জিএম কাদেরের দলীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা

আগের সংবাদ

বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে ফের জেলে পাঠানো হবে খালেদাকে

পরের সংবাদ

জেলহত্যা দিবস আজ : রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি

প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ভোর প্রায় ৪টা। আঁধারের বুক চিরে শহরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে ট্যাংক রেজিমেন্ট। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠল বঙ্গভবনের টেলিফোন। ফোনটা ধরল বঙ্গবন্ধুর খুনি শাহরিয়ার রশিদ খান। অন্যপ্রান্তে ভারি কণ্ঠস্বর, ‘আমি ডিআইজি প্রিজন বলছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ করতে চাই।’ একমুহূর্ত ভেবে খন্দকার মোশতাককে লাইন দিল রশিদ। মোশতাক টেলিফোন ধরে ওপাশের কথা শুনল নীরবে। তারপর বারকতক হ্যাঁ, হ্যাঁ করে সায় দিল। এরপরই নির্মম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলবল নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের দ্বারে রিসালদার মুসলেহউদ্দিন। ডিআইজি প্রিজনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শেষে রাষ্ট্রপতির বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে কারাগারের ভেতর তারা যখন প্রবেশ করে, সময় তখন ভোর চারটা থেকে সাড়ে চারটা। নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর পাগলা ঘণ্টি বাজতেই থাকে। বাতাসে অশুভ গন্ধ। এক নগ্ন নিষ্ঠুর প্রহসনের নীরব সাক্ষী হতে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের পাতাগুলো খুলে যায়।
রিসালদার মুসলেহউদ্দিন বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেল এক নম্বর সেলের দিকে যেখানে বন্দি পাশাপাশি দুইটা সেলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মহীরূহ ও চার জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। ডিআইজি প্রিজন সেলের তালা খুলে দেন। গর্জে ওঠে ঘাতকের আগ্নেয়াস্ত্র। সারি সারি বুলেট ছুটে যায়, আগুনের গোলা বিদ্ধ হয় এদেশের অগ্নিপুরুষদের শরীরে। লুটিয়ে পড়েন ওরা চারজন, চার সূর্যসন্তান। গোলাগুলির আওয়াজে কানে তালা লেগে যায় বাকী সব সেলের বন্দিদের। চাপ চাপ রক্ত, গুলিতে বিদ্ধ দেয়াল, ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীর। পড়ে থাকে তাজউদ্দীনের গুলিবিদ্ধ কুরআন শরীফ। পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ইতিহাসের কলঙ্কিত জেলহত্যার নিষ্ঠুরতার চিত্র এভাবেই ওঠে এসেছে খুনিদের বয়ানে। ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতম

দিন আজ। ৪৭ বছর পর কলঙ্কিত জেলহত্যা দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। সেইসঙ্গে দাবি উঠেছে, কমিশন গঠন করে সব ষড়যন্ত্র প্রকাশের। কমিশন গঠনের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশন গঠন করা হবে।
দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনসহ তিন দফা দাবিতে গত সোমবার স্পিকারকে স্মারকলিপি দিয়েছেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। অন্য দুটি দাবি হলো- ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনটিকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা এবং জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনীসহ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা।
সোহেল তাজের দাবিগুলোর সঙ্গে সহমতপোষণ করে বোন সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ইতিহাস বিকৃতি ঘটে। পাকিস্তানি ভাবধারায় চলে যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং রায় কার্যকর করেন। কিন্তু এখনো আমাদের নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানে না। জাতির পিতা, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধ, জেলহত্যা দিবস নিয়ে সম্যক জ্ঞান নেই। রক্তে কেনা দেশের জন্য এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশপ্রেম জাগ্রত করতে এসব দিবসকে শুধু আওয়ামী লীগের দিবস হিসেবে নয়, রাষ্ট্রীয় দিবস হিসেবে পালন করা প্রয়োজন। যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজেদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের শক্তিতে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে পারে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমনভাবে নেয়া হয়েছিল যাতে পাল্টা অভ্যুথান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি এটি কার্যকর হয়। আর এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি ঘাতক দলও গঠন করা হয়। এই ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল পাল্টা অভ্যুথান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করবে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডুকমেন্টস’ গ্রন্থে রয়েছে, জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল লন্ডনে, ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, মনসুর আলীর পুত্র মোহাম্মদ সেলিম এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আবেদনক্রমে স্যার থমাস উইলিয়ামস, কিউ সি এমপির নেতৃত্বে এই কমিশন গঠন হয়। ওই সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের অসহযোগিতা এবং কমিশনের একজন সদস্যকে ভিসা না দেয়ায় এ উদ্যোগটি সফল হতে পারেনি।
রহস্য উন্মোচনে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর দৌহিত্র, সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় ভোরের কাগজকে বলেন, গত সংসদ অধিবেশনে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছি। নানা বাধাবিঘœ পেরিয়ে নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। ১০ জন আসামি এখনো পলাতক। আমাদের আশা, তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরে সরকার সফল হবে। জয় বলেন, খুনিদের দণ্ড কার্যকরের পাশাপাশি জেলহত্যা দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের বিষয়টি আগেও সংসদে উঠেছে। আমি এ দাবির সঙ্গে একমত। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতার অবদান একসময় জাতি জানত না। তাদের নাম উচ্চারণই নিষিদ্ধ ছিল। এখন ইতিহাস জানানোর সঠিক সময়। জাতির কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরলে প্রজন্ম আত্মশক্তিতে বলীয়ান হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়