ট্রেনে আসন সংখ্যা কম : ছাদে ও বগিতে গাদাগাদি ভ্রমণ, ভোগান্তি চরমে

আগের সংবাদ

জ্বালানি সাশ্রয়ে কৃচ্ছ্রতার কৌশল

পরের সংবাদ

বিচারহীনতায় আশকারা পায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, ভুক্তভোগীরা আস্থার সংকটে!

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু সরকারপ্রধানের এমন হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাতই করছে না বিশেষ একটি গোষ্ঠী। নানা অজুহাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে একের পর এক ঘটিয়ে চলছে সাম্প্রদায়িক ঘটনা। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বারবারই হামলা চালানো হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। ভাঙা হচ্ছে বসতবাড়ি ও মন্দির। আর এসব কাজে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে। ঘটনার ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন,
সাম্প্রদায়িকতার নামে রাহুটি যেন বাংলাদেশের সমাজকে গ্রাস করতে চায়। ২০১১ সালের আগে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়; তখন ধর্ম অবমাননা ও মহানবী (সা.) কে কটূক্তি করেছে- এই অভিযোগ করে হিন্দু শিক্ষকদের লক্ষ্য করে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। পরপর প্রায় ৭/৮টি ঘটনা ঘটেছিল। গোপালগঞ্জ থেকেই এই ঘটনার শুরু। এরপরই ধারাবাহিকভাবে রামু, উখিয়া, টেকনাফসহ বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া, ২০১৪ সালে ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৯ সালে ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে ব্যাপক আকারে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর দুর্গোৎসবের সময়ও সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছর দোলযাত্রা উৎসবের আগে ঢাকার ওয়ারি, খিলগাঁও তিলপাপাড়া, নোয়াখালী ও খুলনার রূপসা এলাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি নড়াইলের হামলার ঘটনা, টিপ পরা নিয়ে ড. লতা সমাদ্দার, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হৃদয় মণ্ডল কিংবা হিজাব পরা নিয়ে শিক্ষার্থীদের কথিত নির্যাতনের ঘটনায় আমোদিনী পাল ও স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও হয়রানিগুলো একই সূত্রে গাঁথা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত থেকে ১০/১১ বছরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বড় অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও আজ পর্যন্ত তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। অথচ একটি ফেসবুক পোস্ট দেয়া, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ভিন্ন সম্প্রদায়ের এবং প্রগতিশীল মানুষের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। চলছে হয়রানি এবং বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাবরণ। দুর্গোৎসবের সময় সারাদেশে যে একটানা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট হয়। এই রিট দিয়ে বিচারিক (জুডিশিয়াল) তদন্তের আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু দেখা যায়, যখন এই তদন্তগুলো চলছিল তখন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে ওই হাইকোর্টের আদেশকে স্থগিত করে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশ প্রগতির উল্টো পথে হাঁটছে। একের পর এক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার মধ্য দিয়ে সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। এর পাশাপাশি সুযোগসন্ধানী মহলও নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক বলেন, ওয়াজের মাধ্যমে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়। অথচ তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মাদ্রাসাগুলো সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর আঁতুর ঘর। যারা ওয়াজ করে তাদের তো বটেই, মাদ্রাসাগুলোকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এদিকে সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়েছে। শুধু প্রশাসনই নয়, বিচার বিভাগেও রাজাকাররা ঢুকে পড়েছে। এর ফলে আজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত কারোর বিচার হচ্ছে না এ দেশে।
সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে সমঅধিকার ও সমমর্যাদার জন্য এ দেশের সংখ্যালঘুদের লড়তে হবে তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাবিনি। ধর্ম অবমাননার দায়ে যে হামলাগুলো চলছে- যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগ পর্যন্ত আমরা শুনিনি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কারোর ধর্মের অবমাননা করেছে। পরিকল্পিতভাবেই টার্গেট করে এই হামলাগুলো করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় অনেকেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, নড়াইলে কিংবা দুর্গোৎসবের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা- এমনকি ড. লতা সমাদ্দার, হৃদয় মণ্ডল, আমোদিনী পাল, স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ সংখ্যালঘুদের ওপর প্রতিটি হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এসব ঘটনায় যে ভিকটিম সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। কোর্ট তাকে নিরাপত্তার কথা বলে জামিন দেয় না। আর যারা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি।
দুর্গোৎসের সময় সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে আক্ষেপ করে এই সিনিয়র আইনজীবী বলেন, গত বছর দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স। এই ঘোষণার তোয়াক্কা না করে টানা ১৩ দিন একটানা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট হয়। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারিক তদন্তের আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু দেখা যায়, যখন এই তদন্তগুলো চলছিল তখন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে ওই হাইকোর্টের আদেশকে স্থগিত করে বিষয়টিকে ডিপফ্রিজে পাঠিয়ে দিয়েছে। পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই রহস্যময় মনে হয়েছে। আর মনে হয়েছিল বলেই আমরা বলেছি এর পেছনে রহস্য কাজ করছে এবং প্রধানমন্ত্রীর যতই আন্তরিকতা থাক কোনো একটি মহল একে ‘ব্যাক থ্রো’ করতে চাইছে।
শুধু হামলা চালিয়েই নয়, সংখ্যালঘুদের নানা কায়দায় নির্যাতন চলছে উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনটি ২০১১ থেকে ২০১৩ সালে মোট ৬টি সংশোধনী হয়। ২০২২ সাল চলছে তবুও দেখা যায় ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনালে এই আবেদন ও আপিল আবেদনের ক্ষেত্রে একটি ধীরগতি প্রক্রিয়া কাজ করছে। ১০ শতাংশ আবেদনও এখানে নিষ্পত্তি হয়নি। আইনে আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসক (ডিসি) তা ভুক্তভোগীদের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু দেখা যায়, ৩ থেকে ৪ শতাংশ জমিও ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হলে আজ থেকে বছর দুই আগে বিচারপতি ওবায়দুর হাসান ও কৃষ্ণা দেবনাথের যৌথ বেঞ্চ একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস আপিল করেছে। তাহলে কী দেখছি? আইন হয়, আইন কার্যকরি হয় না। আবার অন্য দিকে সরকারের আইন কর্তৃপক্ষ যারা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন তারা কিন্তু এসব আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে কোনো রাজনৈতিক দলের ওপরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আস্থা রাখতে পারছে না।
ধারাবাহিক নির্যাতনের ফলে সংখ্যালঘুরা আস্থার সংকটে আছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আস্থার সংকট শুধু সরকারের ওপরই নয়, এখন বিচার বিভাগের ওপরও আস্থার সংকট এসে গেছে। খুবই দুর্ভাগ্য। দুর্গাপূজার সময় এতগুলো জেলায় হামলা হলো হাইকোর্ট বিচারিক তদন্ত করল ৫টি জেলায়। সরকারের এমনকি গাত্রদাহ যে, ৫টি জেলায়ও বিচারিক তদন্ত হতে দেবে না? আপিল বিভাগ এ বিষয়ে স্থগিতাদেশ দিল। আমরা যাবটা কোথায়? হাইকোর্টে যৎসামান্য কিছু পেলে সেটি যদি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ বন্ধ করে দেয় সেক্ষেত্রে আস্থার সংকট এখন বিচার বিভাগের ওপরও এসে গেল। এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে তো মনে হয় না। পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে। আমাদের শক্তভাবে রাজপথে থাকতে হবে। রাজপথে না থাকলে সরকারও কিছু করবে না। এই সরকারের আর ভোটের দরকার নেই। সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাংক বলে যেটি ছিল সেটির দরকার নেই। যা কিছু হচ্ছে তা তো বিনা ভোটেই হচ্ছে। সামনেও যা হবে তা হলে চালাকি। এই কারণেই দরদ নেই। ভোটের জন্য যে দরদটা ছিল সেটি নেই। আমি অসহায় বোধ করি। আগে আদালতের ওপর ভরসা ছিল কিন্তু এখন কার ওপর আস্থা রাখব?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পড়ায় এই সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনাগুলো ঘটছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সাম্প্রদায়িক কূপমণ্ডূকতা আমাদের ঘিরে ফেলছে। আমরা অতি সহজেই ধর্মকে সংস্কৃতিকে সব কিছুতে গুলিয়ে ফেলি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা ছড়িয়ে দিতে পারিনি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পর আর কেউ কী তরুণ সমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রজ¦ালিত করতে পেরেছি? আমার মনে হয় না। পারিনি বলেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের মূল্যবোধের জায়গায় চির ধরেছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে শাঁখের করাতের মতো। একে ব্যবহার করে সা¤প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়