সাংবাদিকদের মেরে উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা

আগের সংবাদ

সামাজিক অপরাধ বেড়েছে

পরের সংবাদ

সব বিভাগে চরম অবহেলা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** গ্রেপ্তার ১০ বিআরটি কর্মীর স্বীকারোক্তি ** ক্রেন চালাচ্ছিল হেলপার ** সেফটি ইঞ্জিনিয়ার এসএসসি পাশ **

কাগজ প্রতিবেদক : বিআরটি প্রকল্পের সব বিভাগেই চরম অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনার কারণেই গাড়ির ওপর গার্ডার পড়ে ৫ জন নিহত হন। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্প এলাকার কোথাও দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করা হয়নি। দুর্ঘটনার দিনও সেখানে গার্ডার ওঠানোর মতো ভারী কাজ চলাকালে নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ওই সময় সিগন্যালম্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও ছিল না। গার্ডার পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রেনটির ফিটনেস নেই। ক্রেনটি পরিচালনা করছিল চালকের সহকারী। এই চালকদেরও ছিল না লাইসেন্স।
এছাড়া গার্ডারের ওজনের তুলনায় ক্রেনের সক্ষমতা ছিল কম। লোড ক্যারি ক্যাপাসিটি ও কাউন্টার লোড ব্যবস্থাও যথাযথ ছিল না। ভারী কাজ চলার বিষয়ে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। অদক্ষ মাধ্যমিক (এসএসসি) পাস সেফটি ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে প্রকল্পের কাজ তদারকি করা হচ্ছিল। বিআরটি প্রকল্পে গার্ডার চাপায় দুই শিশুসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে ক্রেন চালকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্যই মিলেছে। র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা প্রকল্পের সব বিভাগেই অনিয়ম ও দায়িত্বহীনতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা জানান, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছিল চায়নার গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি (সিজিজিসি)। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশও ছিল না। ৮০ টনের গার্ডার তোলার জন্য বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ওই ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়া প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে ছিল ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিস নামের

অপর একটি প্রতিষ্ঠান।
গতকাল বৃহস্পতিবার ১০ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত বুধবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালানো অভিযানে মো. আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয় (২৫), রাকিব হোসেন (২৩), মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষার (৪২), রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) ও মঞ্জুরুল ইসলামকে (২৯) গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি জানান, উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের যে ক্রেন থেকে প্রাইভেটকারের উপর গার্ডার পড়েছে সেটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ক্রেনে যে গার্ডারটি তুলছিল সেটির ওজন ৬০-৭০ টন। থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। ক্রেনটি আনুমানিক ১৯৯৬-৯৭ সালে আনা হয়েছিল। প্রথমে ক্রেনটির সক্ষমতা ৮০ টন ছিল। পরে আস্তে আস্তে ক্রেনটির সক্ষমতা কমে যায়। সর্বশেষ ক্রেনটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। এছাড়া ২০২১ সালে সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়। এরপর ক্রেনটির আর ফিটনেস যাচাই করা হয়নি। দুর্ঘটনার দিন আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালানো শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলন করতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গার্ডারটি রাস্তায় চলমান প্রাইভেটকারের উপর পড়ে। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
এ দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি পুরোপুরি উঠে এসেছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির ক্রেনের চালক মো. আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয়কে জুরাইন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি অপারেটর হলেও দুর্ঘটনার সময় ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন সহযোগীকে দিয়ে। বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রেন চালানো দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি।
বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির ক্রেন চালকের হেলপার রাকিব হোসেনকে বাগেরহাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ৩-৪ মাস আগে সেখানে কাজ নেন তিনি। ক্রেন চালানোর কোন পারমিট না থাকলেও দুর্ঘটনার সময় ক্রেন চালাচ্ছিলেন তিনি।
ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধাকে ধামরাই থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। চুক্তি করা, ক্রেনের ভাড়া দেয়া, চালক নিয়োগ ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য কাজের দায়িত্ব ছিল রুহুলের। সর্বশেষ গত বছর ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল। এছাড়াও অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স ব্যতিত অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগও দেন তিনি। একই কারণে কোম্পানিটির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষারকে সাভার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হেভি ইকুয়েপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেনকে যাত্রাবাড়ী ও একই প্রতিষ্ঠানের হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠুকে মানিকদী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপারেটরদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করছিলেন। এছাড়া স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন থাকার কথা থাকলেও তা রাখা হয়নি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহকে বোর্ডবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কোন ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক দক্ষতা নেই। দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন, পর্যাপ্ত ট্রাফিক নিয়োগ দেয়নি। মাত্র এসএসসি পাস হয়েও সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গত বছর থেকে কাজ করছিলেন তিনি।
চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানির (ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের) ট্রাফিকম্যান মো. রুবেল ও মো. আফরোজ মিয়াকে সিরাজগঞ্জ ও টঙ্গি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুর্ঘটনার সময় দুর্ঘটনাস্থলে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিল তারা।
চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি (ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের) প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিন বছর ধরে এক প্রতিষ্ঠানের প্রকিউরমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। সব ধরনের কার্যক্রম দেখাশোনা করা, মালামাল কেনা, কার কী কাজ ঠিক করে দেয়া, কাজ সঠিক ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছে কিনা- তা যাচাই বাছাই করা কাজ তার। চাইনিজ ভাষায় দক্ষ্য হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও অন্যান্য ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন তিনি।
ঘটনাস্থলে দায়িত্বে থাকা চীনা কর্মকর্তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি? এমন এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মুখপাত্র মঈন বলেন, একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসবে এ ঘটনায় দায়ী কারা। এছাড়া এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে যাদের দায় রয়েছে বা জড়িত রয়েছে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে দুর্ঘটনার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইলামের নির্দেশে প্রকল্পের ঢাকা অংশে কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কীভাবে প্রকল্পের কাজ আবার শুরু করা যায় তা নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মেয়র আতিকের বৈঠকে বসার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত বৈঠক হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়