শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হচ্ছে নি¤œচাপ : মঙ্গলবার আঘাত হানতে পারে ‘সিত্রাং’

আগের সংবাদ

সিত্রাংয়ের ভয়াবহ ছোবল ১৩ জেলায় : ভোলা ও নড়াইলে ৩ জনের মৃত্যু > তিন বিমানবন্দরে কার্যক্রম বন্ধ > ২৫ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে > তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

৩০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে ১৯৯২ সনের ৩৮নং আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রথম ১টি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় মহান জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতক্রমে প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই থেকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে দেশে বাংলাদেশ দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অবস্থানকারী যে কেউ সাধারণ কিছু শিক্ষা লাভ করার ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। দেশে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করার জন্য সব মহল থেকে তাগিদ অনুভূত হতে থাকে। বিশ্বে এরই মধ্যে শুধু দূরশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই নয় বরং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ বহুমাত্রিক করার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় বাংলাদেশেও বিশেষ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কমনওয়েলথসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসে। তাদের আর্থিক সহযোগিতা নিয়েই বাংলাদেশ সরকার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ গ্রহণ করে। এটি প্রথাগত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একক ক্যাম্পাসভিত্তিক নয়, বরং দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক কার্যালয় থাকায় সেখানকার শিক্ষার্থীরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ লাভ করে থাকে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং ক্যাম্পাস গাজীপুরে ৩৫ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া এর ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্রসহ দেশে আরো ১১টি আঞ্চলিক এবং ৮০টি উপআঞ্চলিক কেন্দ্র পরিকল্পনা মোতাবেক স্থাপিত হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত এসব আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক কেন্দ্রের অধীন নিকটস্থ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংযুক্ত করার মাধ্যমে সপ্তাহে ১-২ দিন শ্রেণি পাঠদান এবং অন্যান্য সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে। মূলত যারা চাকরিজীবী কিংবা পারিবারিক ও শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে লেখাপড়া সমাপ্ত করতে পারেননি তারা এবং যে কোনো বয়সের যে কোনো নাগরিকই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার রাখেন। এর ফলে দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা ছাড়াও আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সুযোগ লাভ করার ব্যবস্থাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এ কারণে এটিকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। দেশের যে কোনো অঞ্চলে অবস্থান করেও যে কেউ এর শিক্ষাক্রমে অংশগ্রহণ করার সুযোগ এখানে অবারিত থাকে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি পাঠদান যেমন রয়েছে, আবার তথ্যপ্রযুক্তি, মাল্টিমিডিয়া ইত্যাদি ব্যবহার করার মাধ্যমেও শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করার সুযোগ ব্যবহার করতে পারেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সে কারণে পাঠদানের সব ধরনের উপায় ও মাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠসামগ্রী তথা বইপুস্তক যেমন সরবরাহ করে থাকেন, একইভাবে অডিও, ভিডিও, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমেও শুরু থেকেই পাঠদানের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। ফলে বহু উপায়ে শিক্ষার সুযোগকে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বাধা-নিষেধ নেই। ১৯৯২ সাল থেকেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাংলাদেশে প্রচারিত হতে থাকে এবং নানা অঞ্চলের নানা বয়সের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কিছু ভাষা শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার সার্টিফিকেট অর্জনের প্রোগ্রাম চালু করেছিল, যেগুলো বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এখন দেশের বাস্তব অবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন আসায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চতর পেশাভিত্তিক কারিগরি, ব্যবসা, শিক্ষা প্রশিক্ষণ, কৃষি, চিকিৎসা, সামাজিক ও মানবিক বিষয়ে স্নাতক/স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চালু করতে হয়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বেশির ভাগ প্রোগ্রাম চলছে। তবে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও পাঠদানের কার্যক্রমে যুক্ত থাকায় শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছেন।
প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বহু মাধ্যমে শিক্ষাক্রম পরিচালনা করার মাধ্যমে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে তাদের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী বিষয়ে যে কোনো স্তরের শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা হয়ে উঠে বহুমুখী মাধ্যমে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের নির্ভরযোগ্য শিক্ষা লাভের একটি অপার সুযোগ। পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি পাঠদানের বাইরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতেও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইংল্যান্ডে ১৯৬৯ সালে দ্য ওপেন ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে এটি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৭২২ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে পাকিস্তানে আল্লামা ইকবাল উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রীলঙ্কা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ভারতে আরো বেশকিছু সংখ্যক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রায় একই সময়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে মান ও বিস্তারের ক্ষেত্রে আমরা ততটা চ্যালেঞ্জ নিতে পারিনি। আধুনিক দক্ষ জনবল সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। সে কারণে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্তমান শতাব্দীর চাহিদা পূরণে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতেই হবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব উপআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে নানা বিষয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কারিগরি, নার্সিং, সেবামূলক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে অসংখ্য কিশোর, তরুণ ও যুবক কর্মদক্ষতার জ্ঞানলাভের সুযোগ পেতে পারে। নিকটস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এই শিক্ষাক্রম অনায়াসে পরিচালিত করতে পারে। এছাড়া অবকাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় উপজেলা, জেলা এবং বিভাগগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উচ্চতর বিভিন্ন শাখার পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এর সঙ্গে যুক্ত হতে কোনো বাধা নেই। উন্নত দেশগুলোতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বিশেষজ্ঞদের শিক্ষাক্রম এবং গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শ্রেণিপাঠদানের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমও গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে প্রস্তুত হয়নি। করোনাকালে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেই শিক্ষাক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পদ্ধতির সহায়তা নিয়েছিল। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে অনলাইন পদ্ধতির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বর্তমানে এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছাপ থাকা আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি এর প্রোগ্রাম, শিক্ষাক্রম এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে দেশে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ও গবেষণার সুযোগ করে দিতে পারে। এর কারিগরি সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহারের মাধ্যমেই দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভের সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়টি অনায়াসেই গ্রহণ করতে পারে। ৩০ বছর হয়তো খুব বেশি সময় নয়। তবে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে শিক্ষার ধ্যান-ধারণা ও প্রয়োগগত চাহিদা অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন ভিশন ও মিশন গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা ছাড়া টিকে থাকার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর নির্ভর করে নয় বরং নিজেদের অবকাঠামোকে পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউটর, শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের মেধা এবং শ্রমকে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া অনলাইন পদ্ধতিকে আরো কীভাবে সবার জন্য সহজ ও সুলভ্য করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করা যাবে, সেটিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। তবেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী হয়ে উঠবে সফল এবং গৌরবমণ্ডিত।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : সাবেক ডিন, বাউবি।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়