস্তির চিত্র প্রায় একই। খুপরি ঘরে গাদাগাদি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন অধিকাংশ বস্তিবাসী। সেখানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু এনজিও কাজ করলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সূত্রমতে, ছিচকে চোর, ছিনতাই ও মাদক কারবারিদের নিরাপদ ঠিকানা বস্তি। পুরুষদের পাশাপাশি নারী মাদক কারবারিদের একাংশ বস্তির বাসিন্দা। নিরাপদ বিবেচনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের অনেকের আশ্রয়স্থলও বস্তি। ভাড়াটে খুনিরা খুন করে বস্তিতে আত্মগোপন করে। শুধু তাই নয়, ঢাকার বাইরে থেকে আসা অস্ত্র ও মাদকের ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে কোনো কোনো বস্তি। সর্বশেষ জনশুমারিতে সারাদেশে বস্তিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৮৬ জন। আর ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন। এর মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ বস্তিতে থাকা লোকের সংখ্যা আট লাখ ৮৪ হাজার ৪৯৬ জন। আর ভাসমান লোকের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৭০ জন। রাজধানীর বস্তিতে সাড়ে ৬ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে আদাবর থানায় সবচেয়ে বেশি ৪৭২টি বস্তি রয়েছে। সবচেয়ে কম বস্তি আছে মতিঝিল থানায় (চারটি)। 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা জরিপ’ ২০১৪ অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মোট বস্তির সংখ্যা ১৬৩৯টি। মোট খানা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪০টি এবং এসব বস্তিতে মোট চার লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন মানুষ বসবাস করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৭৫৫টিতে মোট খানার সংখ্যা ৪০ হাজার ৫৯১টি এবং জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন। দুই সিটির মোট বস্তির সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৪টি, যেখানে মোট ছয় লাখ ৪৬ হাজার ৭৫ জন মানুষ বসবাস করেন। দুই সিটির মোট বস্তির সংখ্যা তিন হাজার ৩৯৪টি, যেখানে মোট ছয় লাখ ৪৬ হাজার ৭৫ জন মানুষ বসবাস করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি অপরাধ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১৬৬ জন। তবে এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৮৬ জন। আর গত বছর জুনে খুন হন দশজন। আর এ বছর জুনে খুন হয়েছে ২১ জন। রাজধানীতে গত বছর জুনের তুলনায় এ বছর জুনে খুন হয়েছে দ্বিগুণ।
ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা তথ্য বলছে, রাজধানীতে প্রতিনিয়তই ভাসমান মানুষদের হাতে দুয়েকটি করে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। এছাড়া চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণের মতো ঘটনা তো আছেই। বিষয়টি নিয়ে এখন জটিলতায় পুলিশ। ভাসমান অপরাধী ইস্যুতে সভাও করেছে পুলিশ। সেখানে জুন মাসের রাজধানীর ৪২টি মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে ১৩টি মামলার আসামিদের হদিস মিলছে না। ধারণা করা হচ্ছে এরা ভাসমান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়