বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

ফের অস্থির ডলার বাজার, দাম ছাড়াল ১১৪ টাকা : এখনো পর্যবেক্ষণ করছে বাফেদা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : ডলারের কিছুটা কমে আসা দর আবার বাড়ছে। সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রির পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। বেশ কিছুদিন স্থির থাকার পর খোলাবাজারে ডলারের দাম গতকাল বৃহস্পতিবার ১১৪ টাকা ছুঁয়েছে। এর আগে খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১০৮ থেকে ১০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছিল। তবে দাম বাড়লেও বাজারে ডলার সংকট অব্যাহত আছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশে যারা যাচ্ছেন, তারা পাসপোর্টের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছেন না। কার্ব মার্কেট থেকে তাদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদার সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার যাচাই করে ডলারের একক দাম নির্ধারণে আগামী রবিবার আবারো বৈঠকে বসবে এবিবি ও বাফেদা।
এদিকে, ডলার বাজারে সা¤প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে নতুন করে আরো ছয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ১২ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরানো এবং এসব ব্যাংকের এমডিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। জানতে চাইলে সিপিডির সিনিয়র ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ডলারের সংকটের পাশাপাশি কিছু অসুস্থ প্রতিযোগিতাও সৃষ্টি হয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে তা আরো কঠোরভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রয়োজন মাফিক ডলার সরবরাহ করা যাবে না, ততক্ষণ এ ঝুঁকি থেকে যাবে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে নতুন অর্থ বছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে, কমেছে আমদানি ব্যয়। কিন্তু এরপরও ডলার সংকট কাটছে না। বরং দিন দিন রিজার্ভ কমছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমদানি-রপ্তানির হিসাবটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন

ব্যুরোর। কিন্তু অদৃশ্য অনেক পেমেন্ট আছে। এছাড়া বিভিন্ন কারণে ডলার এখনো পাচার হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। অন্যদিকে ব্যাংকের বাইরে অনেক ডলার আছে। অবমূল্যায়নের কারণে টাকার প্রতি মানুষের আস্থাও কমছে। ফলে ডলার সংকট কাটছে না।
এই সংকট কাটাতে কতদিন লাগতে পারে- জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, ডলার সংকট কাটাতে বা পরিস্থিতি সামলাতে কত দিন লাগবে তা বলা মুশকিল। সামগ্রিক চাহিদা কতখানি তা আমরা এখনো খুঁজে বের করতে পারিনি। তিনি বলেন, ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা হচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকের সুদের হার বাড়ছে না। এতে টাকার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকে রাখা টাকার পরিমাণ (মান) প্রকৃত বিবেচনায় কমে যাচ্ছে। আবার আমাদের অনেক অদৃশ্য পেমেন্ট আছে। প্রতি মাসে ১৫ থেকে ১৭ মিলিয়ন ডলার শর্ট টার্ম পেমেন্ট আছে প্রাইভেট সেক্টরে। তাই আমদানি-রপ্তানি কমানো বা বাড়ানোর মাধ্যমে কিছুই হবে না। এখানে আরো কিছু চাহিদা আছে। অফিসিয়াল সার্ভিস একাউন্ট ছাড়াও আনঅফিসিয়াল সার্ভিস একাউন্ট আছে। ভ্রমণের জন্য, চিকিৎসার জন্য, শিক্ষার্থীদের কারণেও ডলার চলে যাচ্ছে। সে বিষয়গুলো হিসাবের মধ্যে আনতে হবে।
সাধারণত বিদেশে ভ্রমণ, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা-সংক্রান্ত খরচের জন্য মানুষ খোলাবাজার কিংবা ব্যাংক থেকে ডলার কিনে। কিন্তু খোলাবাজারে গেল কয়েক দিনে বেশ বড় অঙ্কের ডলার কেনার চাহিদা আসছে, যা মানুষের ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। তাই পাচারের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বিনিয়োগের উদ্দেশে কিছু মানুষ ডলার কিনছেন বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। তথ্যমতে, দেশে অনুমোদিত মানিচেঞ্জার ৬০২টি, এর মধ্যে ২৩৫টির বৈধতা আছে। বাকিগুলোর লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল রয়েছে। জানা গেছে, লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল হওয়া কিছু মানিচেঞ্জার ডলারের অবৈধ ব্যবসায় নেমেছে। মানিচেঞ্জারের বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ের অবৈধ লেনদেনে কোনো কাগজপত্র লাগে না।
কাটছে না ডলার সংকট, কমছে রিজার্ভ : বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া ডলারের দাম এখন ৯৫ টাকা। কিন্তু ব্যাংকের বাইরে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকায়। বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির অভিযোগে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডলার ধরে রাখার ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নীতিমালা জারি করেছে। কেউ যদি ১০ হাজার ডলারের বেশি নিজের কাছে রাখেন, তাহলে আইনগত ব্যবস্থার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে স্থিতিশীলতা রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে। গত বুধবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে আরো ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়।
এদিকে আকু’র (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) সর্বশেষ ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন কমে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত দুই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এবিবি ও বাফেদার বৈঠক : ডলার সংকট কাটা?তে প্রবাসীদের আয় বা রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অ?নৈ?তিক প্রতিযোগিতা কর?ছে। ফ?লে যে ব্যাংক বেশি দাম দিতে পারে তারাই রেমিট্যান্স পা?চ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রে এক রেট বা দাম নির্ধারণের সুপারিশ করেছে ব্যাংকগুলো। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) বৈঠকে এ সুপা?রিশ ক?রে ব্যাংকগু?লো।
বৈঠক শেষে বাফেদার চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা? প?রিচালক ও সিইও মো. আফজাল করিম বলেন, ডলারের দাম যাতে আর না বাড়ে আমরা সে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। বাজার স্থিতিশীল করতে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার তা নেয়া হবে। এজন্য আরো সপ্তাহ খানেক সময়ের প্রয়োজন। শিগগিরই ডলার সংকট কেটে যাবে বলেও জানান তিনি।
এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, ডলার মার্কেট নিয়ে আগামীতে কোন ধরনের নীতিমালা করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আগামী রবিবারের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স অনেকটাই পজিটিভ। পার্থক্যটা অনেকাংশে কমে এসেছে। ভবিষ্যতে এ ঘাটতি আরো কমে আসবে। সুতরাং ডলার সংকট খুব বেশিদিন থাকবে না।
আরো ছয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব : ডলার বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা করায় আরো ছয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রিতে ৭৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। গত বুধবার ব্যাংকগুলোর এমডিকে চিঠি দিয়ে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- বিদেশি মালিকানার এইচএসবিসি, বেসরকারি খাতের এনসিসি, মার্কেন্টাইল, ব্যাংক এশিয়া, ইউসিবি ও ঢাকা ব্যাংক। ডলার বাজারে সা¤প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে এ নিয়ে ১৩ ব্যাংকের কাছে এ ধরনের ব্যাখ্যা চাওয়া হলো। এর আগে, গত ৮ আগস্ট ডলার নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগে ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খা?তের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাঁরা বর্তমানে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত। পরে গত ১৮ আগস্ট ব্যাংকগুলোর এমডিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। এ ছাড়া পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ডলার থেকে অর্জিত মুনাফা আলাদা একটি অ্যাকাউন্টে রাখতে বলা হয়েছে। পরে গত ২৪ আগস্ট ডলারের দরের প্রকৃত তথ্য আড়াল করায় ইস্টার্ন ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, কোনো কোনো ব্যাংক ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে দ্বিগুণ বা তার বেশি মুনাফা করেছে। অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে এ ধরনের মুনাফা করায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অবশ্য একটি ব্যাংক ডলার বেচাকেনায় কেমন মুনাফা করবে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়