শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হচ্ছে নি¤œচাপ : মঙ্গলবার আঘাত হানতে পারে ‘সিত্রাং’

আগের সংবাদ

সিত্রাংয়ের ভয়াবহ ছোবল ১৩ জেলায় : ভোলা ও নড়াইলে ৩ জনের মৃত্যু > তিন বিমানবন্দরে কার্যক্রম বন্ধ > ২৫ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে > তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

বোকারাই রাঁধে বাড়ে চালাকেরা তা খায়

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এটি একটি ব্রিটিশ প্রবাদ। সেই চাণক্য, প্লেটো, এরিস্টোটলের যুগ থেকে লক্ষ করা গেছে যুগধর্মের স্বার্থ সন্ধ, আচার-আচরণে বণ্টন বৈষম্য ঘটিয়ে গরিবদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের শ্রমে অর্জিত সাফল্য আত্মসাৎ করে ধনীরা ধনী হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রথমেই উল্লেখ রয়েছে জনগণের কথা, যারা দেশ স্বাধীন করেছে, সেই আমজনতার রাজনৈতিক, অর্থনীতিতে এই প্রবণতার প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে। সংগত ও স্বাভাবিক কারণেই, দেশের বয়স পাঁচ দশক পার করে ইদানীং আমজনতার মনে প্রশ্ন জাগে রাজনৈতিক, অর্থনীতির এই মারপ্যাঁচে তাদের ঠেকে শেখার কি কোনো শেষ নেই? ঠেকে শিখতে শিখতে তাদের প্রজন্ম শেষ হয়ে পরের প্রজন্মের মধ্যেও এর দুঃখজনক প্রভাব চলতে থাকবে বলে তাদের আশঙ্কা। সেই আদি পিতা হযরত আদম ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন। প্রভু নিরঞ্জনের নির্দেশ-উপদেশ উপেক্ষা করে সম্পাদিত সেই ভুলের খেসারত হিসেবে স্বর্গ হতে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রথম মানব-মানবিকে। অনেকেরই ধারণা এমন অসতর্ক না হলে, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল না করলে, এমন নির্দেশ অমান্যের ঘটনা না ঘটলে আজ সবাই স্বর্গে স্থায়ীভাবে বিনা দলাদলিতে, বিনা সংকট-সন্ত্রাসে-সংশয়ে বাস করা যেত। যা হোক আদি মানবের করা প্রথম নির্দেশ অমান্যের ঘটনা থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে যত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত, অপশাসন, আইনের বরখেলাপ, চোরাগোপ্তা হামলা, ডাকাতি, পুকুর এবং সাগর চুরি, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, ডলার (কৃত্রিম) সংকট, দুর্নীতি-দুঃশাসন-স্বৈরাচার সব কিছুর সালতামামি ও শুমার করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায় অনেকেরই অধিকাংশেই ‘ঠেকে শেখা শেষ হয়নি’ অর্থাৎ তারা উপযুক্ত শিক্ষা পাননি বা নেননি। অনুপযুক্ত ওরফে কুশিক্ষার কারণে একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে, দোষারোপের দোদুল্যমানতায় এমন ভুল ঘটনা আর ঘটবে না- এমন পথে পা বাড়ানো হবে না, এমন কিছু আর করা হবে না; এ ধরনের প্রতীতিতেও ঘটছে বিপত্তি। আজ যারা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা বা পথপন্থা শুরু করেন তাতে কখনো-সখনো মনে হয় সবকিছুতে এমন সুরক্ষা লাভ ঘটবে, তাতে শনৈঃ শনৈঃ গতিতে উন্নতির পথে সবাই যাবে বা থাকবে। কিন্তু এ রকম প্রবোধ, প্রত্যয় অতীতে অনেক ঘটনার পরপরই নেয়া হয়েছে কিন্তু বিপর্যয়, ঘটনা ও দুর্ঘটনা ঘটা থেমে থাকেনি। অতীতে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা, সে সময় নেয়া প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা পারতপক্ষে তেমনভাবে থামিয়ে দিতে পারেনি ভাবী কালের অঘটন ঘটন সংঘটনকে। আদি ভাই কাবিলের হাতে তার একমাত্র ভাই হাবিলের মৃত্যুতে মা হাওয়ার বুক খালি হওয়া থেকে শুরু করে এই কিছুক্ষণ আগেও পৃথিবীর কোথাও কোথাও কোনো না কোনো মায়ের বুক সহসা খালি হওয়ার মতো মর্মবিদারক ঘটনা ঘটেছে। ঠেকে শেখা শেষ হয়নি। উচিত বা উপযুক্ত শিক্ষা পেতে সময় লাগলেও পরবর্তীকালে তা উপলব্ধির ক্ষেত্রেও চলেছে মর্মান্তিক মরাকাটাল।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে- অতি সনাতন কথা। আর ভারতে ব্রিটিশ সরকার সবাইকে শিখিয়ে গেছে, ‘চোর তো চুরি করবেই গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’, ‘সর্বত্র সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ ফন্দি-ফিকির চলছেই। সেই চাণক্যের আমল থেকে বলা হচ্ছে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ’। এমনতরো নীতিকথা খনার বচনে ঠাঁই পাওয়ার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েই চলেছে, প্রায়ই উচ্চারিত হয় সবই ঠেকে শেখার পর প্রবোধ দেয়ার জন্য। মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি বড় হয়, চুল পাকে যে প্রকারে ও গতিতে, চোর-ডাকাত আর দুষ্কর্মী-দুর্নীতিবাজের হাত পাকে তার চাইতে বেশি মাত্রায় ও গতিতে, সে কারণেও ঠেকে শেখা শেষ হয় না। কেননা শয়তানি বা দুষ্টু বুদ্ধির বিনিয়োগ বেশ প্রখর, লক্ষ্যভেদি ও সুতীক্ষè, পক্ষান্তরে তাকে মোকাবিলা করা ওরফে মাড়িয়ে বা এড়িয়ে চলার প্রয়াস প্রচেষ্টা কেন জানি তত জোরালো নয়, মনে হয় যেন হালে পানি পায় না। পরস্পরের দোষারোপে অধিকাংশ সময় পার হয় এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঠেকে শেখার উপাদান শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়- একটু অন্য কায়দায় কিছু একটা আবার ঘটলে তখন সবাই আবার যুক্তির বাড়ি দৌড়ায়, যৌক্তিকতা খোঁজার কাজে লেগে যায় এবং এক সময় আবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানেরটা বটেই অতীতেরটা মোকাবিলার অগ্রগতি অনুসরণের জন্য উদ্যম আর মেলে না। এসবই উপযুক্ত, কার্যকর তথা গুণগতমান সম্পন্ন শিক্ষার অবর্তমানে, অভাবে।
সেই রাখাল বালকের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বাঘ এলো বাঘ এলো বলে গ্রামবাসীকে বারবার সচকিত সক্রিয় করতে করতে একসময় এ ধরনের তথাকথিত সতর্ককরণের প্রয়াসকে মূল্যহীন ভাববার অবকাশ তৈরি হয়ে যায়। শেষে সত্যি সত্যি যেদিন বাঘ আসে সেদিন আর তার ডাকে কেউ সাড়া দেয় না। ঠেকে শেখার বেলায় তাই ঘটে। ঠেকে না শিখতে শিখতে তা এক সময় অগৌণ হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত আক্রমণের সময় দেখা যায়, এ ওর দিকে অঙুলি হেলন ছাড়া কেউ আর কোনো প্রকৃত প্রতিরোধ গড়ছে না।
আসলে বারবার দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর ফলে চোখ এমন ট্যারা হয়ে যায় যে, কোথায় দৃষ্টিক্ষেপ হচ্ছে তা বোঝার বিষয়টিও গোলমেলে হয়ে যায়। তখন বড়জোর এটা করলে ভালো হতো, ওটা করলে ভালো হতো- টাইপের চর্বিত চর্বণ উচ্চারণেই সব কিছু মিলিয়ে ও থিতিয়ে যায়। আসল বাদ দিয়ে নকলের দিকে চলে যায় চোখ, চোখে ধোঁকা দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয় অন্যত্র ফলে নকলের, অনিয়মের, অশিক্ষার, কুশিক্ষার বাড়ে সুযোগ। তারা বেশ বলশালী হয়।
বাংলাদেশের আমজনতা এমন এক সময় ও পরিবেশে বাস করে সেখানে অতি সতর্কতার নামে সময় ব্যয় হয় যত্রতত্র এবং আসল দুরবস্থা থেকে দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে বহুদূরে। সেখানে সকালে সবাই সুকান্তের মতো শিশুর নিরাপদ বাসযোগ্য বিশ্ব রচনায় মনোনিবেশের মন্ত্র জপে, তাদের সময় কাটে ‘সকল জঞ্জাল সরানোর’ প্রত্যয় ও প্রগলভতায়। কিন্তু কিছুই না করে বা করতে না পেরে বিকালে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়ে সবাই বলে ‘আমার হাতে তো ছিল না পৃথিবীর ভার’। অন্যের ওপর সব দায়-দায়িত্ব চাপানোর চৌকশ চতুর লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে। আসলে দশখান অব্যবস্থাপনার মধ্যে সবাইকে ব্যস্ত রেখে ঠেকে শেখার দাওয়াই দিয়ে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আড়ালে কারো কারো আসল কাজ উদ্ধারের পথ করা হয় নিরাপদ নিরপদ্রুপ। সফলতা সবখানে- উপেক্ষায় এবং উপেক্ষার আড়ালে, উপলব্ধির খতিয়ান ও পর্চায় কাটাকাটির ঘটনা তাই বারবার ঘটে।
নানাবিধ উন্নতির অবয়বে গ্রামীণ সমাজে ভাঙা-গড়ার পটপরিবর্তন হচ্ছে- সেখানে ঠেকে শেখার আকাক্সক্ষারাও দ্রুত ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন অপকর্মের উন্নতিতে। যা কোনোদিন ভাবা হয়নি বা যায়নি তা ঘটছে এখন গ্রামীণ সমাজ জীবনেও। গ্রেশামের থিওরির মতো নগরের মতো গ্রাম থেকেও সুবচন, ধৈর্যশীলতা, শোভনীয়তা ভালোরা নির্বাসিত-অপসারিত হচ্ছে, সেখানেও অকর্মণ্য-অপদার্থদের সরব উপস্থিতি বাড়ছে। যুবসমাজের মধ্যে যে অস্থিরতা বাড়ছে- তাতে মনে হচ্ছে শিক্ষায়তনে যেন পড়াশোনার যথাযথ চাপ বা তাগিদ নেই, পরীক্ষা দিলে পাস হয়ে যাওয়ার প্রথা পরিব্যপ্ত হওয়ার ফলে মাদকাসক্তি বাড়ছে, মুঠোফোনে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সৌজন্যে এমকি দূরদর্শনেও দেশি-বিদেশি অবৈধ সংস্কৃতির অবাধ যাতায়াত বাড়ছে। কাউকে মর্মান্তিক আক্রমণ করার ছবি তোলার লোক পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু ওই আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বা উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যাওয়ার জন্য যেন কেউ নেই। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবক ও সমাজ চিন্তকদের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। শিক্ষক সমাজে আদর্শস্থানীয়দের অপস্রিয়মাণ অবস্থানে অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে উঠছে। সমাজের সামনে ঠেকে শেখার ব্যাপ্তি বাড়ছে।
উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ও মানসিকতা না বাড়ার কারণ শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণের দিকে সঠিক নজর না থাকাই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বারবার নতুন অবয়বে দুর্ঘটনা ঘটছে। আজকাল অনেকেই কেন জানি নাটকীয়তা পছন্দ করেন। তৃপ্তি পান একের পর এক ঘটনা ঘটুক, এটা যেন চান কেউ কেউ। দুর্ঘটনার পেছনে সবাই দৌড়ায়, কেন দুর্ঘটনা ঘটছে তার ‘কজ’ এবং ‘ইফেক্ট’-এর মূল্যায়ন ও তদারকি হচ্ছে না। দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ এবং এর উৎসমূলে যাওয়া হয় না। কারণ প্রতিকার, প্রতিরোধ, প্রতিশোধনে, তদন্ত প্রতিবেদনে চোখ দেয়ারই যেন সময় নেই। দুর্ঘটনার পরবর্তী বিষয় নিয়ে পরস্পর দোষারোপে মেতে ওঠা হয়। প্রচার প্রগলভতায় ভোগা হয় কিছু একটা করা হচ্ছে দেখে। দুর্ঘটনার উৎসমুখ বন্ধ করার উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না। এ যেন দুর্নীতি হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ যেমন শুরু হয়। সমাজে কেন দুর্নীতি হয়, দুর্নীতির উৎস কী, তার প্রতিরোধে প্রতিষেধকে না গিয়ে শুধু প্রতিকার নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয় এমন এক সময়, যখন ক্ষতি বা দুর্নীতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। গুণগতমান সম্পন্ন কার্যকর ও উপযুক্ত শিক্ষার জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হোক, কেননা এহেন ক্ষতির পাল্লা যদি এমনই ভারি হয়ে যায় ভবিষ্যতে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করারও থাকবে না কিছুই। এমন ধারণাও প্রচার চলে আমজনতা সুশাসন বোঝে না, তারা দেখতে চান উন্নয়ন। দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে আমজনতাকে মাথা ঘামাতে না করা হয়, বলা হয় সরকারই এসব শোধ করবে। যে দেশ বা সমাজে গরিবরাই রেমিট্যান্স আনে আর ধনীরা তা বিদেশে পাচার করে, সেখানকার আমজনতাকে উন্নতি-উন্নয়নের চমক দেখিয়ে, তাদের আর্থসামাজিক স্বার্থ-সৌভাগ্যের ক্রম বিপর্যয় ঘটানোর অপপ্রয়াস-অপচেষ্টার ধরন দেখে সেই প্রাচীন প্রবাদের কথাই মনে পড়ে যায়, বোকারা রাঁধে বাড়ে আর চালাকেরা তা খায়।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক ও উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়