ট্রেনে আসন সংখ্যা কম : ছাদে ও বগিতে গাদাগাদি ভ্রমণ, ভোগান্তি চরমে

আগের সংবাদ

জ্বালানি সাশ্রয়ে কৃচ্ছ্রতার কৌশল

পরের সংবাদ

ইস্যু যাই হোক টার্গেট সংখ্যালঘু

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** বিশ্লেষকদের মতে, পরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে এসব অপকর্ম ** নির্বাচন এলে হামলা বেড়ে যায় ** নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি **

সেবিকা দেবনাথ : কিছুদিন পরপরই দেশে নানা অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়। তাদের বাড়িঘর-উপাসনালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। অনেক সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে, সংখ্যালঘু নারীর সম্ভ্রমহানির খবরও মিলছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব হামলার ঘটনা পর্যালোচনা করে একটি প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে- প্রায় প্রতিটি হামলাই হচ্ছে ইসলাম ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে; পরবর্তী সময়ে যার পেছনে চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পরিকল্পিত ইন্ধনের প্রমাণ মিলছে। বেশির ভাগ হামলা হয়েছে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে- বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে। কখনো কখনো অবশ্য সম্পত্তি দখল বা স্থানীয় ইস্যুও কাজ করে। ঘটনা ঘটার পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। চলে দোষারোপের রাজনীতি। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ইস্যু চাপা পড়ে যায়। অপরাধীরাও বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্মের শুরু থেকেই সংখ্যালঘুরা ছিল অপশক্তির টার্গেট। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেছে বেছে হিন্দুদের ওপর হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্য হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করা। পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ থামেনি। জাতীয়সহ বিভিন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে কিংবা তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর একটি বিশেষ ভোট ব্যাংকের তকমা নিয়ে দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা চালানো হয় তা ১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৯০, ১৯৯২ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাবাহিকতায়ই ঘটেছে। পরবর্তীতে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৮ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এছাড়া ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন যেন নতুন মাত্রা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই নির্যাতনের ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমছে। নিরাপত্তা এবং পরবর্তী বংশধরদের কথা ভেবেই দেশ ছাড়ছেন অনেকে। বাংলাদেশের আদম শুমারি পর্যালোচনায় সেই তথ্যই মেলে।
মানবাধিকার কর্মী ও সংখ্যালঘু নেতারা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু গ্রাম আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ১৯৭৫ পরবর্তী কোনো জাতীয় নির্বাচন সংখ্যালঘুদের জন্য সুফল

বয়ে আনেনি। নির্বাচনের আগে ও পরে, দুর্গোৎসবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের বিষয়টি এখন যেন নির্ধারিত হয়ে গেছে। বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি দেবালয়ও এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু। এসব ঘটনার নেপথ্যে যারা থাকেন সেই তালিকায় পরাজিত ও জয়ী সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও দলীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সংখ্যালঘু অজুহাতে নির্যাতনের সময় নীরব ভূমিকা পালন করেন। অতীতের রেকর্ডসহ সবশেষ নড়াইলে ঘটে যাওয়া ঘটনা সেই প্রমাণই দেয়।
এরপরও সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টিকে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ অস্বীকার করেও বক্তব্য দেন। চলতি বছরের ২২ জুন দিল্লি সফরকালে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন এবং মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা ভাঙচুর নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা হয়। গত বছরও দুর্গোৎসব চলাকালে দেশের বিভিন্ন মন্দির ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাও অস্বীকার করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ওই সময় এক বিবৃতিতে দাবি করেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় কেউ ধর্ষিত হননি এবং একটি মন্দিরেও অগ্নিসংযোগ কিংবা ধ্বংস করা হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বিবৃতি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া গত বছর দুর্গাপূজার সময় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন বিষয়ে ‘ত্বরিত ব্যবস্থা’ নেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজের কথা থেকে সরে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের কোনো প্রয়োজন নেই। সংবিধানেই সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা সংরক্ষিত করা আছে। প্রয়োজনে সাক্ষী সুরক্ষা আইনটি বিল আকারে উত্থাপন করা হবে। যা শুধু সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলার সাক্ষীদের জন্য নয় সব ধরনের মামলার সাক্ষীদের জন্য করা হবে। সংখ্যালঘু কমিশন প্রশ্নে আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, এটি নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। এর আগ পর্যন্ত কমিশনের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারছি না। সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের বেছে বেছে নির্যাতন- বস্তুত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। রাজনৈতিক গোলযোগের সূত্র ধরেও যদি তেমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাদের বিচারের সুযোগ রয়েছে।
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, ’৭১-এর পরাজিত শক্তি ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা এবং তার অন্যতম প্রধান সহযোগী ৪ জাতীয় নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানপন্থি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বারবার হামলা সেই চক্রান্তেরই অংশ। সামনে নির্বাচন, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে থাকা জামায়াতের লোকজন এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। ৭৫’র পর থেকে বাংলাদেশকে মোল্লা ওমরের আফগানিস্তান বানানোর জন্য সচেতনভাবে এই কাজগুলো করা হচ্ছে। এ দায় সরকারকে নিতে হবে। যে সরকার মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই সরকারের আমলে এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। হেফাজতিদের আস্ফালনের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি? এই বাংলাদেশ দেখার জন্য ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন? কোনো সভ্য সমাজে এমনটা হতে পারে না।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ও খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও মনে করেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনে নির্বাচন ইস্যু একটি অন্যতম বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা আশানুরূপ নয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সামাজিক অনুশাসনে বহুত্ববাদের স্বীকৃতি ও চর্চার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। যে কারণে দেশের সংখ্যালঘুরা নিজ দেশেই ঐতিহাসিক কাল ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
তবে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ঘটে- এমনটা মানতে রাজি নন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সিনিয়র এই নেতা ভোরের কাগজকে বলেন, বিষয়টি তেমন নয়। ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে সহিংস ঘটনাগুলো ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারা হামলা চালায় তারা আওয়ামী লীগের মদতপুষ্ট বা নব্য আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের ছত্রছায়ায়ই এসব হামলা হয়। এর কারণেই হামলাকারী কারোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পুলিশ, প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই। তাদের সামনে ঘটনা ঘটে আর তারা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। আরো দুঃখজনক ঘটনা হলো, যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।
ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ ভোরের কাগজকে বলেন, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তারা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সেই দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এখন তা নিয়ে নানা টালবাহানা চলছে। বিচারহীনতার কারণেই বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর এসব হামলা হচ্ছে। এত এত হামলা ও সহিংস ঘটনা ঘটল, একটিরও বিচার হয়নি। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের কথাটা এলেই একটি ধর্মের ব্যাপারে সব কিছুতে আমরা বিচার বিবেচনা হারিয়ে ওই ধর্মাবলম্বী কাউকে পেলে সব এক করে ফেলছি। কিন্তু ঠিক উল্টো দিকের ব্যাপারে আমরা একেবারেই নীরব। ধর্মীয় অনুভূতি আসলে একমুখী। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতি নেই। যদি থাকতো তাহলে কিছুদিন পরপরই মন্দির ভাঙতো না। সম্প্রতি ভারত সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেগুলো অসত্য।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়