ঢাকা কলেজ : ক্যান্টিনে খাওয়া নিয়ে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ১০

আগের সংবাদ

ভাঙা সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির মচ্ছব : সড়ক খনন নীতিমালা উপেক্ষিত > তিন মাসের কাজ বছরজুড়ে > সেবা সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই

পরের সংবাদ

‘বাংলার জয়ে’ বেঁচে থাকবেন কিংবদন্তি গাজী মাজহারুল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : জয় বাংলা- শুধু রক্তে প্রলয় নৃত্য জাগানিয়া দুটি শব্দ কিংবা স্লোগানই নয়। মহান একাত্তরে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গ করেছেন লাখো প্রাণ। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন অসংখ্য বীর। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারের অধিবেশন শুরু ও শেষ হতো, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়/কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে/নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়’ গানটি বাজিয়ে। প্রায় সারা দিনই বাজত এই গান। এটি শুধু গান নয়, শিরায় শিরায় আগুন লাগানো উদ্দীপনার সম্মিলন, যার মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে হানাদার বধে এগিয়ে গেছেন ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ আপামর বাঙালি। মহান মুক্তিযুদ্ধের রণসংগীত হিসেবে বিবেচিত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। কালজয়ী গানটির সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ মারা যান ২০০৬ সালের ১৭ জুন। গতকাল রবিবার ভোরে সূর্য ওঠার পরপরই থেমে গেল গীতিকারের হৃৎস্পন্দনও।
একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ গীতিকার, পরিচালকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে। স্ত্রী জোহরা গাজী, ছেলে সারফরাজ আনোয়ার এবং মেয়ে দিঠি আনোয়ারকে রেখে গেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। কালজয়ী এই গীতিকারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংগীত ও

চলচ্চিত্রাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে আজ সোমবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হবে এই কিংবদন্তিকে। দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। বনানীতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে মা খোদেজা বেগমের কবরের পাশে সমাহিত হবেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
বিবিসি জরিপে ঠাঁই পাওয়া সেরা তিনটি গান : যে দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষজন পছন্দের গান শোনার জন্য বেতারে কান রাখতেন, যখন দেশে টেলিভিশন চ্যানেল ছিল মাত্র একটি; সে সময় দিনে অনেকবার শোনা যেত কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার রচিত গান। পাঁচ দশকের বেশি সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশের সংগীতের জগতে বিচরণকারী গাজী মাজহারুলের লেখা গানের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি, পৃথিবীতে যা বিরল। গাজী মাজহারুল আনোয়ার গান লেখা শুরু করেন ১৯৬২ সালে। তার লেখা প্রথম গান ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। তার গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ ও অনুভূতির কথা। ২০০৬ সালে বিবিসি জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি গান। গানগুলো হচ্ছে- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ ও ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’।
গান লেখা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সময়ের তাগিদেই গান লেখা শুরু করেছিলাম। সময়টা ছিল সংগ্রামের। অধিকার আদায়ে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র যে যার মতো আন্দোলন করছেন। অনুভব করলাম আন্দোলনে নামার তাগিদ। কলমটাকে মাধ্যম করে জড়িয়ে গেলাম আন্দোলনে। মুক্তিযুদ্ধের আগে বেশ কিছু ছবির প্রযোজনা করেছিলাম। সে সুবাদে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সরাসরি মিশে ছিলাম। ছবির জন্যই লিখেছিলাম, জয় বাংলা বাংলার জয়। চারদিকে যুদ্ধ। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম চট্টগ্রাম-সীতাকুণ্ড-কুমিল্লায়। এর মধ্যেই প্রতিদিন তৈরি হতো গান। সময়টাই যেন ছিল গান লেখার প্রেরণা। কলমকে অস্ত্র বানিয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম আমি। এর মধ্যে লিখলাম ‘হে বন্ধু বঙ্গবন্ধু’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’সহ বেশ কিছু গান।
মেডিকেল ছাত্র থেকে গীতিকার : জন্মস্থান কুমিল্লায় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি দেয়াল পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি ছিলেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। কবিতা লেখা কীভাবে তাকে গানের রচয়িতা করে তুলল সেটি বর্ণনা করে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর যখন মেডিকেল কলেজে এসে ভর্তি হলাম, সেখানে একটা নাটক হওয়ার কথা। সেটাতে একটা গানের প্রয়োজন হয়েছিল। গানটা সে সময়কার প্রখ্যাত গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেবের লেখার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সময় স্বল্পতার কারণে লিখতে পারেননি। তো আমি গিয়ে নাটকের পরিচালককে বললাম আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে একটু ট্রাই করে দেখতে পারেন। তারপর আমি একটি গান লিখে ফেললাম, ‘বুঝেছি মনের বনে রঙ লেগেছে’। গানটি পরে গেয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন। এভাবেই রেডিওতে গানের রচয়িতা হিসেবে অভিষেক। এরপরের পাঁচ দশক ধরে তার গানে উঠে এসেছে দেশপ্রেম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের জীবনের গল্প, প্রেম, বিরহের কথা।
কালজয়ী কিছু গান : ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’ ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আছেন আমার মুক্তার, আছেন আমার বারিস্টার’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে’, ‘সাতটি রঙের মাঝে মিল খুঁজে না পাই’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’, ‘চলে আমার সাইকেল’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘ইশারায় শিষ দিয়ে আমাকে ডেকো না’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে’, ‘আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলোরে’, ‘সাধকে মনমোহন হরি গোপীজন, মন চায় বাসরী’, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’, ‘বউ যায়গো পালকি চড়ে’, ‘বাছারে বাছা তুই আরেকটা দিন বাড়িতে থেকে যা’, ‘আমায় একটি ক্ষুদিরাম দাও বলে কাঁদিস নে মা’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করো’- এরকম অসংখ্য হৃদয়ে দোলা লাগানো কালজয়ী গানের গীতিকার তিনি।
বর্ণিল জীবন : গান লেখার পাশাপাশি ছবি পরিচালনা এবং প্রযোজনাও করেছেন গাজী মাজহারুল। ১৯৬৯ সালে ‘সমাধান’ ছবির মাধ্যমে প্রযোজনায় যুক্ত হন তিনি। প্রায় ৩৩টি ছবি প্রযোজনা করেছেন। পরিচালনা করেছেন ‘সন্ধি’, ‘স্বাক্ষর’, ‘স্বাধীন’, ‘ক্ষুধা’, ‘সমাধি’, ‘স্বীকৃতি’, ‘পরাধীন’ ইত্যাদি আলোচিত ছবি। তার পরিচালিত সর্বশেষ ছবি ‘আর্তনাদ’। তবে গান লিখেই স্বীকৃতি পেয়েছেন বেশি। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। স্বাধীনতার পর গীতিকার হিসেবে প্রথম রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পান। ২০০২ সালে একুশে পদক, ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, এস এম সুলতান স্মৃতিপদক, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা রয়েছে তার ঝুলিতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়