স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক এমডি কারাগারে

আগের সংবাদ

এসডিজি অর্জনে তিন চ্যালেঞ্জ : চারটি অভীষ্ট সঠিক পথে, ছয়টিতে উন্নতি, তিনটি অপরিবর্তিত, দুটির মূল্যায়নে উপাত্তে ঘাটতি

পরের সংবাদ

৬২ শতাংশ লেনদেনই সন্দেহজনক!

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ৮ হাজার ৫৭১ ** বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার **

কাগজ প্রতিবেদক : বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে অর্থ পাচারের কথা স্বীকার করার নজির নেই।
বিএফআইইউয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে ৮ হাজার ৫৭১টি সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন বা এসটিআর জমা হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বেড়েছে ই-কমার্স জালিয়াতি। তবে সন্দেহজনক এসব লেনদেনে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে এর কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে বিএফআইইউ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার অর্থ ব্যাংকের সুশাসনের ঘাটতির একটি বহিঃপ্রকাশ। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে ব্যাংক খাতে দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিএফআইইউ জানায়, পাচার প্রবণতা সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকেও অর্থপাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা নগণ্য। অধিকাংশ অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে ব্যবসায়িক চ্যানেলের মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গির আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত সংস্থাটির কার্যক্রম ও ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়কালে গতকাল সোমবার এসব কথা বলেন বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ, বিএফআইইউ

পরিচালক রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন প্রমুখ।
বিএফআইইউ প্রধান বলেন, টাকা বিদেশে চলে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন। বৈশ্বিকভাবে পাচারকৃত মোট অর্থের মাত্র এক শতাংশ উদ্ধার হওয়ার নজির আছে। তাই এটি ঠেকানোর জন্য আমরা কাজ করছি। অর্থ পাচারের ধরন বর্ণনা করে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্যমূল্য অতিরিক্ত দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউয়ের তৎপরতায় বিষয়টি ঠেকানো গেছে। বর্তমানে কম মূল্য দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গাড়িসহ উচ্চমূল্যের যেসব পণ্যে কর হার বেশি এসব ক্ষেত্রে কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে কম মূল্য দেখানো হচ্ছে। ফলে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে তার সঠিক তথ্য গোপন থাকছে।
এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী ভোরের কাগজকে বলেন, ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে ব্যাংক খাতে আগামীতে দুর্যোগ নেমে আসতে পারে।
তিনি বলেন, সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে ব্যাংকের সুশাসনের ঘাটতির একটি বহিঃপ্রকাশ। নাজুক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সন্দেহজনক লেনদেন কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ছে, একই সময়ে আগে যেমন বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো দুর্বল হচ্ছিল, এখন সরকারি ব্যাংকের অবস্থাও খারাপের কাতারে যাচ্ছে। যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে, নানা চেষ্টায়ও সেসব ব্যাংকের অবস্থা স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর বিএফআইইউ উচ্চ আদালতকে জানায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় তারা। এজন্য ৩ মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন আদালত। বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে এই চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ।
মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) মানেই অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত করি। এরপর যদি কোনো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ পাই তাহলে ব্যবস্থা নিই। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সাধারণত তথ্য সংগ্রহের পর তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয় বিএফআইইউ। পরবর্তী সময়ে বিধি অনুসারে ওই সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারকারীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিএফআইইউ নিজেই ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংককে জরিমানা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে। ৫২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করে ৩০টির সারাংশ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঠিক কাঠামো, হিসাবপত্র না থাকা ও ব্যক্তিনির্ভর হওয়ায় অনিয়ম বেশি হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু ব্যাংক লেনদেনের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোয়েন্দা সংস্থা এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করে বিএফআইইউ। তবে বিগত অর্থবছরে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ কার্যক্রম নিজেদের উদ্যোগে করেছে বলে জানিয়েছে তারা। দায়িত্ব পালনে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপ আছে কিনা- এমন প্রশ্নে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো চাপ নেই, বিএফআইইউ শতভাগ স্বাধীন।
হুন্ডি তৎপরতা রোধে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছে বিএফআইইউ। এই কার্যক্রমে জড়িত থাকায় দেশের কয়েকটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এফএফএস) প্রতিষ্ঠানের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ এবং কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে।
এছাড়া বহির্বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০৩টি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯৯টি আর্থিক অনিয়ম ও অর্থপাচারজনিত সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এর বিপরীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২৬টি আবেদন পেয়েছে বিএফআইইউ। এক প্রশ্নের জবাবে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের বিষয়ে তথ্য নেই তাদের কাছে। তবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছে তারা।
বাংলাদেশে ২০০২ সালের ৭ এপ্রিল থেকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন ও কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ইউনিট চালু করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে আইনি ক্ষমতা দিয়ে আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে- যা বিএফআইইউ নামে সমধিক পরিচিত। দুদক ছাড়াও সিআইডিকে মানি লন্ডারিংসংক্রান্ত অপরাধের তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে আইন সংশোধনের মাধ্যমে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়